শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভয়াবহ এক সামাজিক সমস্যা মাদক

নতুনধারা
  ১১ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

মাদক এক ভয়াবহ সামাজিক সমস্যার নাম। সমাজে যত ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত কিংবা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে দেখা যায়, এর অধিকাংশের সঙ্গেই মাদকাসক্তরা জড়িত। ইসলামের দৃষ্টিতেও মদ্যপান একটি গর্হিত কাজ। তাই ইসলাম মাদককে হারাম করেছে। কেননা এর থেকেই সব অশ্লীল কাজের উৎপত্তি হয়। আমরা জানি, ইসলামের সব বিধিবিধান একত্রে নাজিল হয়নি। পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে দীর্ঘ ২৩ বছরে। বিভিন্ন প্রেক্ষাপট ও সময়ের চাহিদা অনুসারে আলস্নাহতায়ালা জিবরাইল আমিনের মাধ্যমে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স.) উপর বিধিনিষেধ সংবলিত এই মহাগ্রন্থ নাজিল করেন। ইসলাম পূর্বযুগে মাদক সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট বিধিবিধান ছিল না। মাদক সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের আলোচনা নিম্নে বর্ণনা করা হলো-

কোরআন তিনটি ধাপে মাদককে হারাম করেছে। নিম্নে মাদক সম্পর্কে কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গি আলোচনা করা যাক-

প্রথম ধাপ সূরা বাকারা আয়াত ২১৯ (হে নবী) তারা আপনাকে মদ এবং জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দিন উভয়ের মধ্যে রয়েছে মস্ত বড় গুনাহ। আর মানুষের জন্য উপকারিতাও রয়েছে, তবে এগুলোর পাপ উপকারিতা অপেক্ষাও অনেক বড়।

মদ্যপান হারাম হওয়া ও এসংক্রান্ত বিধান, ইসলামের প্রথম যুগে জাহিলিয়াত আমলের সাধারণ রীতিনীতির মতো মদ্যপানও স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। অতঃপর রাসুল (স.) যখন হিজরত করে মদিনায় আসলেন, তখনো মদিনাবাসীর মধ্যে মদ্যপান ও জুয়ার প্রচলন ছিল। সাধারণ মানুষ এ দুটি বস্তুর শুধু বাহ্যিক উপকারিতার দিকে লক্ষ্য করেই এতে মত্ত ছিল। কিন্তু এগুলোর অন্তর্নিহিত অকল্যাণ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না। রাসুলের (স.) মদিনায় আগমনের পর কিছু সাহাবি মদ ও জুয়ার অকল্যাণগুলো অনুভব করলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে হযরত ওমর (রা.) এবং মুয়ায ইবনে জাবাল (রা.) এবং কিছুসংখ্যক আনসার সাহাবি রাসুলকে (স.) বললেন, মদ ও জুয়া, মানুষের বুদ্ধি, বিবেচনাবোধকে পর্যন্ত বিলুপ্ত করে দেয় এবং ধনসম্পদও নষ্ট করে। এ সম্পর্কে আপনার নির্দেশ কি? এর পরিপ্রেক্ষিতেই পূর্বোলিস্নখিত আয়াতটি নাজিল হয়। তবে এর মাধ্যমে মদ্যপানকে সম্পূর্ণরূপে হারাম করা হয়নি। এর মাধ্যমে মদ্যপানের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে। যেমন মদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ দোষ হচ্ছে এর মাধ্যমে মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ বিবেক বুদ্ধি বিলুপ্ত হয়ে যায়। আর বিবেচনাবোধ না থাকলে মানুষ যে কোনো গর্হিত কাজেই লিপ্ত হতে পারে। এই আয়াতের মাধ্যমে মদ্যপান ত্যাগ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এতে কেউ কেউ মদ্যপান ছেড়েও দিয়েছেন।

দ্বিতীয় ধাপ : একদিন হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) সাহাবিদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে দাওয়াত করলেন। খাওয়া-দাওয়া শেষে প্রথানুযায়ী সবার জন্য মদ্যপানের ব্যবস্থা করলেন। এবং সবাই মদ্যপান করল। এমতাবস্থায় মাগরিবের নামাজের সময় হলে সবাই নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। ইমামতি করার জন্য একজনকে সামনে পাঠানো হলো। নেশাগ্রস্থ অবস্থায় থাকায় ইমাম সাহেব সূরা কাফিরুন ভুল পড়ছিলেন। এতে অর্থের পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছিল। তখনই মদ্যপানের ব্যাপারে দ্বিতীয় আয়াতটি নাজিল হলো : সূরা নিসা (আয়াত ৪৩)

হে ইমানদারগণ, তোমরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাজের ধারে-কাছেও যেও না যতক্ষণ না তোমরা বুঝতে পার যা তোমরা বল, এবং অপবিত্র অবস্থায়ও না যতক্ষণ পর্যন্ত না গোসল কর-।

এই আয়াত দ্বারা নামাজের সময় মদ্যপানকে হারাম করা হয়েছে। তবে অন্য সময় তা পান করার অনুমতি তখনো পর্যন্ত বহাল। এই আয়াত নাজিলের সঙ্গে সঙ্গে বহুসংখ্যক সাহাবি মদ্যপান ছেড়ে দিয়েছেন। তারা অনুভব করলেন যেহেতু এটা নামাজ থেকে বিরত রাখে তাই এতে কোনো কল্যাণ থাকতে পারে না। কিন্তু পুরোপুরি হারাম না হওয়ায় কিছুসংখ্যক সাহাবি নামাজের সময় ছাড়া অন্য সময়ে মদ্যপান করতেন।

তৃতীয় ধাপ : হযরত আতবান ইবনে মালেক (রা.) কয়েকজন সাহাবিকে দাওয়াত করেন। এতে হযরত সা'দ ইবনে আবি ওয়াক্কাসও (রা.) উপস্থিত ছিলেন। খাওয়া-দাওয়ার পর মদ্যপান করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল। আরবদের প্রথা অনুযায়ী নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতা, এবং এতে নিজেদের বংশ ও পূর্বপুরুষদের অহংকারমূলক বর্ণনা শুরু হয়। সা'দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) একটি কবিতা আবৃত্তি করলেন। যাতে আনসারদের দোষারোপ করে নিজেদের প্রশংসাকীর্তন করা হয়। যার ফলে একজন আনসার যুবক সাহাবি রাগান্বিত হয়ে উটের গলার হাড় সা'দের মাথায় ছুড়ে মারেন। তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। অতঃপর ওই যুবক রাসুলের কাছে গিয়ে এ ব্যাপারে অভিযোগ করেন। বলেন, মদ্যপানের ব্যাপারে আমাদের স্পষ্ট ধারণা দিন। তখন মদ্যপানকে সম্পূর্ণরূপে হারাম করে আলস্নাহতায়ালা আয়াত নাজিল করেন। সূরা মায়েদা : (আয়াত ৯০) হে ইমানদারগণ নিশ্চিত জেনে রাখো মদ, জুয়া, মূর্তি এবং ভাগ্য নির্ধারণের জন্য তীর নিক্ষেপ এ সবগুলোই নিকৃষ্ট শয়তানির কাজ। কাজেই এগুলো থেকে তোমরা সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকো। যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো। মদের অবৈধতা সম্পর্কে পর্যায়ক্রমিক নির্দেশ : আলস্নাহর নির্দেশাবলির তাৎপর্য তিনিই জানেন। তবে শরীয়তের নির্দেশনাগুলোর প্রতি গভীরভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, ইসলামী শরীয়ত যে কোনো বিষয়ে হুকুম প্রদান করতে গিয়ে মানবীয় আবেগ, অনুভূতির প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রেখেছে। যাতে মানুষের সেগুলো আমল করতে গিয়ে বিশেষ কষ্টের সম্মুখীন হতে না হয়। সূরা বাকারায় আলস্নাহতায়ালা বলেন, আলস্নাহতায়ালা কোনো মানুষকেই এমন আদেশ দেন না, যা তার শক্তি ও ক্ষমতার ঊর্ধ্বে।

মদ্যপানের ব্যাপারে পর্যায়ক্রমিক নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রথমে বোঝানো হয়েছে, এতে অনেক অকল্যাণ আছে। এতে মদ্যপান ছাড়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। হারাম করা হয়নি। দ্বিতীয় আয়াতে নামাজের সময়ের জন্য হারাম করা হয়েছে। সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ নয়। তৃতীয় পর্যায়ে এসে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে শরীয়তের এমন পর্যায়ক্রমিক ব্যবস্থা গ্রহণের কারণ ছিল এই যে, আজীবনের অভ্যাস ত্যাগ করা, বিশেষত নেশাজনিত অভ্যাস হঠাৎ ত্যাগ করা মানুষের জন্য অনেক কষ্টকর হতো। এজন্যই ইসলাম এমন বৈজ্ঞানিক পন্থা অবলম্বন করেছে। মদ্যপানের ব্যাপারে রাসুল (স.) হাদিসে কঠোর হুশিয়ারি দিয়েছেন। রাসুল (স.) বলেন সর্বপ্রকার অপকর্ম ও অশ্লীলতার জন্মদাতা হচ্ছে মদ। এটি পান করে মানুষ নিকৃষ্টতর পাপে লিপ্ত হয়ে যেতে পারে।

নাসায়ী শরীফের এক হাদিসে বলা হয়েছে- ইমান ও মদ কখনো একত্রিত হতে পারে না।

হযরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (স.) মদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে এমন দশ শ্রেণির ব্যক্তির ওপর অভিশাপ দিয়েছেন। ১. যে লোক নির্যাস বের করে ২. প্রস্তুতকারক ৩. পানকারী ৪. যে পান করায় ৫. আমদানিকারক ৬. যার জন্য আমদানি করা হয়। ৭. বিক্রেতা ৮. ক্রেতা ৯. সরবরাহকারী ১০. এর লভ্যাংশ ভোগকারী। সামাজিক দিক বিবেচনায় মাদক সেবনকারী যেমন মানুষের কাছে ঘৃণার পাত্র, তেমনি আলস্নাহতায়ালার কাছেও সে ঘৃণিত ব্যক্তি। তাই সামাজিক দিক লক্ষ্য রেখে এবং পরকালে জান্নাতের আশায় মদ্যপান ত্যাগ করি। সুস্থ ও সুন্দর আগামী গড়ি।

মাহদী

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<57695 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1