বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্নীতিই বর্তমান সরকারের বড় দুশমন

আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দল। এ দলে এখন নেতার সংখ্যা আর কর্মীর সংখ্যা প্রায় সমান। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি কর্মীই একজন ছোটখাটো নেতা সেজে দুর্নীতিবাজ হয়ে উঠছে। তাদের দুর্বৃত্তপনায় পার্টির ইমেজ নষ্ট হচ্ছে। এসব নেতার উৎপাতে গ্রামীণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, হত্যা, ধর্ষণ, মারামারির পাশাপাশি দুর্নীতিও বেড়ে চলছে সমানতালে। বিশেষ করে 'ধর্ষণ' এখন নতুন উপদ্রব হিসেবে দেখা দিয়েছে। সরকার যেমন মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে, দুর্নীতি ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে এখন জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করার সময় এসেছে। এখন দল ও প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে।
মোনায়েম সরকার
  ১৬ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

সারা বিশ্বে এখন যে বিষয়টি বারবার উচ্চারিত হচ্ছে তার নাম 'দুর্নীতি'। দুর্নীতির কারণে এখন অনেক দেশের রাজা-মহারাজাই জেল খাটছেন। কেউ কেউ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছেন। দুর্নীতিবাজ সরকারকে কোনো দেশের সাধারণ নাগরিকই পছন্দ করেন না। জনগণ চান শান্তি ও সেবা। কিন্তু দুর্নীতিবাজরা শান্তি ও সেবার কথা ভুলে গিয়ে নিজেদের আখের গোছানোতে ব্যস্ত থাকে। এর ফলে তারা জনগণের কাছ থেকে অনেক দূরে সরে যায়। নির্বাচন এলে এই দুর্নীতিবাজরা টাকার বিনিময়ে দলীয় টিকেট কিনে নেয় ঠিকই, কিন্তু জনগণ তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। যার ফলে ব্যাপকভাবে পরাজয় ঘটে ক্ষমতাসীন দলের। সম্প্রতি শেষ হওয়া ভারতের লোকসভা নির্বাচন যেন নতুন করে আবার এই কথাটিকেই জানান দিয়ে গেল।

পৃথিবীর সব দেশেই দুর্নীতি এখন ব্যাধিতে রূপান্তরিত হয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়াসহ সব মহাদেশের চিত্র প্রায় একই রকম। তবে দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোতেই দুর্নীতি তুলনামূলকভাবে বেশি। দুর্নীতির কালো থাবা আজ সর্বত্রই মানুষের মানবিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। ক্ষুণ্ন করছে সরকারের ভাবমূর্তি। জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে কমিয়ে সরকারকে অসহায় করে তুলছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনেকেই উপরে উপরে সোচ্চার হন বটে, তবে এটা শেষ পর্যন্ত শুধুই লোক দেখানো নাটকই থেকে যায়। সর্বস্তরে দুর্নীতির শেকড় উপড়ে ফেলতে না পারলে কখনোই সুন্দরভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তাই সঙ্গত কারণেই সরকারকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া দরকার।

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। উন্নয়নশীল স্তর থেকে উন্নত দেশের পদমর্যাদা পেতে হলে এখনো আমাদের অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। এই পথ অত্যন্ত দীর্ঘ এবং কণ্টকাকীর্ণ। উন্নত দেশ হতে হলে প্রথমেই বাংলাদেশকে একটি জাবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে হবে, এরপর নজর দিতে হবে দুর্নীতির দিকে। দুর্নীতি জিইয়ে রেখে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন কখনোই সফল হবে না।

আজ পত্রপত্রিকার পাতা খুললেই দুর্নীতির নানান সংবাদ আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মন্ত্রী থেকে অফিস সহকারী সবাই আজ কমবেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। অতীতের চেয়ে দুর্নীতি কোনো কোনো সেক্টরে কিছুটা কমলেই একেবারে নির্মূল করা যায়নি। দলীয় নেতাকর্মীরা ক্ষমতার দাপটে যেভাবে সীমাহীন দুর্নীতি করছে এটা কোনো শুভ লক্ষণ নয়। দুর্নীতিবাজদের কোনো দল থাকে না, তাদের কোনো আদর্শ থাকে না- তারা দলীয় লেবাস পরে শুধু দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ লাভের আশায়। সুতরাং দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর হলে তাতে সরকারের লাভই হবে।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করেন একটি লন্ডভন্ড দেশকে গড়ে তোলার জন্য। বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় তার কোনো মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে কেউ কখনো দুর্নীতির অভিযোগ তুলতে পারেনি। তখন আওয়ামী লীগের অনেক ডাকসাইটে নেতারই ঢাকা শহরে বাড়ি ছিল না, গাড়ি ছিল না, ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা ছিল না। অনেক নেতাই সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতেন। বিলাসিতার চেয়ে দেশ সেবাই তাদের প্রধান কাজ ছিল। তাই ভগ্নস্তূপের মধ্য থেকেই উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিল বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়- সে সময়ে জিপিডির যে হার ছিল (৭.৫ শতাংশ) সেই হার বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার ছাড়া কেউই অতিক্রম করতে পারেনি। নেতা যদি দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দেন, তাহলে কর্মীরাও দুর্নীতি করার সুযোগ পায় না। বঙ্গবন্ধু কখনোই দুর্নীতি করেননি, তার ঘোরতর শত্রম্নরাও কখনো তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো উদাহরণ তুলে ধরতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু দুর্নীতি করেননি বলেই তার সহযোদ্ধারা দুর্নীতি করার সাহস পায়নি। বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েই শেখ হাসিনা সরকারকে এগিয়ে যেতে হবে। কেননা শেখ হাসিনা সরকারের কাছে এ দেশের মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি।

আমরা যদি '৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশের চিত্র দেখি, তাহলে দেখবো সব সরকারের আমলেই সীমাহীন দুর্নীতি হয়েছে। জিয়াউর রহমান দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং বলেছিলেন- গড়হবু রং হড় ঢ়ৎড়নষবস। তার চারপাশে যারা ছিল তাদের দুর্নীতির কথা এ দেশের মানুষ ভুলে যায়নি। জিয়াউর রহমানের পরে আসেন এইচএম এরশাদ, তিনিও দুর্নীতিকে স্বাগত জানান। বাংলাদেশে এরশাদ সাহেব দুর্নীতির যে কালচার তৈরি করেন, সেই কালচারের পরিপূর্ণ রূপ দেন জিয়া-পত্নী বেগম খালেদা জিয়া ও তার দুই দুর্নীতিবাজ পুত্র। খালেদা জিয়ার সরকার দুর্নীতি করে সীমাহীন সম্পদের পাহাড় গড়েন। জিয়ার রেখে যাওয়া ছেঁড়া গেঞ্জি আর ভাঙা সুটকেস থেকে যেভাবে কোকো জাহাজ, ডান্ডি ডাইং, দেশ-বিদেশের ব্যাংকে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ বেরিয়ে ছিল তা দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিল বাংলার মানুষ। দুর্নীতি আর জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দিয়েই জিয়া পরিবার আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। দুর্নীতির কারণেই আজ কারাবন্দি খালেদা জিয়া। বিএনপির নেতাকর্মীরা যেভাবে দেশে দুর্নীতির মহোৎসব শুরু করেছিল, আজকে সেই দুর্নীতির ফল তারা হাতে হাতে পাচ্ছে। সুতরাং পূর্ববর্তী ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান সরকারকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে হবে।

শুরুতেই বলছিলাম আমাদের নিকট প্রতিবেশী ভারতের কথা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘদিন বামফ্রন্ট ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল বামদের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে অতিষ্ঠ হয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভোট দেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এতদিন সাদা শাড়ি আর চটি পরে যে ভাবমূর্তি তৈরি করেছিলেন, তার সেই ভাবমূর্তিও এখন ধূলিসাৎ হতে চলেছে আর ভাইপো ও দলীয় নেতাকর্মীদের দুর্নীতির অবাধ সুযোগ দেয়ার কারণে। তৃণমূল কংগ্রেস ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে যে দুটি কারণে পরাজিত হয়েছে, তার প্রথমটি হলো- লাগামহীন দুর্নীতি, দ্বিতীয়টি হলো দলীয় নেতাকর্মীদের ঔদ্ধত্য। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ কম নেই। বিশেষ করে তার নোট বাতিলের হঠকারী সিদ্ধান্ত এবং টাকা দিয়ে ভোট ও সাংসদ কেনার অভিযোগ কিছুতেই তিনি অস্বীকার করতে পারেন না। এসব কারণে নরেন্দ্র মোদিও যথেষ্ট চাপের মুখে আছে। ধর্মীয় উগ্রবাদ উস্কে দিতে না পারলে নরেন্দ্র মোদি এবার ক্ষমতায় বসতে পারতেন কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে।

তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের ফলে বিশ্ব এখন প্রতিটি মানুষের হাতের মুঠোয় বন্দি। মানুষকে ধোঁকা দিয়ে বোকা বানানোর সুযোগ এখন আর নেই। যে কোনো খবরই বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। এহেন পরিস্থিতিতে সততা ও স্বচ্ছতাই সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারে। তাই দুর্নীতিকে উৎখাত করে সুনীতির চর্চাই পারে সরকারকে টিকিয়ে রাখতে। এর ব্যত্যয় হলেই আগামীতে নেমে আসবে পরাজয়। সেই সঙ্গে জেলের আমন্ত্রণও আসতে পারে। দুর্নীতি সাধারণ মানুষ করে না। দুর্নীতি করে ক্ষমতাবানরা অথবা যারা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকেন তারা। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কথা ভুলে গুটিকয়েক দুর্নীতিবাজকে লালন-পালন করলে সরকারের ভুল হবে।

আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দল। এ দলে এখন নেতার সংখ্যা আর কর্মীর সংখ্যা প্রায় সমান। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি কর্মীই একজন ছোটখাটো নেতা সেজে দুর্নীতিবাজ হয়ে উঠছে। তাদের দুর্বৃত্তপনায় পার্টির ইমেজ নষ্ট হচ্ছে। এসব নেতার উৎপাতে গ্রামীণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, হত্যা, ধর্ষণ, মারামারির পাশাপাশি দুর্নীতিও বেড়ে চলছে সমানতালে। বিশেষ করে 'ধর্ষণ' এখন নতুন উপদ্রব হিসেবে দেখা দিয়েছে। সরকার যেমন মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে, দুর্নীতি ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে এখন জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করার সময় এসেছে। এখন দল ও প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে শুদ্ধি অভিযান চালাতে হবে।

যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যাবে তাকেই বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে এবং দেশে-বিদেশে প্রশংসা কুড়াচ্ছে, কিন্তু দেশ এগিয়ে যাচ্ছে এটা যেমন সত্য, সেই এগিয়ে যাওয়ার গতিকে দুর্নীতি বাধাগ্রস্ত করছে এটাও তেমনি সত্য। দুর্নীতিই এখন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান দুশমন। বঙ্গবন্ধুও জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ গড়ে ছিলেন দুর্নীতি উৎখাত করে উন্নত বাংলাদেশ গড়তে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ জয়ী হতে পারলেই স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব। দুর্নীতির পথ খোলা রেখে উন্নত দেশ গড়ার স্বপ্ন আকাশ-কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।

মোনায়েম সরকার: রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<58381 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1