বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অন্ধকারে আবৃত শুদ্ধ মানসিকতা

বাংলাদেশে যেভাবে নারী-নির্যাতন বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে তা নিয়ন্ত্রণ ও দমন না করলে তার মাত্রা আরও বৃদ্ধি পাবে। সে জন্য দলীয় দিক বা অন্য কোনো প্রভাবের দিকে না তাকিয়ে এখনই সময় এসেছে দেশের সার্বিক অসঙ্গতি দূর করে নারীর সামাজিক অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করা। বাংলাদেশের একজন সৎসাহসী নারী রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো ভূমিকা নিয়ে সামাজিক অসঙ্গতি দূর করতে পারবেন না কেন?
আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ
  ০৪ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

বাংলাদেশে দিন দিন সমাজ-মানসে সার্বিক অবক্ষয় এত দ্রম্নতহারে বৃদ্ধি পেতে চলেছে যে, দেশের কাঠামোগত উন্নতি ঢাকা পড়ে গেছে অপরাধের বদ্ধ জালে। চারদিকে তাকালে শুধু অপরাধের যে চিত্র চোখে পড়ে তা দেখে ও সংবাদপত্র পড়ে মানুষের চিত্ত স্তব্ধ হয়ে যায়। বারেবারে মনে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে এই কী মানুষের সোনার বাংলাদেশ? অবস্থা পর্যালোচনার পর মনে হয়, এ দেশ সোনার দেশ করার মতো সব ধরনের উপকরণ আছে, নেই শুধু স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রশাসন। তার ফলে স্বপ্নের সোনার বাংলা তামার বাংলায় পরিণত হতে চলেছে- আর দেশের মানুষ তা স্বপ্নীল চোখে হতাশ হয়ে পর্যবেক্ষণ করছে।

রাস্তায় ফিটনেসবিহীন, ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া বাসচালক নির্দয়ভাবে পথচারী চাপা দিয়ে হত্যা, বাসের মধ্যে নারীর শ্লীলতাহানি- তারপর নির্দয়ভাবে হত্যা- এটা কী কোনো দেশের সাধারণ চিত্র হিসেবে ধরা যাবে? অবশ্যই 'না'। কিন্তু ওর পাশেই যেসব ঘটনা ঘটছে তাও কী সাধারণ ঘটনা? যারা এসব নৃশংস ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তারা সাহস পায় কোথা থেকে মানুষের সামনে দিনের আলোতে অস্ত্র দিয়ে মানুষ হত্যার?

বরগুনার ঘটনা আবার মানুষের সাধারণ জীবনের ওপর আঘাত করেছে। এখানে কলেজ রোডে স্ত্রীর সামনে স্বামী রিফাতকে কয়েকজন (সন্ত্রাসী বা যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন) অস্ত্র দিয়ে প্রকাশ্যে জনসাধারণের সামনে আক্রমণ করে গুরুতরভাবে আঘাত করার পর রাতে রিফাত মারা যায়। রিফাতের অপরাধ কলেজের একজন সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করা- যার বিয়ে অন্য কয়েকজন পাশবিক শক্তিতে শক্তিশালী তরুণ চাইত না। তাহলে কী সন্ত্রাসীদের মতামত অনুযায়ী নারী-পুরুষের বন্ধন বাঁধতে হবে, ব্যক্তির কোনো মনোভাব থাকবে না? পৃথিবীর কোনো দেশে কী এ ধরনের সামাজিক নিয়ম আছে? আজ অল্পবয়সে রিফাতের স্ত্রী বিধবা শুধুমাত্র রিরংসার জন্য। আর দেশের কাপুরুষ মানুষ? রিফাতকে আক্রমণ করার সময় সেখানে একশ'র মতো মানুষ ছিল, তারা শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সার্কাস দেখার মতো ঘটনা দেখেছে, অপরাধীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে একজন তরুণের জীবনরক্ষা করেনি। অনেকে ফটো তুলেছে, কিন্তু এগিয়ে আসেনি। কয়েকজন মানুষ ইট মেরেই তো অপরাধীদের দমন বা ছত্রভঙ্গ করে দিতে পারত, কিন্তু সে ঘটনাও ঘটেনি। বর্তমানে সরকারের বিশেষ পদক্ষেপে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ চায় সব অপরাধীর গ্রেপ্তার ও দ্রম্নত বিচার।

ফেনীতে নুসরাত জাহানের ঘটনার অল্পদিন পরেই রিফাত হত্যার ঘটনা ঘটলো। নুসরাতকে পড়িয়ে মারার ঘটনাও মানুষের বীভৎস মনের প্রকাশ। মাদ্রাসায় ধর্মশিক্ষা দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের মনে আদর্শ প্রোথিত করা হয়। কিন্তু সেখানে মাদ্রাসার প্রধান একজন ছাত্রীর গায়ে আগুন লাগিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটান- কোনো বিবেকবান, ধর্মপ্রাণ মানুষ এ কথা বিশ্বাস করতে পারেন না। ধর্ম কী নির্মমভাবে একজন নারী হত্যার নির্দেশ দেয় অন্যায়ের বিরোধিতার জন্য। এ ঘটনা মানুষের লজ্জা, সমাজের লজ্জা, দেশের লজ্জা।

কুমিলস্নার তনু, বরগুনার রিফাত, ফেনীর নুসরাত ঘটনার পর সম্প্রতি (৩০শে জুন, দৈনিক ডেইলি স্টার দেখুন) নারীর সম্ভ্রম অবমাননার যে ঘটনা ঘটেছে তা পড়ার পর শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র পৃথিবীর মানুষের চমকে উঠে স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা। এবার নয় মাসের এক শিশুকে ধর্ষণের ঘটনা। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও এই ঘটনা বাস্তব সত্য। ওই নারীশিশু কী শেষ পর্যন্ত বাঁচবে? বাঁচলে ভবিষ্যতে সমাজে তার স্থান হবে কোথায়? এখনই প্রতিবেশীরা সান্ত্বনা ও বিচারে এগিয়ে আসার পরিবর্তে পরিবারকে দোষারোপ করছে, চায়ের দোকানে এ ঘটনা আলোচনা করে সবাই আনন্দ লাভ করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ প্রশাসন এগিয়ে এসে নির্মম ঘটনার বিচার না করলে মানুষের বিবেক শুধু নিভৃতে কাঁদবে।

বাংলাদেশে গুম, ক্রয়ফায়ারিংয়ে হত্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশের বাইরে সমালোচনা হলেও তার চেয়ে অনেক বেশিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে বাসের তলায় পিষ্ট হয়ে মানুষের অঙ্গহানি ও হত্যা এবং দেশের সর্বত্র বিভিন্ন ধরনের নারী নির্যাতন! ব্রিটিশ আমলে নারীদের মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দুজন মহামানব বাঙালি রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এগিয়ে এসেছিলেন সমাজের উন্নাসিকতাকে বিসর্জন দিয়ে। বিদ্যাসাগর একই চীবর পরিধান, অধিকারহীন, বিধিনিষেধের গন্ডিতে অবস্থান বিধবা হিন্দু নারীদের আইন পাস করিয়ে নিয়ে বিধবাদের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার চেয়েও অনেক উঁচু স্তরের কাজ করেছিলেন রামমোহন রায়। ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচার করে গৃহে অবরুদ্ধ হিন্দু নারীদের ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত করে ঘরের বাইরে নিয়ে এসে শিক্ষা-দীক্ষায় আধুনিক করে তুলেছিলেন। আর সতীদাহ নিবারণ রোধ-রামমোহন রায়ের এক ঐশ্বরিক কীর্তি। আগে স্বামীর মৃতু্যর পর মৃত স্বামীর স্ত্রী চিতায় উঠে মরতে না চাইলেও তাদের জোর করে ধরে চিতায় উঠিয়ে স্বামীর সঙ্গে তাদের জ্বলন্ত কাঠের মধ্যে নিক্ষেপ করা হতো। নারীর আর্তচিৎকার যাতে অন্যের কানে না আসে সে জন্য ঢাক-ঢোল বাজানো হতো। রামমোহন রায় এই নিষ্ঠুর প্রথা ব্রিটিশদের দিয়ে আইন করে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তার ফলে সারা ভারতের বিধবা মহিলা তাদের জীবন ফিরে পেয়েছিলেন। আর বিদ্যাসাগর এই বিধবাদের বিয়ের ব্যবস্থা করে সমাজের অন্যায় দেখিয়েছিলেন আঙুল তুলে। চিতায় স্বামীর সঙ্গে জীবন বিসর্জন দিয়ে নারীরা আর 'সতী' হতে চাননি, সতী হয়েছিলেন অন্য পুরুষকে বিয়ে করে অথবা সামাজিক সৎ কাজ করে।

বর্তমান সমাজে রাজা রামমোহন রায় বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নেই, কিন্তু আছে অনেক নারী শক্তি, প্রবক্তা ও সমাজ-সেবিকা- তারা যদি একবার এগিয়ে আসেন তাহলে দেশের অনেক অপশক্তি বিনাশ করা সম্ভব। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে আছেন নারী প্রধানমন্ত্রী। তিনি দেশের কাঠামোগত অনেক উন্নতি করেছেন- ঢাকার রাস্তায় অনেক ফ্লাইওভার হয়েছে, পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল তৈরি হচ্ছে। এসব দেশের বিভিন্ন অবকাঠামো পরিবর্তনে সহায়তা করবে একথা সত্যি। কিন্তু তিনি বিদ্যাসাগর ও রামমোহনের মতো আদর্শ নিয়ে যদি নারী সমাজের অবমাননা কঠিন আইন প্রয়োগে সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে পারেন তাহলে তিনিও রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের মতো চিরদিন বঙ্গবন্ধু কন্যা হিসেবে দেশের ইতিহাসে ও মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকবেন। ফ্লাইওভার হয়তো এক সময় জরাজীর্ণ হয়ে যাবে, সেতুতে ফাটল ধরবে, মেট্রোরেল পুরনো হয়ে যাবে কিন্তু নারীর প্রতি তার এই বৃহৎ অবদান ও আদর্শ কোনোদিন একটা আঁচড়ও লাগবে না।

দেশের সামাজিক পরিস্থিতি ও নারী সমাজ যে অবস্থায় আছে তার পরিবর্তন কোনো ক্রমেই অসম্ভব বলে মনে করা উচিত নয়। এ দেশের নারী সমাজ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সব ক্ষেত্রেই অনেক এগিয়ে গেছে। কিন্তু এসব নারী উচ্চশিক্ষিত ও ভদ্র সমাজের সন্তান। এর পাশেই অবস্থান করছে বিস্তৃত নারী সমাজ, যারা শিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত ও সাধারণ পরিবারের সন্তান। সমাজের একশ্রেণির অশিক্ষিত বা অর্ধ-শিক্ষিত মানুষই সাধারণ সমাজের নারীদের ওপর আঘাত করে। কারণ, এই শ্রেণির নারীদের সামাজিক প্রভাব অথবা অর্থের বৈভব নেই। এই কারণে, সরকার পক্ষীয় অথবা সরকার সমর্থনের নাম ভাঙিয়ে শহর, বিশেষত, গ্রামের ক্ষমতাধর ব্যক্তি অথবা তাদের সন্তান ও আত্মীয়রা নারীদের অসম্ভ্রম করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা ও ভয় করে না। পুলিশ প্রশাসনও আক্রমণকারীদের সামাজিক প্রভাব বা অন্য কারণে এসব ক্ষেত্রে নিশ্চুপ থাকার কারণে দিন দিন অত্যাচার বেড়ে যায় কিন্তু দু-একটা ক্ষেত্র ছাড়া নিয়ন্ত্রিত হয় না। অত্যাচারিতা নারীর পরিবারও ভয়-ভীতি ও নিজেদের ক্ষতির দিক চিন্তা করে সত্য গোপন করতে বাধ্য হয়। দরিদ্র ও অসহায় সমাজের এটাই প্রকৃত চিত্র।

বাংলাদেশে যেভাবে নারী-নির্যাতন বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে তা নিয়ন্ত্রণ ও দমন না করলে তার মাত্রা আরও বৃদ্ধি পাবে। সে জন্য দলীয় দিক বা অন্য কোনো প্রভাবের দিকে না তাকিয়ে এখনই সময় এসেছে দেশের সার্বিক অসঙ্গতি দূর করে নারীর সামাজিক অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করা। বাংলাদেশের একজন সৎসাহসী নারী রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো ভূমিকা নিয়ে সামাজিক অসঙ্গতি দূর করতে পারবেন না কেন?

ড. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ: কথাসাহিত্যিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<56558 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1