ঈদকে সামনে রেখে চলছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নিম্নমানের সেমাই তৈরির ব্যবসা। দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডের নামে নকল সেমাই প্যাকেটজাতের ব্যবসাও জমে উঠেছে। ঈদে প্রসাধনের চাহিদা বেড়ে যায় বছরের অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। এই সুযোগে রাজধানীর নকল প্রসাধনী ব্যবসার কুশিলবরাও সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
খাদ্যে ভেজাল মেশানোর প্রবণতা ইদানীং ভয়ঙ্কর ও বহুমাত্রিক আকার ধারণ করেছে বাংলাদেশে। নকল ও ভেজালের অশুভ দৌরাত্ম্যে খাঁটি ও বিশুদ্ধ শব্দ দুটিই এ দেশ থেকে নির্বাসনের পথে। ভেজালমুক্ত খাদ্যসামগ্রী এখন আমাদের দেশে সোনার হরিণের চেয়েও যেন দুর্লভ। মাছ, মাংস, চাল, আটা, তেল, ঘি, ফল-মূল, শাক-সবজি এবং জীবনরক্ষাকারী ওষুধসহ সবকিছুতেই ভেজাল। এমনকি মিনারেল ওয়াটার নামীয় বোতলবন্দি পানিতেও ভেজাল।
ভেজাল এ দেশের অনেক মানুষের কথা ও কাজে। এমনি মানুষের লেভেল লাগানো পশুতুল্য অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা লাভের কূটকৌশল হিসেবে একদিকে ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্যসামগ্রী এবং ওষুধে খাঁটি ও 'বিশুদ্ধ' লেভেল লাগিয়ে আর অন্যদিকে মাছ, মাংস, ফল-ফলাদি ও শাক-সবজিতে মানবজীবন ধ্বংসকারী ফরমালিনজাতীয় বিষাক্ত দ্রব্যসহ নানারকম বিষাক্ত ওষুধ মিশিয়ে প্রতিনিয়ত বিক্রি করছে রাজধানীসহ দেশের সব বিপণি বিতানে। এসব ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ ও বিষাক্ত ওষুধ মেশানো খাদ্যসামগ্রী, মাছ-মাংস, ফল-ফলাদি এবং ভেজাল ওষুধ খেয়ে দেশের মানুষজন নানা দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ক্রমেই অকাল মৃতু্যর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে গোটা দেশের জনস্বাস্থ্যই চরম হুমকির সম্মুখীন।
অথচ এসব অনৈতিকতা প্রতিরোধের যেন কেউ নেই আমাদের দেশে। সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা কদাচিৎ দুই-চারটা দোকানে ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা করলেও পরে হাত গুটিয়ে নেয়। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়। বিপণি বিতানগুলো হয়ে যায় ভেজালের অভয়াশ্রম। তাই তো আমাদের বাজারগুলোতে বিষাক্ত ওষুধ মেশানো ছাড়া ফল এবং মাছ দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। নকল ভেজালের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা যারা উপার্জন করে তাদের সামান্য অর্থদন্ড এবং কারাদন্ড দিয়ে যে সোজা পথে আনা সম্ভব নয়, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই একই অপরাধে ধরা পড়ার ঘটনা তারই প্রমাণ।
চারদিকে কেবল ভেজাল, বিষাক্ত আর মানহীন পণ্যের ছড়াছড়ি। ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে মানবদেহে বাসা বাঁধছে যত অনিরাময়যোগ্য রোগ। এ রোগ থেকে নিরাময়ের জন্য আর যেন কোনো রাস্তাই খোলা নেই। এসব জটিল ও অনিরাময়যোগ্য কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেকেই অকালে মারা যাচ্ছে। এই জটিল রোগ কিংবা অকাল মৃতু্যর জন্য দায়ী কিন্তু মানুষই। এ দেশের একশ্রেণির মানুষের অতি মুনাফা এবং লোভের কারণেই দিনে দিনে আমাদেরও মৃতু্যঝুঁকি বাড়ছে। এদের মধ্যে কোনো মানবিক বোধ নেই। বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিষ্ঠুরতাই কাজ করে।
এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, সরকারের জনস্বাস্থ্য পুষ্টি ইনস্টিটিউটের (আইপিএইচ) ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় দৈনন্দিন খাদ্যদ্রব্যে মারাত্মক রাসায়নিক উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সারা দেশ থেকে সংগৃহীত এই সব ভোগ্যপণ্যে কেমিক্যাল ও কীটনাশকের ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকির সৃষ্টি করছে। ফলে এখন থেকেই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে মানবদেহে রোগ-ব্যাধি আক্রান্তের হার ভবিষ্যতে মারাত্মক আকার ধারণ করবে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, আগামী ২০ বছরের মধ্যে মানুষের মৃতু্যর ৭০ শতাংশ কারণ হবে ভেজালযুক্ত খাদ্য গ্রহণ। এই ধরনের আশঙ্কা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক।
আমরা জানি, বাজারে ৯০ ভাগ মৌসুমী ফলে বিষ। বাজারে সেসব ফল, যেমন আম, জাম, লিচু, কলা, কাঁঠাল, আনারস তরমুজের বেশির ভাগই অপরিপক্ব। এসব কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয়। কেবল মৌসুমী ফলই নয়, ভেজাল গুঁড়া মসলায় সয়লাব রাজধানীর বাজার। গুঁড়া মসলার নামে বিভিন্ন ধরনের দ্রব্য ও রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত মসলা বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। হলুদ গুঁড়ায় প্রকৃত হলুদ নেই। মরিচে নেই আসল মরিচ। কাউন চাল আর ঘাসের বীজে হলুদ রং মেশালে হয় হলুদ আর লাল রং মেশালে হয় মরিচ। এতে কম দামি প্রচুর রাসায়নিক দ্রব্য মিশ্রিত কাপড়ের রংও মেশানো হয়। পচা ও নষ্ট হয়ে যাওয়া কাঁচা মরিচ শুকিয়ে গুঁড়া করেও মিশিয়ে দেয়া হয়। ধুলোবালুর মধ্যে এসব প্যাকেটে ভরে ভুয়া কোম্পানির নামে লেভেল লাগিয়ে বাজারজাত করা হয়। এভাবেই একশ্রেণির অতি লোভী ব্যবসায়ী সাধারণ মানুষকে ঠকাচ্ছে এবং তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। কেবল গুঁড়া মসলাতেই নয়- ভেজাল এখন প্রায় প্রতিটি খাদ্যপণ্যে। এরা শিশুখাদ্যেও ভেজাল মিশাচ্ছে। এরা মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত ফরমালিন মাছসহ নানা খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহার করছে। মাছকে সতেজ রাখার জন্য এবং এর পচন রোধ করতে দীর্ঘদিন থেকেই মাছে ফরমালিন ব্যবহার করছে একশ্রেণির অসৎ ব্যবসায়ী। এমনকি পাটালি গুড়েও কেমিক্যাল মেশানো হয়। সস তৈরি করা হয় বিষাক্ত রং দিয়ে। গাজর, শিম, টমেটো, লেটুস পাতা, ক্যাপসিকাম, কলা, আপেল, আনারস এবং আমসহ বিভিন্ন ফল সবজিতে এসব উচ্চমাত্রার বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার করা হয়।
ঈদে সেমাইয়ের ব্যবহার বেড়ে যায় বিপুলভাবে। এ চাহিদা মেটাতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেও গড়ে ওঠে সেমাই কারখানা। অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে যেসব কারখানায় সেমাই তৈরি হয় তার ৯৫ শতাংশের পরিবেশই অস্বাস্থ্যকর। প্রসাধন ব্যবহার করা হয় রূপচর্চার জন্য। মানুষ এ জন্য কষ্টার্জিত অর্থও ব্যয় করে। কিন্তু সে অর্থে কেনা প্রসাধন যদি ত্বক ও দেহের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনে তবে তা কাম্য হতে পারে না। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি দেশে যে প্রসাধন বিক্রি হয় তার অন্তত এক-চতুর্থাংশই নকল। নকল ভেজালের দৌরাত্ম্য থেকে যারা অভিজাত বিপণি কেন্দ্র থেকে নামিদামি ব্র্যান্ডের প্রসাধন কেনেন তারাও বাদ যান না। আর যারা ফুটপাত থেকে প্রসাধন কেনেন তাদের অবস্থা সহজে অনুমেয়।
নকল ও ভেজাল ওষুধের কারণে জনমনে যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, সেটা থেকে মুক্ত হয়ে জনমনে স্বস্তি আনা সম্ভব না হলে এক ধরনের অবিশ্বাস ও ভীতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। তা ছাড়া জাল টাকা অর্থনৈতিক ক্ষতি বাড়ায়, প্রতারণার খপ্পরে পড়ে মানুষ। কিন্তু নকল ও ভেজাল ওষুধের কারণে মানুষের মৃতু্য অনিবার্য হয়ে যেতে পারে। খাদ্যপণ্যে ভেজাল ও বিষ মিশ্রণ জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকির সৃষ্টি করেছে।
নকল ভেজাল টিকে আছে আইনের নমনীয়তার কারণে কিংবা যথাযথ প্রয়োগের অভাবে। নকল ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিদানই শুধু নয়, তারা যাতে ভবিষ্যতে অপরাধ বৃত্তিতে জড়িত না হয় সে জন্য কঠোর নজরদারিও বাড়াতে হবে। ভেজালের এহেন দৌরাত্ম্যের অবসানে ভেজালবিরোধী অভিযান সারা বছর চালাতে হবে এবং এর কোনো বিকল্প নেই।
আর কে চৌধুরী: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ