শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নরপিশাচদের কবলে আমাদের কোমলমতি শিশুরা

ইদানীং সামাজিক অবক্ষয়ের ভয়াবহ চিত্র দেখতে পাই নারী-শিশু ধর্ষণ ও হত্যার মধ্যদিয়ে। সম্প্রতি পুরান ঢাকার ওয়ারীতে শিশু সায়মা ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা আমাদের বিবেক নাড়িয়ে দিয়েছে। কেবল স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার ছাত্রীরাই নয়- গৃহবধূরাও রেহাই পাচ্ছে না সমাজের এ মারাত্মক ব্যাধি থেকে। দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী নানা বাহিনী রয়েছে, স্থানীয় রাজনীতিক, এমপি, সমাজপতিরা রয়েছেন। তারপরও আমরা আমাদের মেয়েদের শিশুদের রক্ষা করতে পারছি না। এর চেয়ে দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় আর কী হতে পারে?
সালাম সালেহ উদদীন
  ১০ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

সমাজ নানামুখী অবক্ষয়ের বিস্তার ঘটছে মানসিক ও যৌন বিকারগ্রস্ততার মতো অপরাধের। যার কারণে শিশু ও নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা বেড়েই চলেছে, কোনো রকম প্রতিকারহীনভাবে। এক প্রতিবেদনে প্রকাশ- জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ৬ মাসে ২০৩ শিশু খুন হয়েছে। ৬৩০টি ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ৪৩২টি। নারীর তুলনায় কন্যাশিশুরা ধর্ষিত ও খুন হচ্ছে বেশি। এটা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য এক ভয়াবহ বার্তা। আমাদের কোমলমতি শিশুরা যদি একের পর এক নির্যাতন ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হতে থাকে এবং সামাজিকভাবে এর প্রতিরোধ করা না যায় তা হলে এর ভয়াবহতা আরও বৃদ্ধি পাবে। আমরা কথায় কথায় বলি আজকের শিশু আগামীদিনের ভবিষ্যৎ। কিন্তু তাদের ভবিষ্যৎ আমরা নিশ্চিত করতে পারছি না। পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ, সৌন্দর্য ভালোভাবে উপভোগ করার আগেই তাদের ধর্ষণের পর খুন করা হচ্ছে। ফুলের মতো পবিত্র শিশুরা কিছু নরপিশাচদের কারণে প্রাণ হারাচ্ছে। এদের মানসিকতা, রুচি এবং অপরাধপ্রবণতা কেবল ঘৃণারই উদ্রেক করে না, কোন পরিবারে কোন পরিবেশে এদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা সে প্রশ্নও বড় হয়ে ওঠে।

সামাজিক জীবন ব্যক্তির কাছে এক আশীর্বাদ। এর পূর্ণতা লাভ করে সামাজিক বন্ধনের মাধ্যমে সমাজে সুশৃঙ্খল পরিস্থিতি বজায় থাকলে। কিন্তু সামাজিক অনাচার ও অবক্ষয় যদি বেড়ে যায় ব্যক্তি বিশেষের কারণে তা হলে ওই সমাজে বসবাস কঠিন হয়ে পড়ে। ব্যক্তির আধিপত্য, অর্থ-সম্পদ ও রাজনৈতিক কারণে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও অবক্ষয় দেখা দেয়। এ অবক্ষয়ের জোয়ার বাংলাদেশে একেক সময় একেকভাবে আসে।

ইদানীং সামাজিক অবক্ষয়ের ভয়াবহ চিত্র দেখতে পাই নারী-শিশু ধর্ষণ ও হত্যার মধ্যদিয়ে। সম্প্রতি পুরান ঢাকার ওয়ারীতে শিশু সায়মা ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা আমাদের বিবেক নাড়িয়ে দিয়েছে। কেবল স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার ছাত্রীরাই নয়- গৃহবধূরাও রেহাই পাচ্ছে না সমাজের এ মারাত্মক ব্যাধি থেকে। দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী নানা বাহিনী রয়েছে, স্থানীয় রাজনীতিক, এমপিরা, সমাজপতিরা রয়েছেন। তারপরও আমরা আমাদের মেয়েদের শিশুদের রক্ষা করতে পারছি না। এর চেয়ে দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় আর কী হতে পারে?

আমরা এতটাই বর্বর সমাজে বাস করছি, যে সমাজে বখাটে সন্ত্রাসীদের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম রয়েছে। বখাটে সন্ত্রাসীদের কাছে সবাই যেন অসহায় ও জিম্মি। দেশব্যাপী ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছে বখাটে সন্ত্রাসীরা। এ অবস্থায় কোনোভাবেই চলতে দেয়া যায় না।

যারা এসব অপরাধ করছে তারা কি ভিন্নগ্রহ বা ভিন দেশ থেকে হঠাৎ বাংলাদেশে আবির্ভূত হয়েছে- না। তারা এ দেশেরই সন্তান। এ দেশেরই মাটি, আলো, হাওয়ায় প্রকৃতির হাতছানি ও আবহে বেড়ে উঠেছে। তারপরও তারা এমন নিষ্ঠুর ও অমানবিক হলো কেন। যাদের সন্তানরা এসব অপকর্ম করছে পিতা হিসেবে স্নেহময়ী মা হিসেবে তারা যে ব্যর্থ এটা এখন প্রমাণিত সত্য। তারা তাদের সন্তানদের প্রতি এতটাই উদাসীন ও কর্তব্যপরায়ণহীন ছিল যে তার খেসারত এখন পুরো জাতিকে দেয়া লাগছে। কেবল তাই নয়, যেসব মা-বাবার সন্তানরা এসব অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে- তাদের অপরাধ আড়াল করারও চেষ্টা করছে। এসব অভিভাবকরা প্রকারান্তরে অপরাধী, কারণ তারা তাদের বখাটে সন্ত্রাসী-ছেলেদের অপকর্মে উৎসাহিত করছেন। সমাজের যে ভয়াবহ রকম পচন ধরেছে এসব ঘটনার দ্বারা এটাই প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়। সন্তান অপরাধী হলে বাবা নিজে সন্তানকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন। সেই আদর্শ পিতার দেশে কী করে আদর্শহীন পিতা-মাতা থাকে- যারা বখাটে সন্তানদের রক্ষা করার চেষ্টা করছেন। শুধু অভিভাবকরাই রক্ষা করছেন না, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বখাটেরা এসব অপকর্ম তথা নারীর জীবন ও সম্ভ্রম নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। যেহেতু স্থানীয় রাজনীতিকরা এসব বখাটেদের তাদের স্বার্থের কাজে লাগায় বিধায় তারা অপরাধ করলে তাদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসে।

সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণহীনতা, পারিবারিক শিক্ষার অভাব, বেকারত্ব, সুস্থ বিনোদনের অভাব, সাংস্কৃতিক শূন্যতা ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ার কারণে আজকের এ অবস্থা। এ ছাড়া মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট এবং আকাশ সংস্কৃতির কুপ্রভাব পড়েছে যুবসমাজের মধ্যে। তাই বলে কি নীতি-নৈতিকতার বালাই থাকবে না, তরুণদের মধ্যে ভালো-মন্দ-ন্যায়-অন্যায়ের বিবেচনাবোধ ও পার্থক্য থাকবে না। থাকবে না, আত্মনিয়ন্ত্রণ শক্তি। স্কুলজীবনে নীতি-নৈতিকতা শিক্ষা দিতে গিয়ে আমার শিক্ষক বলেছিলেন, 'মনে যা চায়, তা কিন্তু করা যায় না, আর করলে তা পিঠে ধরে না'। মানুষ যদি যা ইচ্ছা তাই করতে পারত, তাহলে সামাজিক শৃঙ্খলা যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে তাও থাকত না।

প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই সহিংসতা ঘটানো এবং একই সঙ্গে তা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রয়েছে। যিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তিনিই মহান এবং রিপুর দ্বারা তাড়িত নন। একের পর এক সহিংস নৃশংস বর্বর ঘটনা ঘটানোর মাধ্যমে বখাটেরা যদি সমাজ ও রাষ্ট্রকে গ্রাস করে ফেলে তবে দেশে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। তাই যেভাবেই হোক বখাটেদের প্রতিরোধ করতে হবে। সামাজিক ও আইনি প্রতিরোধ জোরালো করতে হবে। দন্ডবিধি ৫০৯ ধারায় বলা আছে, কোনো নারীর শালীনতা হানি ও মর্যাদা হানির অভিপ্রায়ে কোনো মন্তব্য ও অঙ্গভঙ্গি বা কোনো কাজ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অন্যদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ১০ ধারায় যৌন নিপীড়ন ও শ্লীলতা হানির অভিযোগ ১০ বছরের কারাদন্ডের বিধান আছে।

মনে রাখতে হবে, আইনের কঠোর ও দ্রম্নত প্রয়োগের মাধ্যমে যদি পাঁচ-দশজন ধর্ষক হন্তারক বখাটেকে কঠিন ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যায়, তবে এ বিপজ্জনক ও সমাজ-বিনাশী প্রবণতা থেকে আমাদের নারী ও শিশুরা যেমন রক্ষা পাবে, রক্ষা পাবে সমাজ ও রাষ্ট্রও।

তবে এটা স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। আমাদের স্থায়ী সমাধানের দিকে যেতে হবে। নারীর প্রতি মর্যাদাবোধ জাগ্রত করে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে নারীকে না দেখলে এ ব্যাধির উপশম হবে না। 'নারী কেবল নিপীড়ন আর ভোগের বস্তু, নারীকে যা বলব তাই শুনতে বাধ্য'- যতদিন পর্যন্ত তরুণ প্রজন্মের এবং পুরুষশাসিত সমাজের এ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হবে ততদিন এ ভয়ানক ব্যাধি অনিরাময়যোগ্য মরণব্যাধি হিসেবেই থাকবে।

তবে এটা সত্য, সমাজে আমরা আমাদের কোমলমতি শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারিনি। এটা আমাদের জাতীয় ব্যর্থতা। মানুষ কতটা বর্বর হলে শিশুদের নির্যাতন ধর্ষণ ও হত্যা করতে পারে তা আমাদের মাথায় ধরে না। এটা সামাজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত নজির। ইদানীং মানুষের লোভ, আক্রোশ, নিষ্ঠুরতা ও জিঘাংসা অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। যার নিষ্ঠুর শিকার হচ্ছে কোমলমতি শিশুরা। বেশির ভাগ সময়ে তাদের অপহরণের পর খুন করা হচ্ছে কিংবা পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। অভাব, হাহাকার, হতাশায় বাবা-মাও নিজের সন্তানকে হত্যা করছেন অবলীলায়। এ ছাড়া সামান্য অপরাধে শিশুকে অমানুষিক নির্যাতন করা হচ্ছে। শিশুর প্রতি এমন নির্দয় আচরণ কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এটা অবক্ষয়গ্রস্ত সমাজেরই এক ভয়াবহ করুণ চিত্র। এই চিত্র বদলানো জরুরি। এটা সম্ভব না হলে আমাদের শিশুরা থাকবে নিরাপত্তাহীন।

অবাক ব্যাপার যে, দেশে শিশু ধর্ষণ নির্যাতনের পাশাপাশি নারীর প্রতি যৌন নির্যাতনও বেড়ে গেছে। নির্যাতন ধর্ষণ করছে কলেজ শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, মসজিদের ইমাম, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ, ডাক্তার, কর্মচারী, পুলিশ, আত্মীয়, চাচা-মামা-খালু, দুলাভাই, আমলা, ধনীর দুলাল। কেউ বাদ যাচ্ছে না। ধর্ষিত হচ্ছে ছাত্রী, যুবতী, আয়া, বুয়া, গৃহবধূ। রাস্তা-ঘাটে, রেস্তোরাঁয়, চলন্ত বাসে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে, গৃহে ঘটছে এই পৈশাচিক ঘটনা। কোথাও আজ নারীরা নিরাপদ নয়। যারা ধর্মশিক্ষা দিচ্ছে, তারা শিশুদের ধর্ষণের পর পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হাতে নিয়ে শপথ করাচ্ছে, অপরাধ গোপন রাখার জন্য। কী সাংঘাতিক ব্যাপার, এটা ঘটছে এ সমাজেই। এর চেয়ে বর্বরতা আর কী হতে পারে?

এখানে বিশেষভাবে উলেস্নখ্য, সিলেটের চাঞ্চল্যকর শিশু রাজন হত্যা ও খুলনায় রাকিবকে নৃশংস নির্যাতনের মধ্যদিয়ে শিশুহত্যার ঘটনায় সারা দেশে ব্যাপক তোলপাড় হয়। নির্যাতনের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার হওয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় এ ঘটনায় দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রতিবাদে মিছিল-সমাবেশ হয়। এরপর থেকে সারা দেশের শিশু নির্যাতনের ঘটনা সামনে আসতে থাকে। শিশু অধিকার সংরক্ষণ করা এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। শিশুর সঠিকভাবে বেড়ে ওঠা, তার বিকাশের ক্ষেত্রেও সমাজ ও রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা একেবারে কম নয়। দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, অপার সম্ভাবনা ও স্বপ্ন নিয়ে যে শিশুর নিরাপদে বেড়ে ওঠার কথা সে কেন অপহরণ ধর্ষণ ও নিষ্ঠুর হত্যার শিকার হবে? এর জন্য কি কেবল ব্যক্তি দায়ী? শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সমাজ ও রাষ্ট্রের কি কোনো ভূমিকা নেই? আমরা অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিসহ এ ধরনের ঘটনার দ্রম্নত অবসান চাই। আমার সন্তানকে আমি যেমন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্যদিয়ে শত প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে বাঁচিয়ে রাখতে চাই, সুস্থ ও সুখী দেখতে চাই- নিশ্চয়ই অন্য পিতামাতাও তাই চান। তাই আসুন, সমাজের এসব অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলি, শিশুদের জন্য নিরাপদ আবাসভূমি রচনা করি!

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর ভাষায় বলতে হয়-

জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা

শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা।

অথবা, কবি সুকান্তের ভাষায়-

এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি

নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।

সালাম সালেহ উদদীন: কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<57436 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1