শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষি ও কৃষকের বর্তমান অবস্থা এবং আমাদের অর্থনীতি

নতুনধারা
  ২৬ মে ২০১৯, ০০:০০

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ায় এখানকার অর্থনীতি বিশেষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। বেশির ভাগ মানুষের জীবিকার একমাত্র উৎস কৃষি খাত। বাংলাদেশ ভৌগোলিক অবস্থান কৃষি খাতের জন্য একদম উপযুক্ত কারণ এখানকার মাটি পৃথিবীর যে কোনো দেশ থেকে উর্বর; যেটি ফসল উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত দরকারি। এ জন্য বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হলে এ খাতটির কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাংলাদেশের কৃষি এবং কৃষকের অবস্থা এখন নাজেহাল। অপার সম্ভাবনার এই খাতটি অবহেলার সর্বশেষ দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। যারা দিন-রাত ঝড়-বৃষ্টি একাকার করে নিরলস পরিশ্রম করে জমিতে সোনার ফসল ফলায়; তারা প্রতি বছরই কষ্টে অর্জিত ফসলের ন্যায্য দাম পায় না এবং সীমাহীন বৈষম্যের শিকার হয়। উদাহরণস্বরূপ বর্তমানে ধানের হাস্যজনক মূল্যের কথা বলা যায়। একজন কৃষক ফসল উৎপাদন বাবদ লাভ তো দূরের কথা উৎপাদন খরচটায় তুলতে পারছে না। ১ লিটার পানির দাম ২৫ টাকা অথচ ১ কেজি ধানের দাম মাত্র ১২ টাকা। কৃষি উপদান যেমন: উন্নত বীজ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ওষুধ, কৃষি যন্ত্রপাতি, সেচ ব্যবস্থা এবং শ্রমিকের মজুরি যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে সে তুলনায় কৃষিপণ্য বিশেষত ধানের দাম নিতান্তই কৃষকদের সঙ্গে ঠাট্টার সামিল। এক কেজি গরুর গোশত কিনতে কৃষককে এক মণ অর্থাৎ ৪০ কেজি ধান বিক্রি করতে হয়। মনের ক্ষোভে কয়েকজন কৃষক নিজেরাই নিজেদের ফসলের মাঠে আগুন দিয়েছেন। বিষয়টা এমন দাঁড়াচ্ছে যে, মনোবেদনা প্রকাশের জায়গা না পেয়ে লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে ফসলের মাঠেই সব ক্ষতির পরিসমাপ্তি ঘটাচ্ছেন আগুন দিয়ে। এ ছাড়া বাংলাদেশে এখন ধানের ভরা মৌসুম হওয়া সত্ত্বেও হাজার হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানি করছে ভারত থেকে অথচ দেশীয় কৃষকদের ন্যায্যমূল্য দেয়া হচ্ছে না। সরকারের মন্ত্রীরা যখন বিদেশে চাল রপ্তানি করার কথা বলছে ঠিক সে সময় হাজার হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানি করা হচ্ছে। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সংকট না থাকা সত্ত্বেও চাল আমদানি করায় বাজারে ধানের দাম আরও কমে যাচ্ছে। এই আমদানি করার প্রবণতা বন্ধ না করা হলে কৃষকরা আরও ক্ষতিগ্রস্থ হবে এবং কৃষি অর্থনীতিতে ধস নামবে। একবার চিন্তা করে দেখুন তো, যে দেশের শতকরা ৮০ ভাগ লোক কৃষি খাতের সঙ্গে জড়িত সেখানে কৃষি অর্থনীতিতে ধস নামলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কি আদৌ সম্ভব। মানুষের প্রথম মৌলিক চাহিদায় হলো খাদ্য। আর সেই খাদ্য উৎপাদনের জন্য কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়ে কঠোর মেহনত করে ফসল ফলায়। এবং বেশির ভাগ কৃষকই ফসল উৎপাদনের জন্য ঋণ নিয়ে থাকে এবং ফসল বিক্রি করে অর্থ পরিশোধ করে। কিন্তু ফসলের যথাযথ দাম না পেলে, ঋণের অর্থ ফেরত তো দূরে থাক সংসার চালানোই কষ্টকর হয়ে পড়ে। যারা ১৮ কোটি মানুষের অন্ন জোগায় তাদের পেটেই থাকে ক্ষুধা। এ পরিস্থিতি প্রতিবারই পুনঃপুনঃ হলে ফসল ফলানোর ধারাবাহিকতা সুরক্ষা পাবে কী করে? যারা আজ উচ্চশিক্ষিত সমাজে এসির বাতাসে বাসমতি চাল আর বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার খাচ্ছে, তারা কখনোই কি ভেবেছে যে এগুলো কোথা থেকে এবং কারা জোগাচ্ছে। উচ্চশিক্ষিত সমাজ যদি জাতির মেরুদন্ড হয় তাহলে মেরদন্ডের রূপকর হলো কৃষকরা। প্রতিবছর ধানের মৌসুমে ধানের দাম খুবিই সীমিত ধার্য করা হয় কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে ধানের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যায়। কিন্তু তখন ধানের মালিকানা আর কৃষকদের কাছে থাকে না। কারণ বেশির ভাগ কৃষকই দরিদ্রের কষাঘাতে বা ঋণের বোঝা কমানোর জন্য ধান সংরক্ষণ করতে পারে না। ফলে এই সুযোগটা নেয় একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহল বা কিছু ডিলার। তারপর ইচ্ছামতো ধান বা চালের দাম বাড়িয়ে কৃষকসহ জন-সাধারণের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। সব ধান যখন তাদের হাতে জিম্মি হয়ে যায়, তখন বেড়ে যায় চালের দাম। এটি খুবিই পরিতাপের বিষয় যে, কৃষকদের কাছ থেকে ধান না কিনে, মিল মালিক বা ডিলার নিয়োগের মাধ্যমে চাল কিনছে সরকার। আর এ কারণেই লোকসানের শিকার হচ্ছে কৃষক এবং মুনাফা লুটে নেয় মধ্যস্বত্বভোগীরা। এভাবে লোকসান গুনে ধান চাষ করলে হয়তো একপর্যায়ে কৃষক দেউলিয়া হয়ে যাবে। এভাবে সমাজে ধনী ও গরিবের বৈষম্য ক্রমাগত বেড়েই চলছে। ইতোমধ্যে কৃষকদের মধ্যে কৃষি পেশা ছেড়ে দেয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা অন্য বিভিন্ন পেশার দিকে ধাবিত হচ্ছে। কৃষির প্রতি কৃষকের অনীহাবোধ দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এ অবস্থার ধারাবাহিকতা থাকলে ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়া কি সম্ভব হবে? প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তার ভৌগোলিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। যেমন: চীন মূলত কৃষিপ্রধান দেশ। তারা কৃষি খাতকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে কৃষি ও কৃষকদের যথাযথ মূল্যায়ন ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সারা বিশ্বের মধ্যে আজ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সিঙ্গাপুরের সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতি, থাইল্যান্ড পর্যটননির্ভর অর্থনীতি; তারা সেটির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিশ্চিত করেছে। কিন্তু আমাদের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি হলেও সেটির সুষ্ঠু ব্যবহার আমরা অনেকাংশই নিশ্চিত করতে পারিনি। কৃষকের কষ্টের যথাযথ মূল্যায়ন ছাড়া কৃষিতে উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। অতি আমদানিপ্রবণ না হয়ে দেশীয় কৃষকদের সুযোগ ও উৎসাহ দেয়ার পাশাপাশি ফসলের নায্য দাম নিশ্চিত করতে পারলে দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পেত এবং কৃষি অর্থনীতি শক্তিশালী হতো। যেমন গত দুই বছর ধরে ভারতীয় গরু আমদানি প্রবণতা হ্রাস পাওয়ার ফলে দেশীয় বিভিন্ন খামার গড়ে উঠেছে। যার ফলে খামারিদের উৎসাহ বাড়ার পাশাপাশি অর্থনীতির ভিত মজবুত হচ্ছে। কিন্তু পূর্বে যখন বিপুল পরিমাণ গরু ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছিল; দেশীয় গরুর উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি দেশীয় খামারিরা উৎসাহ হারাচ্ছিল। মোটকথা আমাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ততক্ষণ অসম্ভব যতক্ষণ এই বিদেশি পুঁজির নিগড় আমরা স্বীকার করছি।

এর জন্য সরকারের অধিক তদারকির পাশাপাশি কৃষি মন্ত্রণালয়কে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে। সরকারিভাবে সরাসরি কৃষকদের থেকে ফসল ক্রয় করার সুযোগ সৃষ্টিসহ মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নিয়মিত কৃষকদের সফঙ্গ পরামর্শমূলক দিকনির্দেশনা বা আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। এতে অন্তত কৃষকরা বিরাটাকার ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পাবে।

বাংলাদেশকে '২০২১' সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং '২০৪১' সালের মধ্যে উন্নত আয়ের দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে কৃষিবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করাসহ কৃষির ওপর গুরুত্ব দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। যে কৃষক দেশকে খাদ্য নিরাপত্তা এবং ক্ষুধামুক্ত দেশ উপহার দিয়েছে, সেই কৃষকের আর্থিক নিরাপত্তা বিধানে এগিয়ে আসার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি উদাত্ত আহ্বান করছি। 'কৃষক বাঁচলে বাঁচবে দেশ, তৈরি হবে স্বনির্ভর সোনার বাংলাদেশ'।

মো. আশিকুর রহমান

ঢাকা

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<51093 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1