শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

রূপপুর থেকে রামপাল সত্য মিথ্যার যাচাই

নতুনধারা
  ২৭ জুন ২০১৯, ০০:০০

দর্শক নন্দিত এইচবিও মিনি সিরিজ চেরনোবিল শুরু হয় কিরচটভ ইন্সটিটিউটের ডেপুটি পরিচালক ভ্যালেরি লেগাসভের নিজের বক্তব্য রেকর্ডিংয়ের দৃশ্যের মাধ্যমে। টেপরেকর্ডারের সামনে বসে ভ্যালেরি বলতে থাকেন, 'ডযধঃ রং :যব পড়ংঃ ড়ভ ষরবং? ওঃ'ং হড়ঃ :যধঃ বি'ষষ সরংঃধশব :যবস ভড়ৎ :যব :ৎঁঃয. ঞযব ৎবধষ ফধহমবৎ রং :যধঃ রভ বি যবধৎ বহড়ঁময ষরবং, :যবহ বি হড় ষড়হমবৎ ৎবপড়মহরুব :যব :ৎঁঃয ধঃ ধষষ.' আসল বিপদ তখনই আসে, যখন মিথ্যা শুনতে শুনতে আমরা মিথ্যাকেই বিশ্বাস করতে শুরু করি। সত্যকে আর চিনতে পারি না। বেলারুশীয় নোবেলজয়ী লেখিকা স্বেতলানা এলেক্সেভিচের 'ভয়েস ফ্রম চেরনোবিল' উপন্যাস অবলম্বনে, ১৯৮৬ সালে তৎকালীন ইউক্রেনীয় সোভিয়েত সোস্যালিস্ট রিপাবলিকের চেরনোবিলে অবস্থিত পারমাণবিক বিদু্যৎকেন্দ্রে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ দুর্ঘটনার একটি সুনিপুণ চলচ্চিত্রায়ন এই মিনি সিরিজটি। একদম চেরনোবিলে বসবাসরত মানুষজন, যারা জানতই না আসলে কি ঘটেছে- তাদের গল্প, বিজ্ঞানীদের সত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা কিংবা চেরনোবিলের ভয়াবহ পরিণতি ছাড়াও সিরিজটিতে দুর্ঘটনাটির আরও কয়েকটি দৃষ্টিকোণ ফুটে উঠেছে। এমন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিকোণ হলো- রাষ্ট্রীয় একপেশে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, মাঠপর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা, স্বাধীন মত প্রকাশে বাধা। এই ঘটনাগুলো শুধু চেরনোবিল নিউক্লিয়ার ডিজেস্টার নয়, যে কোনো বড় ধরনের ইসু্য সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চেরনোবিল মিনি সিরিজটি শুধু আমাদের পারমাণবিক বিদু্যৎকেন্দ্র নিয়েই ভাবায় না, যে কোনো সমস্যারই বিভিন্ন দিককে তুলে ধরে। প্রথমত, রাষ্ট্রীয় উপরের মহল বা স্থানীয় সরকারের একপেশে সিদ্ধান্ত গ্রহণকে সিরিজটিতে তুলে ধরা হয়েছে, আতঙ্ক বা গুজবের ভয়ে প্রথমেই সরকার চেষ্টা করেছে ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে শহর খালি করে না দেয়া থেকে সঠিক মৃতু্য তালিকা প্রকাশ না করা, সবই ছিল ব্যাপারটাকে ছোট করে দেখানোর প্রচেষ্টা। একটি ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা বা প্রোপাগান্ডা ছড়ানো, শুধু একটি ঘটনার ব্যাপ্তি প্রকাশকেই বাধাগ্রস্ত করে না, ঘটনার কাহিনীকেও বদলে দেয়। তখন সত্য মিথ্যা হয়ে যায়, মিথ্যা হয়ে যায় সত্য। মিথ্যাকেই জোর করে সত্য বানানোর ভয়াবহ পরিণতি বর্ণনা করে লেগাসভের একটি উক্তি। 'ডযবৎব ও ড়হপব ড়িঁষফ ভবধৎ :যব পড়ংঃ ড়ভ :ৎঁঃয, হড়ি ও ড়হষু ধংশ ডযধঃ রং :যব পড়ংঃ ড়ভ ষরবং?' দ্বিতীয়ত, এতবড় দুর্ঘটনাটির পেছনে দুইটি মূল কারণের একটি ছিল মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা। চেরনোবিল দুর্ঘটনার পেছনে রিয়েক্টরের নকশার ত্রম্নটির পাশাপাশি জোর করে চালানো একটি পরীক্ষাও বহুলাংশে দায়ী। জোর করে এই পরীক্ষা চালানোর পেছনে কাজ করেছে, দ্রম্নত কেন্দ্রের পরিচালকের পদোন্নতি এবং তার স্থানে প্রধান প্রকৌশলী নিকোলাই ফমিনের পদায়নের উচ্চাকাঙ্ক্ষা। এই উচ্চাকাঙ্ক্ষাই জোরপূর্বক এই ঝুঁকিপূর্ণ পরীক্ষাটি চালাতে উৎসাহ প্রদান করে। বাংলাদেশে অধুনা রূপপুরের বালিশ কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে এ ধরনের দুর্নীতির উদাহরণের অভাব নেই। চেরনোবিলের বিদু্যৎকেন্দ্রটির পরিচালক এবং প্রকৌশলীরা ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করেনি তাদের লোভ থেকে এতবড় একটা দুর্ঘটনা ঘটবে। তৃতীয়ত, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। চেরনোবিলের ঘটনায় যে শুধু তিনজনের লোভই দায়ী নয়, এর পাশাপাশি রিয়েক্টরেও রয়েছে ত্রম্নটি এই ব্যাপারটি প্রকাশ না করার জন্য সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার চাপ, এবং এই চাপের বিরুদ্ধে কথা বলার ফলস্বরূপ লেগাসভের জীবনের পরিণতি হয় আত্মহত্যা। সাম্প্রতিক সময়ে বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের মতো ঘটনা বাংলাদেশেও ঘটছে। সমালোচিত ৫৭ ধারা মানুষের মুখে টেনে ধরেছে লাগাম, এ ছাড়া বেশ কিছু ঘটনা মানুষকে প্রতিবাদবিমুখ করে তুলেছে। যে কোনো সিদ্ধান্তে সমালোচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, বিশেষত রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক কোনো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে। সে ক্ষেত্রে সমালোচনা করার অধিকার একজন নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার। এবং এ অধিকারচর্চায় সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রেরই লাভ বেশি। চেরনোবিলের দুর্ঘটনা যে সোভিয়েত ইউনিয়নের কফিনের শেষ পেরেক এ কথাটি বহুলাংশেই স্বীকৃত। এতবড় একটা ঘটনা কখনো একদিনে ঘটে না, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতিই একটা রাষ্ট্রকে এমন বিপদের দিকে ঠেলে দেয়। চেরনোবিলের শিক্ষা শুধু রূপপুরে নয়, কাজে লাগাতে হবে রামপাল থেকে শুরু করে যে কোনো বড় ধরনের প্রকল্পেই। নইলে যে কোনো ক্ষুদ্র অব্যবস্থাপনা ঠেলে দিতে পারে মারাত্মক বিপর্যয়ের দিকে। যার ফলাফল অবশ্যই শুভ হবে না। বাংলাদেশ সোভিয়েত রাশিয়া তো দূর, সোভিয়েত ইউক্রেনের চেয়েও ছোট একটি দেশ। এতবড় একটি ঘটনা, যার এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় হিসেবের মৃত ব্যক্তি সংখ্যা মাত্র একত্রিশ, তার ভার বয়ে বেড়াতে হচ্ছে এত বছর ধরে, শুধু ইউক্রেন নয়, পার্শ্ববর্তী দেশ বেলারুশকেও। এমনকি ইউক্রেনের ২০১৮ সালের বাজেটের ৭% বরাদ্দ এই চেরনোবিলের জন্য রাখতে হয়েছে, দুর্ঘটনার এতগুলো বছর পরও। এই ঘটনায় বেলারুশের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২৩৫ ইউএস ডলারের মতন। প্রায় ৭ মিলিয়ন লোককে ঘর ছাড়া হতে হয়েছে, ধ্বংস করতে হয়েছে ১৭ লাখ ১৫ হাজার একর বন ও আবাদি জমি। তেজস্ক্রিয়তা শুধু রিয়েক্টর বিস্ফোরিত হলেই ছড়ায় না। ছড়ায় তেজস্ক্রিয় বর্জ্য থেকেও। তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যে কোনো অব্যবস্থাপনা বা অনিয়ম ঘটাতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা।

যেমনটা ঘটেছিল জাপানের ফুকুশিমায় ২০১১-তে। ২০১৪ সালে নামিবিয়ার ইউরেনিয়াম খনিতে এবং নিউমেক্সিকোর ওয়েস্ট ইনসোলেশন পাইলট পস্ন্যান্টে যে দুর্ঘটনা ঘটে তা কোনো রিঅ্যাক্টরের বিস্ফোরণ নয়, যথাক্রমে একটি ট্যাঙ্ক থেকে চুইয়ে পড়া তেজস্ক্রিয় পদার্থ এবং লিক হয়ে বায়ুবাহিত তেজস্ক্রিয় পদার্থের নিঃসরণ। ভারতে ১৯৭ জন পারমাণবিক স্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন এবং ১৭৩৩ জন বিজ্ঞানী এবং কর্মচারী তেজস্ক্রিয়তাজনিত কারণে মারা গিয়েছেন তাও মাত্র পনের বছরে। কাজেই এধরনের কাজে যে বিন্দুমাত্র অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ নেই সে কথা বলাই বাহুল্য।

সাকিব রহমান সিদ্দিকী শুভ

শিক্ষার্থী

ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<55412 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1