মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বাজেটে শিক্ষা ও কৃষি খাত

প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলহানির মতো আকস্মিক ক্ষতির হাত থেকে কৃষককে বাঁচাতে শস্য বিমা চালু করা হবে বলে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন। এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে যুগোপযোগী। শস্যবিমা করা থাকলে আইলা বা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের ক্ষতি হলে কৃষক তা সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারবে।
অলোক আচার্য
  ২৭ জুন ২০১৯, ০০:০০

বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্ববৃহৎ আকারের ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিবার বাজেট ঘোষণা করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার। এবারের বাজেট আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ২১তম আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের ১৭তম বাজেট। বাজেট একটি দেশের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। বাজেট প্রণয়ন নয় বরং বাজেট বাস্তবায়নই মূল চ্যালেঞ্জ হয় সরকারের জন্য। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই বাজেট ঘোষিত হয়। বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, বাজেট বাস্তবায়ন খুবই কঠিন। কারণ মানুষ ট্যাক্স দিতে চায় না। তিনি অত্যন্ত অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ এবং আমরাও জানি ট্যাক্স আদায় করাটা কঠিন ব্যাপার। প্রায় সময়ই বড় বড় প্রতিষ্ঠানের ট্যাক্স ফাঁকির খবর আমরা পত্রপত্রিকায় দেখতে পাই। অবস্থাটা এমন যে সরকারকে ফাঁকি দিতে পারলেই লাভবান হওয়া যায়। অথচ একজন নাগরিক হিসেবে, সচেতন মানুষ হিসেবে নিজ থেকেই ট্যাক্স দেয়া উচিত বলে মনে করি। বাজেট ঘোষণা হওয়ার আগে থেকেই মিডিয়াসহ সর্বত্র বাজেট নিয়ে আলোচনা হয়। আসছে বাজেট কেমন হবে এবং বিগত বাজেট কেমন ছিল বা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে তা নিয়েই এসব আলোচনা চলে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রথম বাজেট উপস্থাপন করেন। তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭২ সালের ৩০ জুন একই সঙ্গে ১৯৭১-৭২ ও ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘোষণা করেছিলেন। সেই বাজেটের আকার ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। তারপর দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়েছে। বহু উত্থানপতনের ভেতর দিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশ হওয়ার কাতারে দাঁড়িয়ে। সময়ের সঙ্গে যেমন বেড়েছে লোকসংখ্যা, বেড়েছে প্রয়োজন আর সেইসঙ্গে পালস্না দিয়ে বেড়েছে বাজেটের আকার। নতুন অর্থবছরের ৪৮তম বাজেটের আকার ৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। এক কথায় বিশাল এক বাজেট। বাজেটের সঙ্গে দেশের জনগণের জীবনমান ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেশের উন্নয়ন জড়িত। ফলে বাজেট একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাজেটের প্রভাব পড়ে বাজারে। কারণ বাজেটে কোন কোন জিনিসের দাম বাড়বে বা কমবে তা স্থির করা হয় এবং মিডিয়ার কল্যাণে সেসব একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের ক্রেতা ও বিক্রেতারাও পড়ে থাকে। বাজেটের পর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিও আমাদের দেশের একটি সাধারণ ঘটনা। এমনকি দাম বাড়ার কথা শুনেও অনেকে দাম বাড়িয়ে দেন।

ঘোষিত বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৬১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা যা জিডিপির মাত্র ২.১ শতাংশ। গত অর্থবছরে এই বাজেট ছিল ২.০৯ শতাংশ। আগামী বছরের জন্য এই মহাগুরুত্বপূর্ণ খাতে বরাদ্দ বেড়েছে শূন্য ১ শতাংশ। মহাগুরুত্বপূর্ণ বলছি এ কারণে যে, শিক্ষার থেকে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই হয় না বলেই আমার মনে হয়। যতদিন শিক্ষাকে যুগোপযোগী এবং আন্তর্জাতিকমানের করা না যাবে ততদিন দেশ কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাবে না। ফলে এ খাতে বেশি গুরুত্ব দেয়া আবশ্যক। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান বু্যরো (ব্যানবেইস) এর হিসাব বলছে, শিক্ষা খাতে বাংলাদেশ তার জিডিপির যে অংশ ব্যয় করছে তা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিন্ম। প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ এবং আফগানিস্তানও জনগুরুত্বপূর্ণ এ খাতটিতে আরও বেশি অর্থ বরাদ্দ দিয়ে থাকে। বাজেট ঘোষণা হওয়ার আগে থেকেই প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ে শিক্ষকদের বেশ কিছু দাবি দাওয়া ছিল। এর মধ্যে রয়েছে প্রাথমিক শিক্ষকদের গ্রেড বৈষম্য দূরীকরণ, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের এমপিওভুক্তিকরণ। নতুন বাজেটে শিক্ষকদের জন্য সুখবর রয়েছে। পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী, প্রায় তিন হাজার বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির আওতায় আনা হচ্ছে। এ ছাড়াও ইবতেদায়ি মাদ্রাসার সাড়ে ২১ হাজার শিক্ষকও এমপিও পাবেন। এ ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন ও আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ছোয়া দিতে 'ডিজিটাল প্রাথমিক শিক্ষা' শীর্ষক প্রকল্পের ঘোষণা এসেছে। প্রাথমিক শিক্ষা খাতে ২৪ হাজার ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। শিক্ষা খাতে এতসব সুখবর সত্ত্বেও এই মহাজনগুরুত্বপূর্ণ খাতে আরও বেশি বরাদ্দ প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয়। কারণ এই একটা খাত আরও অনেক খাতকে শক্তিশালী করতে পারে। অবশ্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আগামী অর্থবছরে এ খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে। আমরাও আশা করি, এই খাতটি আরও বেশি বরাদ্দ পাক।

কৃষি ক্ষেত্রেও গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকা- যা গত অর্থবছরের চেয়ে ১ হাজার ২৬১ কোটি টাকা বেশি। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। আজ যে বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ তা কৃষি এবং কৃষির সঙ্গে জড়িত মানুষগুলোর জন্য সম্ভবপর হয়েছে। ফলে কৃষির উন্নয়ন করতে প্রয়োজন কৃষকের উন্নয়ন। তা ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আমাদের দেশেও পড়তে শুরু করেছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে কৃষিকে টিকে রাখতে হলে এই খাতে প্রচুর গবেষণা প্রয়োজন। কৃষিকে বিজ্ঞানের ব্যবহার একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে সহজলভ্য করতে হবে। ফসল উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সার, বীজ বা কীটনাশক আরও সহজলভ্য করতে হবে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলহানির মতো আকস্মিক ক্ষতির হাত থেকে কৃষককে বাঁচাতে শস্য বিমা চালু করা হবে বলে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন। এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে যুগোপযোগী। শস্যবিমা করা থাকলে আইলা বা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের ক্ষতি হলে কৃষক তা সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারবে।

এতে আমাদের কৃষকদের স্বার্থ রক্ষা হবে। গ্রাম হবে শহর এ স্স্নোগান সামনে রেখেই বর্তমান সরকার পলস্নী উন্নয়নকে রেখেছে অগ্রাধিকার তালিকায়। গ্রামে শহরের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে শহর থেকে জনস্রোত ঠেকানো সম্ভব হবে। তা ছাড়া ভারসাম্য উন্নয়নে এটি ভূমিকা রাখবে। গ্রামে অবকাঠামো উন্নয়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, গ্রামের হাট- বাজারগুলোকে অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউস হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমে এ উন্নয়ন হবে। এসবের পাশাপাশি সমালোচিত হয়েছে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার তীব্র নিন্দা করে টিআইবি বিষয়টিকে অসাংবিধানিক, বৈষম্যমূলক ও দুর্নীতিবান্ধব বলে অভিহিত করেছে। এটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর শূন্য সহনশীলতার পরিপন্থী বলা হয়েছে। তবে বাজেটে পদ্মা সেতুসহ সাত মেগা প্রকল্পে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়েছে। পদ্মা সেতুর মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দেশের অর্থনীতির চিত্র পাল্টে দিতে পারে। ফলে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীর গতি হলে চলবে না। যত দ্রম্নত সম্ভব এসব বাস্তবায়ন করতে হবে। আগেই বলেছি বাজেটের সফলতা নির্ভর করে বাজেট বাস্তবায়নের ওপর। সেটি কতভাগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে সেটি বিবেচ্য। বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা শক্তিশালী করতে হবে। পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়তো সম্ভব নয়, তবে যত কাছাকাছি বাস্তবায়ন করা যায় ততই বাজেটের সুফল সাধারণ জনগণ ভোগ করবে।

অলোক আচার্য: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<55411 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1