বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ধর্ষণ-যৌন নির্যাতন বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ জরুরি

ধনী-দরিদ্র, ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে নারীর মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটা শুধু রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সম্ভব নয়। এজন্য সামাজিক শক্তিগুলোকেও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ধর্ষণের প্রতি জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে শুধু সরকারকে নয়, গোটা সমাজকে। ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংস আচরণের বিরুদ্ধে ব্যক্তি, পরিবার, পাড়া-মহলস্নাসহ গোটা সমাজকে সোচ্চার হতে হবে।
অ্যাডভোকেট শেখ সালাহ্‌উদ্দিন আহমেদ
  ০৯ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

ধর্ষণের মহোৎসব চলছে। শিশু থেকে বয়স্ক নারী পর্যন্ত কেউই পশুরূপী মানুষের ধর্ষণের কবল থেকে রেহাই পাচ্ছে না। নগর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত কোথাও না কোথাও প্রায় প্রতিদিনই ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধিতে মানুষের নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের বিষয়টিই যে সামনে এসে পড়ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সমাজে যখন শাসন-বারণের শৈথিল্য, মূল্যবোধের ক্ষয়িষ্ণুতা বৃদ্ধি পায় এবং আইনের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন নানা নেতিবাচক দিক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। নিপীড়ন, নির্যাতন, বিচারহীনতা, খুন, ধর্ষণ, মান্যগণ্যহীনতা দেখা দেয়। দুর্বৃত্তের আস্ফালন বৃদ্ধি এবং সমাজ কাঠামো ভেঙে পড়ে। সময়ের সঙ্গে জীবনযাপন এবং আচার-আচরণের পরিবর্তন হওয়া স্বাভাবিক, তবে তা সমাজের মূল ছকের মধ্যে থেকেই হওয়া বাঞ্ছনীয়। আমাদের পরিবার ও সমাজের যে হাজার বছরের মূল্যবোধ, তা সারা বিশ্বেই প্রশংসিত এবং অনুকরণীয়।

দুঃখের বিষয়, যতই দিন যাচ্ছে তার পরিবর্তন নেতিবাচক দিকে ধাবিত হচ্ছে। পারস্পরিক সম্মানবোধ লোপ পাচ্ছে। ধর্ষণ এবং খুনের মতো ছৃশংস ও বর্বর ঘটনা বৃদ্ধি তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এসব ঘটনার সঙ্গে প্রধানত নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত প্রভাবশালী চক্র জড়িয়ে আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এরাই সমাজের চালক হয়ে আছে। অপরাধমূলক ঘটনার শিকার ব্যক্তি ঘটনার প্রতিকার চাইতে গেলে উল্টো হয়রানির শিকার হচ্ছে। একজন ধর্ষিতার ক্ষেত্রে প্রতিকার পাওয়ার বিষয়টি আরও বেশি অবমাননাকর এবং কঠিন। এমনও দেখা গেছে, ধর্ষণকারীর বিচারের পরিবর্তে ধর্ষিতাকে বিচার এবং নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এটা সম্ভব হচ্ছে, সমাজের সুকুমারবৃত্তিসম্পন্ন বিবেকবানদের নীরবতা এবং ঘটনা এড়িয়ে যাওয়ার কারণে। তারা তাদের নিজ দায়িত্ব এবং প্রভাব সম্পর্কে উদাসীন। এ ধরনের মানসিকতার কারণে অপরাধী প্রশ্রয় পেয়ে আরও দোর্দন্ড প্রতাপশালী হয়ে উঠছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে ৬৩০ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এ সময় ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩৭ নারীকে। গত ছয় মাসে যৌন হয়রানি ও সহিংসতা, ধর্ষণ ও হত্যা, পারিবারিক নির্যাতন, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, গৃহকর্মী নির্যাতন, এসিড নিক্ষেপসহ নারী নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। এ সময় ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছে সাতজন। এ ছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে ১০৫ নারীর ওপর। গত ছয় মাসে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১২৭ নারী। এর মধ্যে যৌন হয়রানির কারণে ৮ জন আত্মহত্যা করেছেন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৩ নারী ও ২ পুরুষ নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া হয়রানি ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন ১২৪ নারী-পুরুষ।

এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যাগত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে আসক বলেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক হেফাজতে/'ক্রসফায়ারে' মোট ২০৪ জন মারা গেছেন। এর মধ্যের্ যাবের ক্রসফায়ারে ৫৯, পুলিশের 'ক্রসফায়ারে' ৯২, ডিবি পুলিশের 'ক্রসফায়ারে' ১২, বিজিবির 'ক্রসফায়ারে' ২৮ জন নিহত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে শিশুদের হত্যা এবং নির্যাতনের সংখ্যা আশঙ্কাজনক। গত ছয় মাসে ৮৯৫ শিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১০৪ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে, ৪০ শিশু আত্মহত্যা করেছে, নিখোঁজের পর এক শিশু এবং বিভিন্ন সময়ে ১৭ শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া রহস্যজনকভাবে মৃতু্য হয়েছে ৪১ শিশুর। এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন মোট ১১ নারী। ধর্ষণকে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার অবকাশ নেই। পত্রপত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায়, প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণ, গণধর্ষণসহ জোরপূর্বক বিয়ের ঘটনা ঘটছে। আর ঘটনাটি এসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষিতাকে হত্যা করা হচ্ছে নির্মমভাবে। অথবা ধর্ষিতা পরিবার সমাজ ও লোকলজ্জার ভয়ে আত্মহত্যা করছে। তদুপরি তথাকথিত ফতোয়া বা সামাজিক বিচারের রায়ে ধর্ষকের পরিবর্তে শাস্তি দেয়া হচ্ছে ধর্ষিতাকে। উৎপীড়িত পরিবারটিকে করা হচ্ছে একঘরে। কোথাও যদি ধর্ষকের শাস্তি হয়ও, তবে তা নামমাত্র। অথচ অসহায় ধর্ষিত মেয়েটিকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হয় কলঙ্কের বোঝা। আরও যা ট্র্যাজেডি তা হলো ধর্ষণ, নিপীড়ন, যৌন নির্যাতন ও নিগ্রহের ঘটনা অনেক সময় আসে না গণমাধ্যমে। পরিবারের মান-সম্মান, মেয়েটির সম্ভ্রম, সামাজিকতা ও লোকলজ্জার ভয়ে চেপে যাওয়া হয় অথবা দেয়া হয় ধামাচাপা। সার্বিকভাবে বেড়েছে নারী নির্যাতন-নিপীড়ন, জোরপূর্বক বিয়ে, আত্মহত্যায় প্ররোচনা দান এমনকি যৌতুক না পেয়ে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর জিহ্বা ও পায়ের রগ কেটে দেয়ার মতো ঘটনা। অবশ্য নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ইত্যাদি প্রতিরোধে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্নসহ দেশে কঠিন আইন রয়েছে।

তবে দুঃখের বিষয়, বিস্তৃত পরিসরে এর প্রয়োগ সীমিত ও সীমাবদ্ধ। অবশ্য এর জন্য নিম্ন আদালতসহ থানা-পুলিশও কম দায়ী নয় কোনো অংশে। সেখানে ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ আছে বিস্তর। বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীর অভিগম্যতা সীমিত। আর সে জন্য শুধু আইন থাকলেই হবে না, এর পাশাপাশি সর্বত্র স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নারী-পুরুষের সমান অধিকারের বিষয়টি সমাজে এখনো অগ্রহণযোগ্য। সে অবস্থায় সহিংসতার শিকার নারীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তির প্রক্রিয়ায় অভিগম্যতা বাড়ানো না গেলে সেটার বাস্তবায়ন কঠিন। সরকার ও আদালত সে ক্ষেত্রে নারীর ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানে আন্তরিক ও সচেষ্ট হবে বলেই প্রত্যাশা। ধর্ষণ, যৌন নির্যাতনসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা বন্ধ করার জন্য কঠোর আইন যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সেই আইনের যথাযথ প্রয়োগ। ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের খবর যত বেশি পাওয়া যায়, এসব অপরাধের দায়ে অপরাধীদের শাস্তির দৃষ্টান্ত তার চেয়ে অনেক কম। অপরাধ করে পার পাওয়া যায়- এ ধরনের বিশ্বাস থেকে অপরাধীরা অপরাধকর্মে লিপ্ত হয়। এটা শুধু পেশাদার অপরাধীদের ক্ষেত্রে নয়, যে কোনো সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। তাই ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংস অপরাধের রাশ টেনে ধরার জন্য প্রথম কর্তব্য এসব অপরাধের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগে গতি সঞ্চার করা। অপরাধ সংঘটনের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে হবে। একটার পর একটা ধর্ষণের খবরের সমান্তরালে যদি একটার পর একটা শাস্তির খবরও নিশ্চিত করা যায়, তাহলে ধর্ষণপ্রবণতা হ্রাস পাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। সে জন্য উলিস্নখিত প্রতিটি ঘটনার তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের উদ্যোগ নেয়া একান্ত প্রয়োজন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না পেলে অপরাধীদের অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ থেকে যায়। ফলে সব ধরনের অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই সুশাসন তথা আইনের শাসন মজবুত করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। তবে ঐতিহ্যগতভাবে পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে নারীর সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে শুধু আইনের শাসনই যথেষ্ট নয়, সামাজিক শক্তিরও প্রবল সমর্থন প্রয়োজন।

\হধনী-দরিদ্র, ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে নারীর মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এটা শুধু রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সম্ভব নয়। এজন্য সামাজিক শক্তিগুলোকেও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ধর্ষণের প্রতি জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে শুধু সরকারকে নয়, গোটা সমাজকে। ধর্ষণসহ নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংস আচরণের বিরুদ্ধে ব্যক্তি, পরিবার, পাড়া-মহলস্নাসহ গোটা সমাজকে সোচ্চার হতে হবে।

অ্যাডভোকেট শেখ সালাহ্‌উদ্দিন আহমেদ: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সভাপতি, সাউথ এশিয়ান ল' ইয়ার্স ফোরাম

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<57323 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1