শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ঘাটতি বাজেট ও জনস্বার্থ

বাংলাদেশ শ্রম সম্পদে পরিপূর্ণ একটি দেশ। এই দেশের শ্রমসম্পদ কাজে লাগিয়ে ঘাটতি বাজেট পূরণের উদ্যোগ নিলে জাতির জন্য একটি কল্যাণকর পদক্ষেপ হবে- এর ফলে বেকারত্ব কমবে সেই সঙ্গে কমবে সামাজিক অস্থিরতা।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
  ১৯ জুন ২০১৯, ০০:০০

সরকার গত ১৩ জুন, ২০১৯-২০ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট মহান জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছেন। প্রস্তাবিত বাজেটের আকার বিগত অর্থবছরের চাইতে বড়। ব্যয় বরাদ্দ বেড়েছে ১৮ শতাংশ। ২০১৯-২০ আর্থিক বছরের মোট বাজেট ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এই বাজেট পূরণের জন্য যে সব খাত থেকে আয় ধরা হয়েছে সেই সব খাত থেকে আয় আসার পরও মোট ঘাটতি থাকবে ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের এক চতুর্থাংশেরও বেশি। এই বিশাল ঘাটতি নিয়ে চলছে নানা তর্ক-বির্তক। দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলা পর্যায়ে রাজনৈতিক, সামাজকর্মীসহ নানা পেশার মানুষ গণমাধ্যমে পেশকৃত প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর নিজেদের মতামত দিচ্ছেন। ঘাটতির বিষয়টিও চায়ের আড্ডা বা যে কোনো আলোচনায় স্থান পাচ্ছে। তবে মূল বিষয়টি হলো এখনো বাংলাদেশের ৭০ ভাগ মানুষই বাজেট সাক্ষর না। সুতরাং দাম বাড়া বা কমার বিষয়টি ছাড়া দেশের অধিকাংশ মানুষই বাজেটের সুফল-কুফল সম্পর্কে জ্ঞাত নন। সরকারের পেশ করা প্রতিটি বাজেটকেই গণমুখী বাজেট বলা হয়- তবে সাধারণ মানুষ এই বাজেট সম্পর্কে কতটা জানে বা বাজেট করার সময় তাদের মতামতটা নেয়া হয়েছে তা প্রশ্নের বিষয়। আর বাজেটে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের উন্নয়নের কথা না বলায় এই বাজেটকে গণমুখী বাজেট বলা কতটা যৌক্তিক? বাজেট সম্পর্কে এখনো অনেকেই বলে থাকেন দেশের আমলারাই বাজেট তৈরি করেন আর সংসদ সদস্যরা তা হাত তুলে পাস করেন- তাই বাজেট গণমুখী নামের- তবে কার্যত না। বাজেটের গণমুখিতার বিষয়টি কার্যকর করতে হলে বাজেট সম্পর্কে এ দেশের সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে। প্রস্তাবিত বাজেটের ভালোমন্দ দিক নিয়ে ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন মহল থেকে নানা ধরনের অভিমত গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে- তবে এই বাজেটের সুফল সাধারণ মানুষ কতটা ভোগ করতে পারবে এটা প্রশ্নবোধক থেকেই যাবে। প্রস্তাবিত বাজেট সংসদে উপস্থাপনের সময় বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত বাজেটের অর্থবছর শেষে মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়াবে দুই হাজার ডলারের ওপর। প্রস্তাবিত বাজেটে আরো বলা হয়েছে যে, দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার আট শতাংশের ওপর হবে, সুতরাং মাথাপিছু আয় বাড়াটা স্বাভাবিক। তবে কার মাথা পিছু আয় বাড়বে, দেশের উন্নয়নের মহাসড়কের পথ পরিক্রমায় আহরিত লাভ যাদের পকেটে যাবে তারা কিন্তু এ দেশের কৃষক বা সাধারণ মানুষ নন। উন্নয়নের সুফল একটা শ্রেণিই ভোগ করছে বা ভবিষ্যতে করবে; অপরদিকে দেশের সাধারণ মানুষের বাড়বে করের বোঝা। প্রস্তাবিত বাজেটে মোবাইল ফোনের কলরেটের ওপর সম্পূরক কর বাড়ানো হয়েছে। তাই বলা যায়, এই বাজেট গরিব বা সাধারণ কৃষকবান্ধব না। দেশের শতকরা ৬৫ শতাংশ মানুষ সরসারি কৃষির ওপর নির্ভরশীল। ধানের বর্তমান বাজার দর (গ্রামের হাটে) প্রতি মণ সাত শত টাকার নিচে। কৃষক এক কেজি শসার মূল্য পায় মাত্র ছয় থেকে দশ টাকা। অনুরূপভাবে অন্যান্য শাক সব্জি, ফলমুলের গ্রামের হাট-বাজারের বাজার দর। গ্রামের হাট বা বাজারে সাধারণ কৃষক পণ্য বিক্রয় করলে কখনো নায্যমূল্য পায় না। দেশের কৃষিপণ্য উৎপাদনের খরচ হিসাব করে কৃষকের লাভ বের করার সময় দেখা যায় প্রতিটি কৃষি পণ্য উৎপাদনের খরচ আর কৃষকের বিক্রয় লব্ধ অর্থ যোগ-বিয়োগ করলে কৃষকের দিকটা নেগেটিভ সাইনটা হয়। সুতরাং জিডিপি বাড়বে, বাড়বে মাথাপিছু আয়, দেশে বাড়বে নব্য ধনীর সংখ্যা। ধনী হবে একটা শ্রেণির মানুষ, অন্য দিকে দেশের ৬৫ শতাংশ কৃষিনির্ভর মানুষের ভাগ্যের কোনো পরির্বতন হবে না। তাদের ওপর চাপবে নানা ধরনের পরোক্ষ কর। যা খালি চোখে দেখা যাবে না। নতুন ভ্যাট আইন হচ্ছে, এই নতুন ভ্যাট আইনে ভ্যাট আহরণ পদ্ধতিতে রয়েছে নানা ধরনের স্স্ন্যাব এই স্স্ন্যাব কাঠামোর জন্য বাড়বে অনিয়ম। কৃষক বা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের কথা যদি প্রস্তাবিত বাজেটে উলেস্নখ থাকতো তাহলে এই বাজেটেই প্রতিটি ইউনিয়নে ধান ক্রয় কেন্দ্র খোলার প্রস্তাব রাখা হতো। তা ছাড়া পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ইউনিয়ন লেবেলে ফুড ব্যাংক পদ্ধতি বা খাদ্য গুদাম তৈরীর পরিকল্পনা রাখার ব্যবস্থা থাকতো। তাই বলা যায়, এই বাজেট প্রকৃতার্থে গণমুখী বাজেট নয়।

প্রস্তাবিত বাজেট একটি ঘাটতি বাজেট। অর্থনীতির রীতি বা তত্ত্বানুসারে, জাতীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রে ঘাটতি বাজেট নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এবং বেকারত্ব দূর করে। অর্থনীতির তত্ত্বানুসারে বলা হয়, সরকার তার বাজেটের ঘাটতি পূরণ করার লক্ষ্যে নতুন আয়ে ক্ষেত্র সৃষ্টি করার পদক্ষেপ নেয়। অর্থনীতির নিয়মে এই ঘাটতি পূরণের জন্য দেশের অব্যবহৃত সম্পদ ব্যবহার উপযোগী করা হয় এবং তা থেকে নতুন আয়ের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। সরকার যখন এই ঘাটতি পূরণের জন্য অব্যবহৃত সম্পদ ব্যবহার করে এবং নতুন আয়ের পদক্ষেপ নেয়। তখন এই পদক্ষেপের মাধ্যমে নতুন আয় হয় আর এরই পরিপ্রেক্ষিতে নতুন করে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। সাধারণ মানুষের আয় বেড়ে যায়। দেশের বেকারের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পায়। তবে ২০১৯-২০ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি পূরণের জন্য যে পথ অনুসরণ করা হয়েছে তা নতুন কর্ম সংস্থান তৈরি করা তো দূরের কথা বরং কর্মক্ষেত্র আরো সংকোচন হয়ে পড়বে। প্রস্তাবিত বাজেটের ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার ব্যাংক এবং সঞ্চয় পত্রের ওপর নির্ভর করবেন বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে দৈন্যতার কথা সবারই জানা। বাংলাদেশে ব্যাংকিং সেক্টরের বিতরণকৃত ঋণের প্রায় এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা খেলাপি হয়ে আছে। এই চরম সংকটময় ব্যাংকিং ঋণ ব্যবস্থায় যদি সরকার তার ব্যয় ভার বহনের জন্য ব্যাংকিং সেক্টরের কাছ থেকে আবার ঋণ গ্রহণ করে তাহলে খেলাপি ঋণ ব্যবস্থার এই চরম সংকট তো দূর হবেই না বরং নতুন সংকট ডেকে আনবে। প্রস্তাবিত বাজেটে ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঘাটতির ৬৫ শতাংশ পূরণ করা হবে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে আর বাকি ৩৫ শতাংশ পূরণ করা হবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে। সঞ্চয়পত্র এবং ব্যাংক ঋণ উভয় ক্ষেত্রেই সরকারকে সুদ গুণতে হবে। ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেটের ১০.৯ শতাংশ ব্যয় ধরা হয়েছে সরকারের গ্রহণ করা ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য। যা টাকার অংকে দাঁড়ায় প্রায় ৫৭ হাজার কোটি টাকা। প্রতি বছরই দেখা যায় বাজেটের বড় একটি অংশ ঋণের সুদের খাতে ব্যয় হয়ে যায়। এ ধরনের ঘাটতি বাজেটের অর্থের সংস্থান করতে গিয়ে যে ঋণ গ্রহণ করা হয়েছিল তার সুদ পূরণ করা হচ্ছে বাজেটের ব্যয় খাত থেকে- যা একটি অনুৎপাদনশীল খাত। দেশের কৃষি খাতের ব্যয় ধরা হয়েছে মোট বাজেটের ব্যয়ের ৫.৪ শতাংশ, স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় ৪.৯ শতাংশ অন্যদিকে সুদ পরিশোধে এই দুই খাতের মোট বরাদ্দের সমান ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। দেশের স্বাস্থ্য এবং কৃষি দুটোই গুরুত্বপূর্ণ খাত। অথচ দুই খাতের মোট ব্যয় এর সমান অর্থ ব্যয় হয় সুদের খাতে। দেশ উন্নতির দিকে যাচ্ছে বলে অনেকেই নানা কথা বলতে শোনা যায়। যদি প্রকৃতার্থে দেশ সমৃদ্ধির পথে ধাবিত হয়ে থাকে তারপর আবারও কেন সেই ঋণের দিকেই ঝুঁকতে হয়, নতুন কোনো আয়ের পথ সৃষ্টি না করে এভাবে ঋণ গ্রহণ করাটা কতটা যৌক্তিক বা অর্থনীতির জন্য সহায়ক হচ্ছে তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। এ ধরনের ঘাটতি বাজেটে ঋণের বোঝা বাড়বে প্রকৃতার্থে সাধারণ মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হবে না।

ঘাটতি বাজেট পূরণের জন্য সরকারে ঋণগ্রহণ করায় সাধারণ মানুষ আর ব্যাংক থেকে ঋণ পাবে না। ফলে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে না। আর নতুন উদ্যোক্তা না হওয়ার কারণে কাজের নতুন ক্ষেত্র প্রসারিত হবে না এই কারণে বাড়বে বেকারত্ব। অন্য দিকে ক্ষুদ্র বা মাঝারি শিল্প স্থাপন না করে অনেকেই সঞ্চয় পত্র কেনার দিকে ঝুকবেন; কারণ সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগটা হলো ঝুকিবিহীন, সুতরাং, লাভ যাই হোক কেউ আর ঝুঁকি নিয়ে ক্ষুদ্র বা মাঝারি শিল্প গড়ার জন্য উদ্যোগী হবে না ফলে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রটা সংকুচিতই হবে। অন্যদিকে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো দখল করে নেবে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পের বাজার।

বাংলাদেশ শ্রম সম্পদে পরিপূর্ণ একটি দেশ। এই দেশের শ্রমসম্পদ কাজে লাগিয়ে ঘাটতি বাজেট পূরণের উদ্যোগ নিলে জাতির জন্য একটি কল্যাণকর পদক্ষেপ হবে- এর ফলে বেকারত্ব কমবে সেই সঙ্গে কমবে সামাজিক অস্থিরতা।

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<54201 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1