মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বাজেট ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি

বর্তমান সরকার সব সময়ই দরিদ্র-বান্ধব। এই সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের ফলে দেশে দারিদ্র্যের হার অনেক কমেছে। এবারের বাজেটে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় যেসব কল্যাণমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। বাজেট নিয়ে নানা নেতিবাচক কথা বলা হলেও এই বাজেট যে দরিদ্র-বান্ধব ও কল্যাণমুখী তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
ড. আশরাফ আহমেদ
  ২০ জুন ২০১৯, ০০:০০

‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’ শিরোনামে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট পেশ করছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অর্থমন্ত্রীর অসুস্থতায় গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের এ বাজেট উপস্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবারের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় সুবিধাভোগীর সংখ্যা উন্নীত করে সামাজিক সুরক্ষা খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিভিন্ন ভাতা বাড়ানো হচ্ছে, যাকে নিঃসন্দেহে দরিদ্র-বান্ধব বলা যেতে পারে। আশার কথা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মোট ৭৪ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছেÑ যা মোট বাজেটের ১৪.২১ শতাংশ এবং জিডিপির ২.৫৮ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এটি ছিল ৬৪ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা। এই বিপুল অঙ্কের অর্থ বরাদ্দের ফলে সমাজের প্রান্তিক মানুষ বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা পাবে।

অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, বর্তমানে দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশ পরিবারকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নিয়ে এসেছি। আমাদের নির্বাচনী ইশতেহার ’১৮ অঙ্গীকার অনুযায়ী আগামী ৫ বছরে এ খাতে বরাদ্দ দ্বিগুণ করা হবে। অর্থমন্ত্রী আরো বলেছেন, বাংলাদেশের দারিদ্র্য হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, যা এখন দৃশ্যমান। ২০০৫ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪০ শতাংশ ’১৮ সালে তা ২১.৮ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০২৩-২৪ সালের মধ্যে দারিদ্র্য ১২.৩০ এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৪.৫০ নামিয়ে আনার ঘোষণা অনুযায়ী কাজ করছে সরকার। আমরা মনে করি সরকারের এই ইতিবাচক পদক্ষেপ জনকল্যাণমুখি।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে প্রথম বাজেট ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। ওই বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার হলো ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা, যা স্বাধীনতার ৪৮ বছরে বেড়ে হয়েছে ৬৬৬ গুণ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে জনকল্যাণমুখী বাজেট বলে মন্তব্য করেছেন তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি রুমানা হক। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, নির্বাচনী ইশতেহারে যেসব বিষয় ছিল, সেগুলোর জন্য কী কী পদক্ষেপ নেয়া হলো, তা সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ নেই এই বাজেটে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমানের মতে, আগামী পাঁচ বছরের পরিকল্পনা মাথায় রেখেই সরকার বাজেট ঘোষণা করেছে। এই বাজেটের সঙ্গে নির্বাচনী ইশতেহারের মিল রয়েছে। তবে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বাজেট বাস্তবায়ন করা। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর এক সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিনের মতে, এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে নতুন কিছু নেই। এটি একটি গতানুগতিক বাজেট। কেউ কেউ বলেন, এবারের বাজেট বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয় বাড়ানোর বাজেট। আমার তা মনে হয় না।

আশার কথা, গরিব ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সহায়তাসহ সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থাই হলো সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী। বর্তমান বাজেটে সামাজিক নিরাপত্ত বেষ্টনীর আওতায় সাড়ে ৭৪ লাখ মানুষ বিভিন্ন ভাতা পাচ্ছেন। সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র (পিআরএসপি) চৌদ্দটি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চিহ্নিত করেছে। এসব কর্মসূচিতে বাজেটে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী মাসিক ভাতা ১০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে বাজেটে ১২ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ লাখ মুক্তিযোদ্ধা প্রতি মাসে সম্মানী ভাতা হিসেবে ১০ হাজার টাকা করে পাচ্ছেন। এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ হাজার ৬শ’ কোটি টাকা। এ ছাড়া তাদের উৎসব ভাতা হিসেবে ১০ হাজার টাকা, নববর্ষ ভাতা হিসেবে ২ হাজার টাকা এবং বিজয় দিবস ভাতা ৫ হাজার টাকা করে দেয়ার সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে।

বয়স্ক ভাতায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪০ লাখ উপকারভোগী প্রতি মাসে ৫শ টাকা হারে বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন। এ কর্মসূচিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ হাজার ৪শ কোটি টাকা। আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ২৪০ কোটি টাকা বাড়িয়ে রাখা হচ্ছে ২ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। ভাতাভোগীর সংখ্যাও ৪০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৪৪ লাখে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতার বিষয়েও প্রস্তাব করা হয়েছে। বাজেটে বয়স্ক ভাতাভোগীর মতো এ ভাতারও পরিধি ও বরাদ্দ বাড়ছে। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৪ লাখ উপকারভোগী প্রতিমাসে ৫শ’ টাকা হারে বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা পাচ্ছেন। এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮৪০ কোটি টাকা। আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে রাখা হচ্ছে ১ হাজার ২০ কোটি টাকা। ভাতাভোগীর সংখ্যাও ১৪ লাখ থেকে বাড়িয়ে ১৭ লাখে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতার ক্ষেত্রে ভাতাভোগীর সংখ্যা ও বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১০ লাখ উপকারভোগী প্রতি মাসে ৭শ টাকা হারে এ ভাতা পাচ্ছেন। এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮৪০ কোটি টাকা। আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ১ হাজার ৯০ কোটি টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। ভাতাভোগীর সংখ্যাও ১০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ১৫ লাখ ৫৪ হাজারে উন্নীত করারও প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে ভাতার হার প্রতি মাসে ৭শ থেকে বাড়িয়ে ৭৫০ টাকা নির্ধারণ করা হচ্ছে।

প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপবৃত্তি কার্যক্রমে ভাতাভোগীর সংখ্যা ও বরাদ্দ বাড়ানো প্রস্তাব করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৯ অর্থবছরে ৯০ হাজার উপকারভোগী বিভিন্ন স্তরে শিক্ষার্থী বিভিন্ন হারে এ ভাতা পেয়েছেন। এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৮০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে রাখা হচ্ছে ৯৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ভাতাভোগীর সংখ্যাও ৯০ থেকে বাড়িয়ে এক লাখে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে প্যারালাইজড ও জন্মগত হৃদরোগীদের আর্থিক সহায়তা ? আগামী বাজেটে এ কর্মসূচিতে সহায়তাভোগীর সংখ্যা ও বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৫ হাজার উপকারভোগী সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৭৫ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ দ্বিগুণ বাড়িয়ে করা হচ্ছে ১৫০ কোটি টাকা। সহায়তাভোগীর সংখ্যাও দ্বিগুণ করে ৩০ হাজারে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে

চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচিতে উপকারভোগী ও বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪০ হাজার উপকারভোগী জনপ্রতি ৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২০ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে রাখা হচ্ছে ২৫ কোটি টাকা। সহায়তাভোগীর সংখ্যাও বাড়িয়ে ৫০ হাজারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গ্রামীণ দুস্থ মায়েদের মাতৃত্বকালীন ভাতার আওতা ও বরাদ্দ বাড়ছে। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ লাখ উপকারভোগী তিন বছর মেয়াদে প্রতিমাসে ৮শ টাকা হারে ভাতা পাচ্ছেন। ২০১৯-২০ সালে এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে রাখা হচ্ছে ৭৩৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। ভাতাভোগীর সংখ্যাও ৭ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৭ লাখ ৭০ হাজারে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

কর্মজীবী মার সহায়তা তহবিলের আকার ও উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২ লাখ ৫০ হাজার উপকারভোগী তিন বছর মেয়াদে প্রতি মাসে ৮০০ টাকা হারে ভাতা পাচ্ছেন। এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৪০ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে রাখা হচ্ছে ২৬৪ কোটি টাকা। ভাতাভোগীর সংখ্যাও বাড়িয়ে ২ লাখ ৭৫ হাজারে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

ভিজিডি কার্যক্রমে তহবিলের আকার ও উপকারভোগীর সংখ্যা অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে। অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কার্যক্রমে তহবিলের আকার ও উপকারভোগীর সংখ্যা অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৯ লাখ ৬৭ হাজার ৫১ উপকারভোগী দৈনিক ২শ টাকা করে ভাতা পেয়েছেন। এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ১ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা।

খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি কার্যক্রমে তহবিলের আকার ও উপকারভোগীর সংখ্যা অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৫ লাখ উপকারভোগী প্রতি মাসে ৩০ কেজি চাল পেয়েছেন (বছরে ৫ মাস)। এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ২ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ও সুবিধাভোগী একই রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রম ২০১৯-২০ সালে এ খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে রাখা হচ্ছে ৬৭ কোটি ১০ লাখ টাকা। তবে শুধু বেদে জনগোষ্ঠীর ভাতাভোগীর সংখ্যা কমিয়ে ১০ হাজার নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর এ খাতের আওতায় ৭১ হাজার অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে নিয়ে আসা হচ্ছে।

বর্তমান সরকার সব সময়ই দরিদ্র-বান্ধব। এই সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের ফলে দেশে দারিদ্র্যের হার অনেক কমেছে। এবারের বাজেটে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় যেসব কল্যাণমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। বাজেট নিয়ে নানা নেতিবাচক কথা বলা হলেও এই বাজেট যে দরিদ্র-বান্ধব ও কল্যাণমুখী তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

ড. আশরাফ আহমেদ: গবেষক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে