শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নারীরা জাগো। এবার তোরা মানুষ হ।

নতুনধারা
  ২৬ মে ২০১৯, ০০:০০

তৃণের মতো অন্তরালের আমি। আমার কথা কেউ শুনুক আর নাই শুনুক। শুনে কেউ হাসুক আর নাই হাসুক। আমি তো আমার কথা বলতেই পারি।

বিশ্বস্রষ্টা অসংখ্য সৃষ্ট প্রজাতির মধ্যে মানুষ নামের এক প্রজাতির জন্ম দিয়েছেন। নানা অনুশীলনের ফলে মানুষ নামের প্রজাতিটি অন্যান্য প্রজাতি থেকে নিজেকে আলাদা করে নিতে পেরেছে।

আর প্রকৃতি প্রতিটি প্রজাতির মধ্যে দুটি সম্পূরক শ্রেণি বানিয়েছে। যেমন মানুষের মধ্যেও নর ও নারী। সৃষ্টির শুরু থেকে- বলতে পারি নারী-পুরুষের মধ্যে সম্প্রীতিই ছিল। তারা একসঙ্গে আহার জোগাড় করত। একসঙ্গে খেতো- ঘুমাতো। যাপিতজীবনের সব কাজ একসঙ্গে করত। প্রকৃতিগত কারণেই নারী যখন সন্তানসম্ভবা হয় সঙ্গত তার বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। কালক্রমে সেই সুযোগে নারী গৃহাশ্রয়ী হয়ে পড়ে। সন্তান লালন, আঙিনার কৃষিফসল উৎপাদন আর গৃহপালিত পশুপালন নারীর ওপর বর্তায়। বাইরের যত কাজ পুরুষের কর্তৃত্বের কাছে চলে আসে। পুরুষ প্রভু হয়ে ওঠে। গড়ে ওঠে পুরুষতন্ত্র। পুরুষের প্রভুত্বের কাছে নারী পরাভূত। দিনে দিনে নারীর বুদ্ধি লোপ পায়। নারীর চেতনা হয় পরাহত। সেই থেকে নারী গবাদি হয়ে যায়। অথচ যে নারী একদিন পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে উঠত। নিজেকে বাঁচানোর জন্য হিংস্র হায়েনার সঙ্গে যুদ্ধ করত। ঝড়-শিলাবৃষ্টি বিরুদ্ধ প্রকৃতিকে তোয়াক্কা না করে পাথর ঘষে আগুন জ্বালাতো, অস্ত্র বানাতো, শিকার করে খাবার আহরণ করত। সেই নারী হয় পরাশ্রিত, পরস্ব, পরনির্ভর। যদিও এখনো কোনো কোনো এলাকায় ক্ষুধা নিবৃত্তির তাড়নায় নারীও পুরুষের মতোই বাইরের কৃষিকাজ করে, রাস্তায় মাটি কাটে, ইট-পাথর ভাঙে। কিন্তু সামাজিক লাগাম পুরুষের হাতেই থেকে যায়। নারীর শ্রম সস্তায় বিক্রি হয়। নারীকে নিয়ে পুরুষরা রঙ-তামাশা করে। নারী অফিসপ্রধান কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান তথাপি সুযোগ পেলেই পুরুষরা নারীকে নিয়ে ব্যঙ্গ করতে ছাড়ে না। প্রাচীন এবং বিশেষ করে মধ্যযুগে নারীকে নিয়ে শুরু হয় পুরুষের চিত্তাকর্ষক নানা রসালো রমনীয় কাহিনী। পুরুষ হয় মুকুটপরা সম্ভোগী সম্রাট, বেনিয়া, চিত্রকর চটুল ভাস্কর আর সাজে গীতবাদ্যের নটেশ্বর। নারীকে নিয়ে নারীর স্তন, নিতম্ব, উরু জংঘা, যোনি, ঊর্ধ্ববাহু অর্থাৎ নারীকে যেভাবে দাঁড় করালে পুরুষের যৌনদৃষ্টির মানসিক তৃষ্ণা মেটে ঠিক সেইভাবে নারীর ছবি এঁকে শিল্প রচনা করা শুরু করে। প্রাচীন সাহিত্যে এর অনেক প্রমাণ এখনো বিরাজ করছে। রাজা-বাদশাদের বাড়ির সদর দরজার মাথায় থাকতো সিংহের ভাস্কর্য আর অন্দরে প্রবেশ পথে কিংবা বাগানবাড়িতে পাথরে খোদাই করা নারীর উলঙ্গ ভাস্কর্য ছাড়া তাদের আভিজাত্যই প্রকাশ পেতো না। উলঙ্গনারী নৃত্য, নারীচিত্রের ভাস্কর্য যে যত বেশি বিশেষ ভঙ্গিতে নির্মাণ করতে পেরেছে সেই হয়েছে বিশ্ব বিখ্যাত শিল্পী চিত্রকর, ভাস্কর। পুরুষের ভোগদখলে বাধা দিলেই নারী হয়েছে পেতনি, ডাকিনি,ব্যভিচারিণী, দ্বিচারিণী, বিরুদ্ধাচারিণী, বামা, অপ্রসন্না, অসতী, কলঙ্কিণী, রাক্ষসী ইত্যাদি। আর নারী যখন পুরুষের অনুগত, তখন হয়েছে রমণী, ললনা কামিনী, বণিতা, শর্বরী, শশীমুখি, আরও কত কত মধুমেয় নাম্তনারীদেহ বর্ণনাকারী কুশালো রসালো নামকরণ ব্যাকরণবেত্তাদের লেখনীর ডগায় চিত্তনন্দিনী হয়ে ফুটে উঠেছে।

আধুনিক কালেও নারী সন্তান লালন থেকে শুরু করে গৃহস্থালি সামলিয়েও অফিস-আদালত এমনকি রাষ্ট্রীয় বড় বড়

দায়িত্ব পালন করছে। বিশ্বজুড়ে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হচ্ছে। নারী রাষ্ট্রও পরিচালনা করছে। কিন্তু পুরুষ প্রভাবিত

নারী এখনো তার পুরনো বৃত্ত ভাঙতে পারেনি। পারেনি এ কারণে যে, নারী রাষ্ট্রপ্রধান সেও তো পুরুষের অনুকম্পায়। যুগে যুগে পুররুষের রাজনৈতিক ভাবধারা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য উত্তরাধিকার সূত্রে নারী ক্ষমতায় এসেছে। ইতিহাস খুলে আমরা তাই দেখে আসছি। আদতে নারী পুরুষক্ষমতার হাতের পুতুল। এখনো নারী পুরুষের অনুগত দাস। পুরুষের আনন্দে আমোদিত। পুরুষবেনিয়ার কাছে নারী দাসী, নারী পণ্য, বেহুদা নারী টাকা পেলে পুরুষ যা করতে বলে তাই করে। ন্যাংটাও হয়। সিনেমা, মডেলিংযে পুরুষ পরে প্যান্ট, শার্ট, কোট-টাই আর নারী পরে বিকিনি।

প্রায় অর্ধ উলঙ্গ পোশাকে পুরুষের সঙ্গে সিনেমায় নারী অভিনয় করছে। পুরুষ বাণিজ্য করছে নারীকে নিয়ে। নারী স্বেচ্ছায় বিবস্ত্র হয়, পুরুষের কামুক হাততালি পাওয়ার জন্য।

বোকা নারী সানন্দে সাগ্রহে বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতা করে। সেখানে নারীর নিতম্ব, কোমর, বাহুবেষ্টনী, স্তন মেপে দেখা হয়। চতুর পুরুষ আয়োজকরা সুন্দরী প্রতিযোগিতায় কৌশলে নারীর মেধা যাচাইমূলক কিছু প্রশ্ন জুড়ে দিয়েছে। বিশ্বে যখন পুরুষরা গ্রহ থেকে গ্রহ আবিষ্কারের চিন্তা করছে। এত এত সুন্দরীর সংস্পর্শে থাকার পরেও সত্তর হুরির সন্ধান করছে। তখনো নারীরা সুন্দরী প্রতিযোগিতা, আর দামি প্রসাধনীর পেছনে ব্যয় করছে তার মেধা। আমাদের দেশের প্রথিতযশা নারী কথা সাহিত্যিকরা এগুলোকে শিল্পিত শিল্প বলে এদের শিল্পভাষায় উৎসাহিত করে যাচ্ছে।

তাই বলে আমি মেয়েদের বোরকা কিংবা হিজাব পরে ঘরে বসে থাকার কথা বলছি না। বলছি- ইলামিত্র, প্রীতিলতা, বেগম রোকেয়া, বেগম সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম তারাও নারী। তারা ধর্মবাদের ভয়ে কিংবা সমাজের লোকনিন্দার ভয়ে, কখনো বোরকা-হিজাব পরেননি। তারা আমাদের দেশ-জাতির প্রথম সারির মহিলা। তারা বিদগ্ধ মহীয়সী নারী। তারা দেশের কল্যাণের জন্য দেশের নারীসমাজকে জাগ্রত করার জন্য উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সমাজে অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবনকে বিপন্নের মুখে ঠেলে দিতে তারা দ্বিধা করেননি। তারাও নারী, তারাও মানুষের মতো মানুষ।

সারা বিশ্বে ভৌগোলিক কারণে ভাষা কৃষ্টি কালচার ভিন্ন ভিন্ন। তাই বলে একটি দেশের নারী-পুরুষের পোশাকের পার্থক্যে এতটা ভিন্নতা থাকতে পারে না। এটা পুরুষতন্ত্রের বিকৃত রুচিবোধ। নারীর পোশাক মানেই যৌনামোদিত। তাতেই নারী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আসলে নারীরা কিনা চেতনাগতই অধঃপাতে গেছে। নারী এত এত শিক্ষিত হচ্ছে। এত ডিগ্রি নিচ্ছে। রাষ্ট্র চালাচ্ছে একবারও কেউ বলে না আমরা ঘরে-বাইরে সিনেমা মডেলিংয়ে এসব বিকিনি পোশাক পরবো না। পুরুষের মতোই শালিন পোশাকে আমরা সব কাজ করবো। নারীরা যদি শুধু একবার সাহস করে বলে- তোমাদের কথায় আমরা আর বিকিনি পোশাক পরবো না। তোমরা না দাও আমাদের শ্রমের মজুরি। না দাও তোমাদের বেনিয়ানন্দের হাততালি। তোমাদের বিকিনি পোশাক কারখানা নিপাত যাক। তাহলে পৃথিবীর পুরুষতন্ত্র কিংবা কোনো বাণিজ্যিক পুরুষেরই ক্ষমতা নেই একটি মেয়েকে বাধ্য করে ওইসব উলঙ্গ পোশাক পরতে।

তাই বলি নারীরা জাগো। এবার তোরা মানুষ হ।

মোসলিমা খাতুন

সাবেক বিভাগীয় প্রধান, বাংলা

সখীপুর আবাসিক মহিলা কলেজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<51087 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1