বর্তমান আমরা যে সমাজে বাস করছি সে সমাজে এতটাই অবক্ষয় শুরু হয়েছে যে, তা রোধ করতে না পারলে সমাজ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। হত্যা, খুন, ধর্ষণ যেন থামছে না। এখানে কারও জীবনের যেমন কোনো নিরাপত্তা নেই তেমনি মান-সম্মান-ইজ্জত নিয়ে বেঁচে থাকাও কঠিন হয়ে পড়েছে। নারীরা কোনো না কোনোভাবে প্রতিদিন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। পরিবার থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র। একজন মানুষকে এ তিনটি স্তরে জীবনযাপন করতে হয়। তাই আমাদের সমাজ রাষ্ট্র যদি সুন্দর সুস্থ সংস্কৃতির পরিবর্তে অসুস্থ সংস্কৃতি, বিকৃত কুরুচিসম্পন্ন মানুষের দখলে যায় তাহলে বেড়ে ওঠা তরুণ প্রজন্ম এ সমাজ থেকে কি শিখবে?
নারীরা আমাদের সমাজের একটি বৃহৎ অংশ। নারীকে বাদ দিয়ে কোনো সমাজ যেমন সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে না, তেমনি একজন নারীর প্রধান সম্পদ তার সম্ভ্রম। অথচ এ নারীরা প্রতিদিন যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। কেউ শারীরিক কেউ মানসিকভাবে। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না হওয়ায় প্রতিনিয়ত নারীরা বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছে। সমাজে এক শ্রেণির বখাটে যুবক আছে তারা পথে-ঘাটে নারীকে দেখলেই ফিস ফিস করে। স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের দেখলে তারা বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে। আবার কখনো কখনো নারীকে দেখলেই তারা বিভিন্ন কুরুচি, অশালীন মন্তব্য করে। এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি অভিভাক, শিক্ষক, মাও নিহত হয়েছে এটা সবার জানা। আমাদের সমাজে বখাটে যুবকদের উৎপাত বেড়ে গেছে। তারা মনে করে আমরা তো সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করছি। আমরা কারও ডরাই না। এরকম এক ধরনের একপেশে চিন্তা-ভাবনা থেকে তারা ক্রমান্বয়ে এতটা নিচে নেমে গেছে যাতে তারা নৈতিকতাহীন হয়ে পড়েছে। তাই দেখা যায় পছন্দের কোনো মেয়েকে পাওয়ার জন্য মেয়ের অমতে মেয়েটিকে প্রেম নিবেদন করে ব্যর্থ হলে কতগুলো বন্ধু মিলে বা কখনো সুযোগ পেলে একাই জোরপূর্বক মেয়েটির পাশবিক নির্যাতন চালায়। আবার এও দেখা গেছে, এসিড নিক্ষেপ করে মেয়েটির মুখখানি ঝলসে দিয়েছে। সামাজিক অবক্ষয়ের এ যুগে নতুন প্রজন্মরা এরই মধ্যেই বেড়ে উঠছে। তাদের সামনেই ঘটে যাচ্ছে এসব ঘটনা।
একটি সমাজ শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকে, শিক্ষার প্রসার লাভ করলেই বা শিল্প স্বার্থ্যের উন্নতি হলেই সব ঠিক আছে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে এগুলো একটি দেশের অগ্রগতি, সমৃদ্ধির পরিচয় বহন করে। প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে সমাজে বসবাসরত মানুষের মধ্যে মানবিক চেতনা জাগ্রত হয়েছে কিনা, সামাজিক মূল্যবোধ শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে কিনা, সমাজের বখাটেদের উৎপাত বন্ধসহ সর্বোপরি মানবিক বোধসম্পন্ন সমাজ গড়ে উঠেছে কিনা এদিকগুলো অবশ্যই ভাবার বিষয়। কেন না এগুলোই সাধারণত একটি সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যায়, সমাজ কাঠামোকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করায়। আজ স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও আমাদের সমাজ কাঠামোর পরিবর্তন হয়নি। ভঙ্গুর অবসাদগ্রস্ত এক সমাজে আমরা বাস করছি। তাই আমাদের সমাজ কতটা এগিয়েছে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের চোখে সামাজিক অবক্ষয়ের এক ভয়াবহ চিত্রই ভেসে ওঠে। এ চিত্র হতাশার, এ চিত্র আশঙ্কার, কারণ সামাজিক অবক্ষয় দিনে দিনে চরম আকার ধারণ করেছে। হেন কোনো অপরাধ নেই যে, সমাজে ঘটছে না। স্ত্রী স্বামীকে, স্বামী স্ত্রীকে, পিতা-মাতা নিজ সন্তান, সন্তান পিতামাতাকে, ভাই ভাইকে প্রেমিক প্রেমিকাকে অবলীলায় হত্যা করছে। অন্যদিকে নারী নির্যাতন বেড়েই চলেছে। যৌতুক, এসিড নিক্ষেপ, বখাটেদের উৎপাতে স্কুল-কলেজগামী নারীরা আজ হত্যার শিকার হচ্ছে। কখনো কুপ্রস্তাব বা প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় চড়াও হয় নারীর ওপর। আবার কখনো কখনো অশোভন আচরণ থেকে রক্ষা পেতে অনেক নারী আত্মহত্যার পথও বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এসব ঘটনায় স্বজন হারানোদের আর্তনাদ আমাদের ব্যথিত করে। সুস্থ চিন্তা ও শুভ বুদ্ধির বিপরীতে দিনে দিনে আমাদের সমাজটা ক্রমেই অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে। আসলে আমরা যে সমাজে বাস করছি সে সমাজ আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। যে রাষ্ট্রে বাস করছি সে রাষ্ট্র আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। যার বড় প্রমাণ প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে নানা ধরনের অঘটন। তবে এসব অঘটনগুলো সামাজিক অবক্ষয়ের এক নির্মম চিত্র।
এক সময় যাযাবর জীবনের অবসান ঘটে এবং সভ্যতার জগতে মানুষ প্রবশে করে। মানুষ আস্তে আস্তে সভ্যতার পাঠ শিখতে শুরু করে। আমাদের পূর্বপুরুষরাও এক উন্নত সভ্যতার সংস্পর্শে থেকেও ভালো দিকগুলো গ্রহণ না করে মন্দ দিকগুলো গ্রহণ করে। এ পৃথিবীর প্রতিটি বস্তুর ভালো-মন্দ দুটি দিক রয়েছে। লোভ-লালসা মানুষকে মন্দের দিকে ঠেলে দেয়। হিংস্র দানবে পরিণত করে। সভ্যতার ভালো দিকগুলো মানুষকে পরিশুদ্ধ করে, স্বচ্ছ করে, মহৎ করে মানবীয় গুণের অধিকারী করে গড়ে তোলে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের অধিকাংশই এখনো প্রকৃতপক্ষে সভ্য হয়নি। যার কারণে আমাদের সমাজে নানা ধরনের অরাজগতা বিশৃঙ্খলা বিভিন্ন ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। লোভ, ব্যক্তিগত স্বার্থের কাছে মানুষের জীবন আজ অতি তুচ্ছ। এগুলো মনূষ্যত্বের জাগরণে বাধাসৃষ্টি করে মানুষকে দানব করে। সে মানুষরূপী দানবের হাত থেকে আজ শিশু নারী, শিক্ষার্থী, গৃহকর্মী কেউ নিরাপদ নয়। তাই আজ নারী ও শিশু নানাভাবে নির্যাতনের শিক্ষার হচ্ছে। অতি সামান্য বা তুচ্ছ ঘটনায় শিশুদের জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে। অথচ সবার আগে শিশুদের নিরাপত্তা প্রয়োজন। কিন্তু সে শিশুরা আজ ঘরে বাইরে কোথাও নিরাপদ নয়। হত্যা, খুন, ধর্ষণ, অপহরণসহ বিভিন্ন ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। পৃথিবীর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা বৃদ্ধির বিপরীতে এক ধরনের কুরুচি বিকৃত মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। আর এটা বেশির ভাগ দেখা যাচ্ছে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে। নৈতিক শিক্ষার অভাব, বেকারত্ব, হতাশা, তরুণ সমাজের ভিতর প্রবেশ করেছে নানা ধরনের অপরাধপ্রবণতা। তাদের মন-মানসিকতা এমনভাবে গড়ে উঠেছে কোনো কিছুই অপ্রাপ্তিতে তারা বিশ্বাসী নয়। অর্থাৎ তাদের বদ্ধমূল ধারণা ও অন্ধ বিশ্বাস তাদের মনে এমনভাবে দানা বেঁধেছে যে, তাদের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে গিয়ে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। বখাটে, উচ্ছৃঙ্খল অবসাদ, বিকারগ্রস্ত এক শ্রেণির তরুণ আছে যাদের প্রস্তাবে রাজি না হলে নারীর ওপর নেমে আসে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন।
সম্প্রতি ফেনীর নুসরাত অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাকে আগুনে পুড়িয়ে মারা। কী নির্মম, নিষ্ঠুর নৃশংস বর্বরতা রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করা। আর এসব ঘটনা ঘটছে প্রকাশ্য দিবালোকে, নতুন প্রজন্মের সামনে। তবে কি নতুন প্রজন্ম তলিয়ে যাবে প্রলয়ের অন্ধকারে? সমাজের এ ভয়াবহ চিত্র দেখতে দেখতে তারা বড় হচ্ছে। তারা এই দুঃসহ চিত্র ভুলে যাবে কীভাবে? সামাজিক অবক্ষয়ের নানাদিক তাদের কোমল হৃদয়ে রেখাপাত করবে এবং এক ধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দিতে পারে যা সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার কেউ চায় না। বর্তমান সমাজে খুন, ধর্ষণ, হত্যা বন্ধও নারীসমাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে দেশের উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হবে। কারণ নারীরা আজ দেশের উন্নয়নে বিভিন্নভাবে অবদান রাখছে। একজন নারীকে শুধু নারী না ভেবে মানুষ ভাবা উচিত। এ দেশে আশাতীতভাবে নারী শিক্ষার প্রসার ঘটেছে। অথচ তারাই বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তাদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। নারীর প্রতি যারা সহিংস হয়ে ওঠে তারা বিক্রিত মানসিকতা থেকে। যে পরিবেশে সে বেড়ে উঠেছে এমনকি যে পরিবারে বেড়ে উঠেছে সে পরিবেশে বা পারিপার্শ্বে সহিংসতা রয়েছে। তাই সবার আগে নিজ নিজ পরিবারকে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগাতে হবে। কারণ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় যা দিতে পারে না পরিবার সেটা দিতে পারে। পরিবারই হচ্ছে প্রাচীনতম সংগঠন এবং নৈতিক শিক্ষার আঁতুড়ঘর। সে আঁতুড়ঘর আজ বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। মোটা দাগে বলতে গেলে আমাদের গোটা সমাজব্যবস্থাকে আরও মানবিক করে তুলতে পারলে সামাজিক, শৃঙ্খলা আরও সুদৃঢ় হবে। তাই নতুন ও অনাগত প্রজন্মকে রক্ষা করতে হবে। তাদের কোমল হৃদয় ও মানস পটে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা যেন ভবিষ্যতে রেখাপাত করতে না পারে। এজন্য একটি সুন্দর, সুস্থ সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই।
আমরা বলে থাকি নতুন প্রজন্ম আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কিন্তু নতুন প্রজন্ম আজ কোন পরিবেশে বেড়ে উঠছে। নতুন প্রজন্মের জন্য যদি সুন্দর, সুস্থ, সামাজিক পরিবেশ গড়ে তোলা না যায় তাহলে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে। সামাজিক অবক্ষয়ের ভয়াবহ চিত্র দেখতে দেখতে তারা বেড়ে উঠবে। তাদের সামনে ঘটে যাচ্ছে, যাবে খুন, যখম, ধর্ষণ, নারী নির্যাতনসহ নানা ধরনের সামাজিক অবক্ষয়। তাদের কোমল মনে কি দাগ কাটবে না? সারাটি জীবন তাদের তাড়িত করবে এ ভয়াবহ স্মৃতি। শুধু নারী নির্যাতনের ঘটনায় নয়, মদ, গাঁজা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন নেশাদ্রব্য পান করে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে আজকের তরুণসমাজ। বেকারত্ব অভাব, অনটন, নৈতিক শিক্ষাবোধের অভাব, সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দিন দিন আমাদের সমাজ এক অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, বাড়ছে অপরাধ। ফলে নারী নির্যাতন, যৌন হয়নারি, ধর্ষণ, নিপীড়নসহ নানা ধরনের ঘটনা ঘটছে। কোনো সমাজে শৃঙ্খলা না থাকলে বিভিন্ন ভয়াবহ ঘটনা ঘটবে এটাই স্বাভাবিক, সামাজিক অবক্ষয় দেখা দেবে। তবে সম্প্রতি ফেনীর সোনাগাজীর নুসরাত জাহান রাফিকে এক মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও তার সহযোগীরা আগুনে পুড়িয়ে হত্যা ও বরগুনার রিফাত নামে এক যুবককে প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা এ দুটি মর্মস্পর্শী ঘটনা আমাদের নতুন প্রজন্মের কোমল মানসপটে কি বিষাদের ছায়া ফেলবে না?
প্রতিদিন আমরা দেখছি সামাজিক অবক্ষয়ের ভয়াবহ চিত্র। দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক এসব চিত্র দেখে বেড়ে উঠছে আমাদের নতুন প্রজন্ম, আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এ বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মকে বাঁচাতে হবে। আমাদের নতুন প্রজন্মকে শেখাতে হবে সামাজিক মূল্যবোধ। তাদের চিন্তা, চেতনা, ধ্যান-ধারণাকে প্রসারিত করতে হবে সামাজিক মূল্যবোধ ও শিক্ষার মাধ্যমে।
তাদের সুকোমল অন্তরে সত্য, সুন্দরের গুণাবলি দ্বারা মানবিক করে গড়ে তুলতে হবে। একজন নারীকে শুধু নারী হিসেবে না দেখে মানুষ হিসেবে দেখতে হবে। তাদের অবমাননা নিপীড়ন, লাঞ্ছিত করার মনোবৃত্তি পরিত্যাগ না করি তাহলে নতুন প্রজন্ম এ সমাজ রাষ্ট্র থেকে কি শিখবে? কারণ সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে নতুন প্রজন্ম তাদের বেড়ে ওঠার জন্য সুস্থ সামাজিক পরিবেশ চায়। সুস্থ মন-মানসিকতা নিয়ে তাদের বেড়ে ওঠার সামাজিক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। সর্বোপরি নারী নির্যাতন, সামাজিক অবক্ষয়রোধে মানবিকতা, সামাজিক মূল্যবোধ রক্ষায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সময়ের দাবি।
মোহাম্মদ নজাবত আলী: শিক্ষক ও কলাম লেখক