শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ

বঙ্গবন্ধুর প্রদশির্ত পথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুযায়ী সরকার পরিচালনার মাধ্যমে জননেত্রী বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের মযার্দায় উন্নীত করেছেন। আর এটি সম্ভব হচ্ছে, ‘পলিটিক্যাল অডার্র’ বাস্তবায়িত করা তথা বজায় রাখতে পারার সামথের্্যর কারণে। যদিও এর মধ্যে কিছু ব্যত্যয় থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তবে, পলিটিক্যাল অডার্র বজায় রাখতে পারার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলেই কেবল বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিও ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকবে।
ড. অরুণ কুমার গোস্বামী
  ২৪ জুন ২০১৮, ০০:০০
আপডেট  : ২৪ জুন ২০১৮, ২২:৫৭

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আবিভাের্বর সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা ও বিবতর্ন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। ৬৯ বছর বয়সের আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দল। এ দলের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে- কোন অন্তনিির্হত চেতনাকে কেন্দ্র করে বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের মধ্যেকার সম্পৃক্ততা গড়ে (কনস্ট্রাক্ট) উঠেছে বা নিমির্ত হয়েছে? সচরাচর, উপরে উল্লিখিত প্রশ্নের যে সরল উত্তর দেয়া হয়ে থাকে তা হলো, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা’। এটিও একটি ‘কনস্ট্রাকশন’। সবাই তাদের সামনে যা ঘটতে দেখেছেন বা গবেষকরা তাদের অনুসন্ধানের মাধ্যমে যা তুলে এনেছেন, তার ভিত্তিতে এই ‘কনস্ট্রাকশন’ সম্ভব হয়েছে। আসলে সম্প্রতি ‘কনস্ট্রাক্ট’ ‘কনস্ট্রাকশন’ ‘রি-কনস্ট্রাকশন’, ‘ডি-কনস্ট্রাকশন’ শব্দগুলো নিয়ে বেশ কথাবাতার্ হচ্ছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচাযর্, ব্যক্তির জীবনী ‘কনস্ট্রাক্ট’ হওয়া সম্পকের্ একটি তথ্য সেদিন একটি আলোচনা সভায় তুলে ধরেছিলেন। আবার ভিন্ন একটি পরিস্থিতিতে, নিউইয়কর্ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক গবেষক ও শিক্ষক যিনি বতর্মানে প্যারিসের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত আছেন, তিনি অতি সম্প্রতি তার ফেসবুকের স্ট্যাটাসে এই ‘কনস্ট্রাক্ট’ ব্যাপারটি নিয়ে বিভিন্নমুখী প্রশ্নের অবতারণা করছেন। সম্প্রতি তিনি ‘সময়’ এবং ‘সমাজ’-কে ‘কনস্ট্রাক্ট-এর সঙ্গে যুক্ত করে প্রশ্ন করেছেন, ‘সময়’ কী ‘একটি সামাজিক নিমার্ণ বা কনস্ট্রাক্ট’? ইজ ‘টাইম’ ‘অ্যা সোশ্যাল কনস্ট্রাক্ট’? ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামার সূত্রকে ভিত্তি ধরে, বতর্মান লেখার জন্য উপযোগী আর একটি প্রশ্ন হচ্ছে, ‘সময়’ পরিবতের্নর সঙ্গে সঙ্গে ‘চেতনার’ মৌলিকত্ব ঠিক রেখে কী এর অবয়ব পরিবতির্ত হতে পারে? বতর্মান নিবন্ধে, ‘সময়’ পরিবতের্নর সঙ্গে সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্যেকার ভিত্তিমূলে যে ‘চেতনা’, তার ব্যাখ্যা ‘রি-কনস্ট্রাকশন’ করে বিষয়টিকে নতুন এবং পরিবতির্ত আঙ্গিকে ব্যাখ্যার অবকাশ আছে, সে বিষয়ে আলোচনা করা হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের মধ্যেকার অন্তনিির্হত ‘সম্পকর্’ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে যে উপাদান নিয়ে আমরা কথা বলছি তা হচ্ছে ‘পলিটিক্যাল অডার্র’, বা ‘রাজনৈতিক নিয়ম শৃঙ্খলা’। অথার্ৎ শুধু একটি স্বাধীন রাষ্ট্র নয়, ‘রাজনৈতিক নিয়ম শৃঙ্খলা’ বজায় রাখতে সক্ষম এমন একটি স্বাধীন ও কাযর্কর রাষ্ট্র হতে হবে, এমন চিন্তা বঙ্গবন্ধু করতেন। আমাদের যুক্তি ও ব্যাখ্যা হচ্ছে, সেই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হওয়ার পরেই বঙ্গবন্ধু যে চিন্তা করেছিলেন তা একবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা চিন্তা করছেন। এ ক্ষেত্রে আর একটি উদাহরণ দেয়া সঙ্গত হবে। তা হলো- সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমুদ্র আইন প্রণয়ন করেছিলেন। একবিংশ শতাব্দীতে জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র তা গ্রহণ করছেন।

সমসাময়িককালের খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামার সূত্রানুযায়ী বতর্মান নিবন্ধের যুক্তি ও ব্যাখ্যা হচ্ছে, উল্লিখিত সম্পকর্ গড়ে উঠেছে ‘রাজনৈতিক নিয়মশৃঙ্খলা’ বা ‘পলিটিক্যাল অডার্র’ বজায় রাখতে সক্ষম এমন একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়কে কেন্দ্র করে। আর এই প্রত্যয়টি বাস্তবায়নের চিন্তা করেছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন ও কাযর্কর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রাচীনকালের মাৎস্যন্যায়ের বাংলা নয়, মধ্যযুগের আক্রমণকারীদের অভয়ারণ্যের বাংলা নয়, ধমীর্য় উপনিবেশ পাকিস্তানের অন্তভুর্ক্ত সাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাংলা নয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সৃষ্টিকারী বাংলা নয়, ইনডেমনিটি আদেশ দিয়ে ন্যায়বিচারকে বন্ধ করে দেয়ার ব্যবস্থা নয়, জেলখানায় রাজনৈতিক নেতাদের নিমর্মভাবে হত্যা করার ব্যবস্থা নয়, রাতের বেলা কারফিউ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকারী বাংলা নয়, প্রশাসনযন্ত্র ব্যবহার করে নিবার্চন করা ও রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করা নয়, মিছিলের ওপর ট্রাক চালিয়ে দিয়ে মানুষ হত্যাকারী রাজনৈতিক ব্যবস্থা নয়, কিংবা ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে সন্ত্রাসবিরোধী জনসচেতনতাকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার প্রচেষ্টাকারী রাজনৈতিক ব্যবস্থা নয়, রমনার বটমূলে বাংলা নববষর্ উদযাপনের স্থলে গ্রেনেড হামলা করে মানুষ হত্যা নয়, ২০০১-এর নিবার্চনের আগে ও পরে সংখ্যালঘু ও বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ব্যবস্থা নয়, ২০১৪ সালের নিবার্চনের আগে ও পরে আগুন বোমা হামলা করে নিরীহ মানুষ ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করে নয়, প্রতিবেশী রাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলা করার জন্য অস্ত্র প্রশিক্ষাণ ও চালান দেয়ার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রশাসন নয়, কিংবা সাম্প্রদায়িক কমর্কাÐে লিপ্ত ব্যক্তি, সংখ্যালঘুদের জমি-জায়গা দখলে ও তাদের ওপর নিপীড়ন ও নিযার্তনে লিপ্ত ব্যক্তিগোষ্ঠী, জঙ্গি, দুনীির্তবাজ, ভÐ ও প্রতারকদের পৃষ্ঠপোষকতা করে নয়। জনগণের ম্যান্ডেট অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত সরকারের অধীনে ‘পলিটিক্যাল অডার্র’ বাস্তবায়নে সক্ষম রাষ্ট্র ব্যবস্থাই আসল চাওয়া।

পলিটিক্যাল অডার্র বজায় রাখতে সরকারের সামথর্্য অসামথের্্যর বিষয়টিই হচ্ছে মৌলিক বিবেচ্য বিষয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অসারত্ব, রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হবার পরপরই বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, এ (পাকিস্তান) রাষ্ট্র দ্বারা বাঙালিদের মুক্তি অসম্ভব! বাঙালিদের জন্য, এবং বাঙালিদের দ্বারা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর তার জন্য একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যার মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা অজর্ন এবং স্বাধীনতার পরে ‘রাজনৈতিক নিয়মশৃঙ্খলা’ বজায় রাখার সামথর্্যবান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হবে। বঙ্গবন্ধুর চিন্তাই সঠিক ছিল। বঙ্গবন্ধু শুধু চিন্তা করেই থেমে যাননি। তিনি আকাক্সিক্ষত রাজনৈতিক দল গঠনের লক্ষ্যে ব্যাপক সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়েছেন, অনেকের সঙ্গে কথাবাতার্ বলেছেন। এরই একপযাের্য় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার কে এম দাশ লেনস্থ রোজ গাডের্ন নামক বাড়িতে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বয়সে তিনি তখন তরুণ, শেখ মুজিব। তার চেয়ে বেশি বয়সের আবুল হাশিম, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদীর্, শামসুল হক প্রমুখ ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনা, আবেগ অনুভ‚তির সবটুকু জুড়েই ছিল বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশ। আর এই চিন্তার বাহ্যিক প্রকাশ সম্ভব হয়েছে ‘আওয়ামী লীগ’ নামের একটি রাজনৈতিক বাহনের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুর মধ্যে অসাম্প্রদায়িক ‘বাঙালিত্ব’ প্রবলভাবে উপস্থিত ছিল। একারণে ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ শব্দগুলো থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে, করা হয় শুধু আওয়ামী লীগ।

প্রতিশ্রæতি ভঙ্গ করা তথা বাস্তবায়িত না করা ‘পলিটিক্যাল অডার্র’ বাস্তবায়নে অক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে পাকিস্তান। ধমীর্য় উপনিবেশ পাকিস্তানের একটি ঐতিহাসিক এবং করুণ উদাহরণ হচ্ছে লিয়াকত আলী খানের মন্ত্রীসভার মন্ত্রী যোগেন মÐলের পালিয়ে ভারত চলে যাওয়া। নিকটজনদের চেতনা উপেক্ষা করে, পাকিস্তানের জন্য জিন্নাহ্ ও মুসলিম লীগকে সক্রিয়ভাবে সমথর্নকারী যোগেন মÐল মন্ত্রী থাকা অবস্থায় পদত্যাগ না করে পালিয়ে ভারত চলে যাবার পর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের অনুরোধে ১৯৫০ সালের ৮ অক্টোবর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ১৭ পৃষ্ঠার সেই পদত্যাগপত্রের প্রতি ছত্রে ছত্রে যে কাহিনী বণির্ত হয়েছে সেগুলোকে এক কথায় ‘পলিটিক্যাল অডার্র’হীন ব্যথর্ রাষ্ট্র পাকিস্তানের ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে আখ্যায়িত করাই সমীচীন। ব্যথর্ রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ত্রিশ লাখ বাঙালির আত্মত্যাগ, প্রায় সাড়ে তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম এবং কয়েক হাজার ভারতীয় সৈন্যের প্রাণের বিনিময়ে বাঙালিদের জন্য স্বাধীনতার সোনালী সূযর্ ছিনিয়ে আনার মূল লক্ষ্য তাই একটি কাযর্কর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। মূলত একটি কাযর্কর রাষ্ট্র হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে বঙ্গবন্ধু এটি চাইতেন। তার এই চাওয়া সম্পকের্ জানা যায় দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার পরিচালনার দায়িত্বে থাকাকালে বিভিন্ন সভা সমাবেশ তথা জাতীয় সংসদে প্রদত্ত তার বিভিন্ন ভাষণে। তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থ দু’টিতে উল্লিখিত বিষয়গুলো একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে বোঝা যায়, সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব, যেখানে বাঙালিদের প্রতি হিংসা ও বৈষম্যপূণর্ আচরণ এবং প্রতিবেশী ভারত রাষ্ট্রের প্রতি শত্রæতা দ্বারা রাষ্ট্রের অফিসিয়াল বৈধতা স্বীকৃত হয়!!

বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা ও তার লেখা ডায়েরির কথাগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, তিনি চিন্তা করতেন যে ‘পলিটিক্যাল অডার্র’ বাস্তবায়নে সক্ষম একটি কাযর্কর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারলে, তবেই বাঙালিদের রাজনৈতিক, অথৈর্নতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি আনা সম্ভব। ‘রাজনৈতিক নিয়মশৃঙ্খলা’ বা ‘পলিটিক্যাল অডার্র’-এর ধারণাটি আমরা এখন দেখছি ‘দ্য অরিজিনস অব পলিটিক্যাল অডার্র’ শীষর্ক একটি গ্রন্থে। গ্রন্থটি লিখেছেন ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা (২০১১)। স্নায়ু-যুদ্ধোত্তর রাজনৈতিক চিন্তার একজন ‘জায়ান্ট’ বলা হয়ে থাকে ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামাকে। বালির্ন দেয়াল ভাঙার ঐতিহাসিক ক্ষণের কিছু পূবের্ তার যে বই সমগ্র বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল সেই বইটিই হচ্ছে ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত ‘দ্য এন্ড অব হিস্টরি’। পরে এর বেশ কয়েকটি পুনঃমুদ্রন ও সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। শুনেছি, বাংলাদেশেও এই বইটির অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। যা হোক, প্রথম প্রকাশের ১০ বছর পরে ১৯৯৯ সালে এই বইটির একটি সম্প্রসারিত রূপ ‘দ্য এন্ড অব হিস্টরি অ্যান্ড দ্য লাস্ট ম্যান’ প্রকাশিত হয়েছিল। এই বইতে ফুকুইয়ামা যে বিষয়টি তুলে ধরেছেন, তা হলোÑ স্নায়ুযুদ্ধের শেষে একটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা উত্থিত হয়েছে, যেখানে পুরনো স্নায়ুযুদ্ধকালের প্রতিদ্ব›দ্বী মতাদশর্গুলোর মধ্যে সংঘাতের অবসান হয়েছে এবং উদার, পুঁজিবাদী গণতন্ত্র পৃথিবী নামক এই গ্রহে পরিপূণর্ ও অব্যাহত সাফল্য অজর্ন করছে। ফুকুইয়ামার এ বক্তব্যের পাল্টা যুক্তিও আছে। বলা হচ্ছে, মতাদশর্গত দ্ব›দ্ব শেষ এখনো হয় নাই। যা হোক, আমরা ওই দিকে যাচ্ছি না।

স্নায়ুযুদ্ধের পর, ফুকুইয়ামার সূত্রানুযায়ী, বিশ্বে গণতন্ত্র, সমৃদ্ধি, এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অসম বণ্টনের প্রেক্ষিতে তার (ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামার) আর যে একটি ধ্রæপদী গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, সেটি হলোÑ উপরে উল্লিখিত ‘দ্য অরিজিনস অব পলিটিক্যাল অডার্র’। ‘পলিটিক্যাল অডার্র’ ধারণাটি অবশ্য ফুকুইয়ামাই প্রথম আলোচনা করেননি। তার অনেক আগে স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন, ভিন্ন সময়ে, ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, এবং একটু ভিন্ন প্রকৃতিতে, গণতন্ত্র বা অন্য কোনো মতাদশর্ ছাড়াই, ‘পলিটিক্যাল অডার্র’ সম্পকের্ যে বইটি লিখেছিলেন সেটিও একটি ধ্রæপদী গ্রন্থ। বইটির শিরোনাম ‘পলিটিক্যাল অডার্র ইন চেইঞ্জিং সোসাইটিজ’। এটি ১৯৬৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্ব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ব্যাপক পরিবতর্ন হয়েছে, সোভিয়েত ইউনিয়নের অবসান হয়েছে, স্নায়ুযুদ্ধেও অবসান হয়েছে, এসব সত্তে¡ও এই বইয়ের মূল বক্তব্যের আবেদন একটুও মøান হয়নি। বক্তব্যটি হচ্ছে, রাজনৈতিক মতাদশর্ যাই হোক না কেন, উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো যেমন, মাকির্ন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের [বি. দ্র. ১৯৬৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল] সরকার যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা বাস্তবায়িত হয়, কিন্তু পরিবতর্নশীল সমাজে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্পকির্ত বিষয়টি প্রতিনিয়তই বাধার সম্মুখীন হয়ে থাকে।

‘পলিটিকাল অডার্র ইন চেইঞ্জিং সোসাইটজ’ গ্রন্থে হান্টিংটন বলছেন সরকারগুলোর পাথর্ক্য, ‘কোন ধরনের সরকার’ বা ‘সরকারের প্রচলিত শ্রেণি বিভাগের’ মাধ্যমে বোঝা যাবে না; সরকারগুলোর পাথর্ক্য করার মাপকাঠি হচ্ছে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করতে পারার সামথর্্য এবং অসামথর্্য দ্বারা। মতাদশর্ নিবিের্শষে কোনো কোনো সরকার তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারেন। আর কোনো কোনো সরকার আছে যারা তাদের গৃহীত সিদ্ধান্ত তারা বাস্তবায়িত করতে পারেন না। আর ‘পলিটিক্যাল অডার্র’ বাস্তবায়িত হয় না বলেই পরিবতর্নশীল সমাজে ‘অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলতা বা ডিজঅডার্র’ এবং ‘অস্থিতিশীলতা’ লক্ষ্য করা যায়। যা রাষ্ট্রকে অকাযর্কর করে দেয়। অপরদিকে, ‘দ্য অরিজিনস অব পলিটিক্যাল অডার্র’ শীষর্ক গ্রন্থে যে যুক্তির অবতারণা ফুকুইয়ামা করেছেন তা হচ্ছে ‘দ্য এন্ড অব হিস্টরির’ মৌলিক অনুমান, উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিজয়, এই ধারণাটি এখনো বৈধ, তবে স্থিতিশীলতা, অগ্রগতি তথা গণতন্ত্র টিকে থাকার অপরিহাযর্তা জটিলতার আবতের্ আটকে আছে। ফুকুইয়ামা প্রশ্ন করছেন, কেন? এই ‘কেন’ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলছেন, ২০ বছর আগে যেমনটি ছিল, ‘বতর্মানে বিশ্ব তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল হয়ে উঠেছে’। বলছেন, স্বৈরতান্ত্রিক চীন এগিয়ে আসছে, অপরদিকে মাকির্ন যুক্তরাষ্ট্র অতিরিক্ত গণতন্ত্রের দ্বারা আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ফুকুইয়ামা তার সাহসী গ্রন্থ ‘দ্য অরিজিনস অব পলিটিক্যাল অডার্র’-এ এ জটিল সমস্যার জুতসই ব্যাখ্যা অনুসন্ধান করেছেন।

তিনি ইতিহাসের দিকে নজর দিয়েছেন। খ্রিস্টপূবর্ তৃতীয় শতাব্দীর চীনের কিন রাজতন্ত্র থেকে আমেরিকার শুরুর দিকে এবং প্রায় দুই হাজার বছর পর ফরাসি বিপ্লব। এ পথ পরিক্রমায় ফুকুইয়ামা প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, মধ্যযুগের মামলুক, এবং অটোমান সাম্রাজ্য, আফ্রিকার নৃ-তত্ত¡, পাপুয়া নিউ গিনির রাজনীতি, এবং আরও অনেক অনেক কিছু পযাের্লাচনা করেছেন।

এই গবেষণা গ্রন্থটির মূলে যে তাৎপযর্পূণর্ ধারণাটি আছে সেটি হচ্ছে, ‘ডেনমাকর্ হওয়া’ (গেটিং টু ডেনমাকর্)। এর দ্বারা ফুকুইয়ামা স্থিতিশীল, শান্তিপূণর্, সমৃদ্ধ, সবর্সমেত, এবং সৎ সমাজ (ডেনমাকের্র মতো) সৃষ্টির কথা বুঝিয়েছেন। বাংলাদেশও এমন একটি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক এটি এদেশের জনগণের একান্ত আকাক্সক্ষা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেথ মুজিবুর রহমানও এমনই একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আর এটি, নিজস্ব সাবলীল অভিব্যক্তিতে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ও পরে, বহুবার বহু বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে শোনা গিয়েছে। কখনো ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ’ প্রয়োজনের কথা, কখনো বাংলাদেশকে ‘প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্নের কথা বঙ্গবন্ধু বলতেন। কৃষক শ্রমিকদের সম্মান দিয়ে কথা বলার জন্য তিনি শিক্ষিত সমাজের প্রতি আহŸান জানিয়েছেন। দুনীির্তর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সেই যুদ্ধে সবাইকে অংশগ্রহণের আহŸান জানাতেন। বঙ্গবন্ধু যে বাকশাল করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তার মূলে ছিল একবিংশ শতাব্দীতে ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামার ‘পলিটিক্যাল অডার্র’ বাস্তবায়নের যে স্কিম আমরা দেখছিÑ সে ধরনেরই একটি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তোলা। এই লক্ষ্যকে সামনে নিয়েই জীবন ও যৌবনের অধিকাংশ সময় কারা যন্ত্রণাসহ পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের নিযার্তন নিপীড়ন ভোগ করেছেন। বহুবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুর প্রদশির্ত পথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুযায়ী সরকার পরিচালনার মাধ্যমে জননেত্রী বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের মযার্দায় উন্নীত করেছেন। আর এটি সম্ভব হচ্ছে, ‘পলিটিক্যাল অডার্র’ বাস্তবায়িত করা তথা বজায় রাখতে পারার সামথের্্যর কারণে। যদিও এর মধ্যে কিছু ব্যত্যয় থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তবে, পলিটিক্যাল অডার্র বজায় রাখতে পারার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলেই কেবল বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিও ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকবে।

আর এ জন্য আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নিবার্চনে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অজের্নর মাধ্যমে পুনরায় সরকার গঠন করতে হবে। তাই এই সময়ের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হচ্ছে, ধমর্, জন্মস্থান, শ্রেণি-পেশা নিবিের্শষে দেশের সব মানুষের উচিত জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকারের সময়ের পলিটিক্যাল অডার্র বজায় রাখতে পারার ধারাবাহিকতার জন্য একযোগে কাজ করা এবং আগামী নিবার্চনে জয়ী করা। এর বিপরীত হচ্ছে ‘পলিটিক্যাল ডিজঅডার্র’ এবং মাৎস্যন্যায়।

ড. অরুণ কুমার গোস্বামী: চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ এবং পরিচালক, সাউথ এশিয়ান স্টাডি সাকের্ল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে