শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও ভোক্তা অধিকার

প্রতি বছরেই তামাক ও তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার কমাতে সরকার এই জাতীয় পণ্যগুলোর ওপর করারোপ করে। আর এই কর আদায় হয় ভোক্তার কাছ থেকেই। আদায় করে থাকে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। এই ব্যবস্থাটা অনেকটা শেয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেয়ার মতো। কারণ সিগারেট বা বিড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মুনাফার জন্য কখনোই তাদের ভোক্তা কমাবে না।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
  ১১ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

শক্তির নিত্যতা সূত্রানুসারে জানা যায়, শক্তি অবিনাশী তার ক্ষয় বা বিনাশ নাই, একরূপ থেকে অন্যরূপে রূপান্তরিত হয় মাত্র। যদিও শক্তির নিত্যতা সূত্রের প্রায়োগিক ক্ষেত্র পদার্থবিদ্যা, তবে সমাজের বিবর্তনের ফলে সৃষ্ট নানা বিষয়ের সঙ্গে তার মিল পাওয়া যায়। সরকার ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছেন। বাজেট হলো রাষ্ট্রের আয় ব্যয়ের একটি বাৎসরিক পরিকল্পনা। সরকার রাষ্ট্রের যাবতীয় ব্যয় ভার পরিচালনা করে থাকেন জনগণের কাছ থেকে প্রাপ্ত করের টাকা দিয়ে। আর বাৎসরিক বাজেটে করারোপ করার ফলে সরকারের ব্যয়ের টাকাটা আয় হয়। তাই দেখা যা, বিভিন্ন ধরনের কর হলো সরকারের আয়ের মূল উৎস। আগেকার দিনে রাজা বাদশা বা ব্রিটিশ আমলেও সরকারের আয়ের মূল উৎস ছিল প্রজাদের কর। ওই সময়ের করের বড় অংশ আসতো ভূমির খাজনা থেকে। কারণ তখনকার দিনে মানুষের নিত্যব্যবহার্য পণ্যগুলো যা ছিল তা সেই সময়ের মানুষ অধিকাংশ নিজেরাই তৈরি করত; তাই হাট বা বাজার এখনকার দিনের মতো এতসব সামগ্রী কেনা-বেচা হতো না। তা ছাড়া ব্যবহার্য দ্রব্যাদির পরিধিও ছিল সীমিত। তাই সেই সময়ে রাজা, বাদশা, পরবর্তী ব্রিটিশ সরকাররাও জমির খাজনা আদায়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল। তবে আজকের দিনের মতো তখনকার দিনে ভূমির খাজনা হার এত কম ছিল না, বর্তমানের সঙ্গে আনুপাতিক হারে সেই সময়ের খাজনার হার ছিল অনেক বেশি। সময়ের বিবর্তনে মানুষের ভোগবিলাস বেড়েছে, বেড়েছে ব্যবহার্য দ্রব্যাদির পরিধি। ভূমির খাজনার হার আনুপাতিক হারে কমলেও বেড়েছে অন্যান্য ব্যবহার্য দ্রব্য এবং সেবার ওপর কর। বর্তমানে সরকারের কর আদায় আর সেই সময়ের রাজা, বাদাশা বা ব্রিটিশ সরকারের জমির খাজনা আদায়ের পদ্ধতিগত পার্থক্যটা কী অভিন্ন? না শক্তির নিত্যতা সূত্রের মতো তা দেখার বিষয়। ব্রিটিশরাজ চীরস্থায়ী ব্যবস্থা প্রবর্তন করে জমিদারি প্রথা চালু করেন। সমগ্র বাংলার ভূমি জমিদারকে প্রদান করেন। ব্রিটিশ সরকার জমিদারদের কাছ থেকে জমিদারের ভূমির পরিমাণ অনুসারে খাজনা আদায় করতেন। জমিদাররা ব্রিটিশদের তাদের ওপর আরোপিত খাজনা প্রদান করত। আর জমিদারা ব্রিটিশদের খাজনা পরিশোধ করার জন্য জমিদারির অঞ্চলকে কয়েককটি তালুকে বিভক্ত করে দিত। ভূমির পরিমাণ অনুসারে জমিদারা তালুকদারদের ওপর খাজনা আরোপ করতেন। তখনকার দিনে তালুকদাররা তাদের অঞ্চলে চাষাবাদ করা কৃষকদের ভূমি ব্যবহারের পরিমাণের ওপর খাজনা ধার্য করতেন। আর এভাবেই খাজনা আদায় করে তিনহাত বদল হয়ে ব্রিটিশ রাজাদের কোষাগারে জমা হতো। জমিদারি প্রথা বাতিলের পর থেকে সরকার সরাসরি ভূমির খাজনা আদায় করেন। এখন জমিদারি নেই তবে বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সৃষ্টি হয়েছে নতুন করপোরেট জমিদারি। বর্তমান কর ব্যবস্থায়, আয়কর যাকে ওহপড়সব ঞধী বলা হয়, এই করটা সরাসরি করদাতা রাষ্ট্রের কোষাগারে জমা দেন। ভ্যাট, অন্যান্য কর ও আবগারি শুল্কটা জমিদারি খাজনার ন্যায় পরিণত হয়েছে। ১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ দেশের সব কলকারখানা, ব্যাংক, বিমাসহ সব উৎপাদক প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রায়ত্ত করেন। এ সব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্য কিনে বা সেবাগ্রহণ করে সাধারণ মানুষ যে মূল্যটা পরিশোধ করত তা সরাসরি জমা হতো রাষ্ট্রের কোষাগারে। ১৯৭৫ সালে জাতিরজনককে হত্যার পর দেশে জন্ম নেয় করপোরেট জমিদার শ্রেণি। ১৯৭৫ সালের পট পরির্বতনের পর সব রাষ্ট্রীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান এবং পণ্য উৎপাদন প্রতিষ্ঠান, সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান এমনকি শিক্ষা ব্যবস্থা বিরাষ্ট্রীয় করণ করা হয়। আর সেই সঙ্গে জন্ম নেয় কিছু করপোরেট জমিদার- যার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। করপোরেট জমিদার বাড়ার ফলে দেখা যায় দেশের মোট সম্পদের ৯৯ শতাংশের মালিক এখন ১ শতাংশ মানুষ। বর্তমানে ভ্যাট আইনে ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছে বেশ কয়েকটি স্তর। দেশের শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের ওপর সরকার বিভিন্ন হারে ভ্যাট আরোপ করেছেন। শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত পণ্যটির উৎপাদন খরচের সঙ্গে মালিকের লাভ এবং ভ্যাট যোগ করে মালিকরা সেই পণ্যটি বাজারে বিক্রির ব্যবস্থা করেছেন। যেহেতু শিল্প মালিকরা সরাসরি ভোক্তার কাছে তাদের উৎপাদিত পণ্যটি বিক্রি করতে পারেন না। তার জন্য তারা বিভিন্ন ধরনের পরিবেশক নিয়োগ দেন। পণ্যটি বিভিন্ন ডিলার, পরিবেশকের হাত ঘুরে সবশেষে খুচরা বিক্রেতার মাধ্যমে ভোক্তার কাছে পৌঁছে। ভোক্তা তার কেনা পণ্যটির ওপর সরকার নির্ধারিত ভ্যাটটি প্রদান করেই কিনে থাকেন। এই পণ্য বিক্রির স্তরগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাচ্ছে যে, বেশ কয়েকটি হাত বদল হয়ে পণ্যটি ভোক্তার কাছে পৌঁছে। সুতরাং বদল হওয়া হাতগুলোর মাধ্যমে ভোক্তার কেনা পণ্যটির ভ্যাটের টাকাটা কতটা সরকারের কোষাগারে জমা হয় তা নিয়ে দেখা দেয় নানা প্রশ্ন।

\হচলতি অর্থবছরে সরকার বেশ কয়েকটি পণ্যের ওপর করের হার বাড়িয়েছে, তার কয়েকটি উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করছি এই লেখায়, যেমন- সরকার নারীদের নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য পণ্য সেনেটারি ন্যাপকিনের ওপর কর বাড়িয়েছে। গত ৪ জুলাই একটি সংবাদ থেকে জানা যায়, ৯০ টাকা মূল্যের সেনেটারি ন্যাপকিনের ওপর ১০ টাকা ভ্যাটারোপ করা হয়েছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই ন্যাপকিনের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। একজন ন্যাপকিন ক্রেতা ন্যাপকিন কিনে কত ট্যাক্স প্রদান করল তা জানার কিন্তু কোনো পদ্ধতি নেই। প্রত্যন্ত গ্রামের দোকানিও জানেন না কত টাকা ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। কারণ এই ক্ষুদ্র খুচরা বিক্রেতার কাছ থেকে ভিন্নভাবে ভ্যাট আদায় করা হয়। স্যানেটারি ন্যাপকিনের ব্যবহার দেশে বেড়েছে তাই প্রত্যন্ত গ্রামের দোকানেও তা এখন পাওয়া যায়। করারোপের বিষয়টি স্পষ্টত বলা হয় বাজেট বক্তৃতায়, কিন্তু আদায়কালে কত টাকা সাধারণ মানুষ প্রদান করল তার স্বচ্ছতা নেই। পণ্য কেনার পর সাধারণ মানুষ জানেন না, তিনি কতটাকা ভ্যাট দিলেন, কারণ দোকানগুলোতে সেই ধরনের রিসিপ্ট দিতে দেখা যায় না। সরকার মোবাইল ব্যবহারকারীদের কলরেটের ওপর ট্যাক্স আরোপ করেছেন। কলরেটের ট্যাক্স মোবাইল সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আদায় করে থাকে। দেশে প্রথম সারির চারটি মোবাইল প্রতিষ্ঠান রয়েছে। মোবাইল সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সরকারকে কলরেটের ওপর আরোপিত ট্যাক্স আদায়ের জন্য নির্ভর করতে হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলো ট্যাক্স আদায় করে সরকারের কোষাগারে জমা দিচ্ছে কি না তা কিন্তু ট্যাক্স প্রদানকারী জানতে পারে না। দেখা যায়, মোবাইল ফোনে দুই মিনিট বা তিন মিনিট কথা বলার পর নিদির্ষ্ট অংকের টাকা কেটে নেয় মোবাইল সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানটি। প্রতি মিনিটে কোম্পানিগুলো তাদের হার বেঁধে দেয়। মোবাইল সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে কলরেটের প্রতি মিনিটের কলরেটের হার কম বেশি রয়েছে। প্রতি মিনিট কথা বলার পর কত টাকা ব্যবহারকারী করপোরেট জমিদারকে দিল আর কত টাকা ট্যাক্স সরকারের কোষাগারে ট্যাক্স হিসেবে জমা দিল তা ব্যবহারকারী জানতে পারে না। অথচ মোবাইল ব্যবহারকারীরা ব্যবহারের পূর্বেই কোম্পানিতে টাকা জমা দেয় (প্রি প্রেইড ) তার মোবাইল ফোনটি ব্যবহার করে। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, করপোরেট জমিদাররা যথাযথভাবে ট্যাক্স আদায় করছে। আর সেই ট্যাক্স কি তারা সঠিকভাবে সরকারের কোষাগারে জমা দিচ্ছে। করপোরেট পদ্ধতিতে সরকারের কর আদায়ের বিষয়ে করপোরেট জমিদারা মধ্যস্বত্বভোগীর ভূমিকা পালন করেন। তাই দেখা যায়, কিছু করপোরেট প্রতিষ্ঠান নানাভাবেই ফয়দা লুটছে। করপোরেট ট্যাক্স আদায়ের ব্যবস্থাটা অনেকটা এমন, দেখা যায় বগুড়ার মস্থানগরের গ্রামের একজন কৃষক এক কেজি মুলা বিক্রি করে মৌসুমের সময় ১ টাকা। ওই মুলাই আবার হাত বল হয়ে এসে কাওরানবাজারে বিক্রি হয় ১৫ টাকায়। বর্তমানে ভ্যাটসহ কিছু কর আদায়ের বেলা অনুরূপ ঘটনারই আশঙ্কা রয়েছে। সাধারণ জনগণ তাদের কেনা প্রতিটি পণ্যরই ভ্যাট দিচ্ছে এবং এই টাকা সরকারের কোষাগারে জমা হয় তা জানার অধিকার কিন্তু ক্রেতার রয়েছে? বাস্তবতার নিরিখে দেখা যায় ক্রেতা তা জানেন না। ভ্যাট আদায়ের বিষয়ে রয়েছে পদ্ধতিগত নানা জটিলতা। শোনা যাচ্ছে, ভ্যাট কর্তৃপক্ষ রাজশাহী শহরের ক্ষুদ্র দোকানি ব্যবসায়ীদের ওপর প্রতি দোকানের জন্য বিশ হাজার টাকা করে ভ্যাট আরোপ করছেন। এই ভ্যাট আদায়টা কোন পদ্ধতিতে হচ্ছে তা সাধারণের বোধগম্য নয়। কারণ নতুন ভ্যাট আইনে কি এ রকম কোনো পদ্ধতি আছে?

প্রতি বছরেই তামাক ও তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার কমাতে সরকার এই জাতীয় পণ্যগুলোর ওপর করারোপ করে। আর এই কর আদায় হয় ভোক্তার কাছ থেকেই। আদায় করে থাকে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। এই ব্যবস্থাটা অনেকটা শেয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেয়ার মতো। কারণ সিগারেট বা বিড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মুনাফার জন্য কখনোই তাদের ভোক্তা কমাবে না।

তাই ভোক্তার সংখ্যা ঠিক রাখার জন্য তারা ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করবে এটাই স্বভাবিক। ফলে যথাযথভাবে আরোপিত কর আদায়ের ক্ষেত্রে প্রশ্ন দেখা দিবে।

কর আদায়ের বিষয়ে আরো স্বচ্ছতা আনা প্রয়োজন। আর পরোক্ষ করের চেয়ে প্রত্যক্ষ কর আরোপ করা উচিত। যা সরসারি করপোরেটদের কাছ থেকে আদায় হবে।

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<57694 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1