মৃতু্য সবসময়ই বেদনার। তবু কিছু কিছু মানুষের মৃতু্যকে মেনে নেয়া যেন অনেক কষ্টের। সম্প্রতি না ফেরার দেশে চলে গেলেন নজরুল সংগীতের বরেণ্যশিল্পী, গবেষক, স্বরলিপিকার ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সংগীতগুরু খালিদ হোসেন। তার এই মৃতু্যতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হলো তা অপূরণীয়। তথ্য মতে, বুধবার রাত ১০টা ১৫ মিনিটে তিনি রাজধানীর জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) মৃতু্যবরণ করেন। মৃতু্যকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। জানা যায়, বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি হৃদরোগে ভুগছিলেন। কিছুদিন আগে তার কিডনির জটিলতা বেড়ে যায়। ফুসফুসেও সমস্যা হচ্ছিল। পাশাপাশি বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন সমস্যা ছিল। চিকিৎসা দেয়ার জন্য প্রতি মাসেই হাসপাতালে নেয়া হতো খালিদ হোসেনকে। দুই-তিনদিন তিনি হাসপাতালের সিসিইউতে ভর্তি থাকতেন। এবারও ৪ মে ভর্তি করা হয়। কিন্তু শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় চিকিৎসকরা আর ছাড়েননি। শেষ পর্যন্ত তিনি সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
সংগীতগুরু খালিদ হোসেনের মৃতু্যর মধ্যদিয়ে দেশ একজন গুণী শিল্পীকে হারালো। তিনি তার সংগীত সাধনার মধ্যদিয়ে যে অবদান রেখেছেন তা ভোলার নয়। মৃতু্যর মানুষের অনিবার্য নিয়তি হলেও, তবু তার এই চলে যাওয়া মেনে নেয়া কষ্টের। একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য নজরুল সংগীতশিল্পী খালিদ হোসেনের মৃতু্যতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তার মৃতু্যতে দেশের সংগীতাঙ্গনে নেমে এসেছে এক গভীর শোকের ছায়া।
উলেস্নখ্য, এই গুণীশিল্পীর জন্ম হয়েছিল ১৯৩৫ সালের ৪ ডিসেম্বর। তখন তারা ছিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরে। দেশ বিভাগের পর মা-বাবার সঙ্গে তিনি চলে আসেন কুষ্টিয়ার কোর্টপাড়ায়। ১৯৬৪ সাল থেকে তিনি স্থায়ীভাবে ঢাকায় ছিলেন। নজরুলসংগীতের শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন দীর্ঘদিন সংগীতগুরু খালিদ হোসেন। দেশে ও বিদেশে রয়েছে তার অসংখ্য ছাত্রছাত্রী। সংগীতের অবদানের জন্য ২০০০ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত হন। এ ছাড়া পেয়েছেন নজরুল একাডেমি পদক, শিল্পকলা একাডেমি পদক, কলকাতা থেকে চুরুলিয়া পদকসহ অসংখ্য সম্মাননা। খালিদ হোসেনের গাওয়া নজরুল সংগীতের ছয়টি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া আছে একটি আধুনিক গানের অ্যালবাম ও ইসলামী গানের ১২টি অ্যালবাম। খালিদ হোসেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেশের সব মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ও বাংলাদেশ টেক্সট বুক বোর্ডে সংগীত নিয়ে প্রশিক্ষক ও নিরীক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। নজরুল ইনস্টিটিউটে নজরুল সংগীতের আদি সুরভিত্তিক নজরুল স্বরলিপি প্রমাণীকরণ পরিষদের সদস্যও ছিলেন তিনি।
আমরা বলতে চাই যে, সংগীতগুরু খালিদ হোসেন এমন একজন শিল্পী ছিলেন যিনি দেশের সংগীতাঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছেন। সামগ্রিকভাবে সংগীতাঙ্গনে যে অবদান তিনি রেখেছেন তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার এই প্রস্থান নিঃসন্দেহেই দেশের সংগীতের জন্য এক গভীর ক্ষতের সৃষ্টির করল এবং এই ক্ষত অপূরণীয়- তবু মৃতু্যর স্বাভাবিকতা মেনে নিতে হবে। সংগীতের প্রতি ভালোবাসা এবং শিল্পী সত্তার যে সাক্ষর তিনি রেখে গেলেন তা উদ্দীপ্ত করবে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে। সর্বোপরি আমরা বলতে চাই, তিনি চলে গেলেও তার সংগীত থেকে যাবে মানুষের হৃদয়ে। এই গুণীশিল্পীর বিদেহ আত্মার প্রতি রইল আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা এবং তার শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আমাদের সমবেদনা।