বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

যাত্রীসেবা ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে

বাংলাদেশের যাত্রীদের অধিকার রক্ষা করা আর সেবার মান বাড়ানো/নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। এই প্রয়োজনকে গভীর, যথার্থ ও কার্যকরীভাবে দেখার জন্য প্রথমেই সরকারসহ নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ও পরিবহন নেতৃত্বের দৃঢ় অঙ্গীকার এবং সংশ্লিষ্ট সবার মন-মানসিকতার গুণগত পরিবর্তন ঘটাতে হবে। প্রতিটি কর্তৃপক্ষ এবং প্রতিষ্ঠানকে পর্যাপ্ত গবেষণা ও স্টাডি করে বিষয়টির প্রকৃতি, ধরন, অবস্থা, করণীয় ইত্যাদি নির্দিষ্ট করে বাস্তবতা অনুযায়ী একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সম্পদ ও সামর্থ্য অনুযায়ী তা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করতে হবে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জি এম কামরুল ইসলাম, এসপিপি (অব.)
  ১৭ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

বাংলাদেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে সবাই কখনো না কখনো যাত্রী। তা ছাড়া যেসব বিদেশিরা আমাদের দেশে বসবাস করে কিংবা বিভিন্ন কাজে আসা-যাওয়া করে তারাও সবাই যাত্রী। দুই ঈদসহ বিভিন্ন বড় বড় ছুটির সময় মানুষের যাতায়াত (যাত্রী) বহুগুণে বেড়ে যায়। তাই নিরাপদেই বলা যায় যে আমাদের দেশে যাত্রী সংখ্যা (প্রতিবার চলাচলের ভিত্তিতে) প্রায় লাখো কোটির মতো। এসব যাত্রী আবার সড়ক (নিজস্ব যানবাহনের পাশাপাশি গণপরিবহন যথা- বাস, হাবোর, মোটরসাইকেল, ইত্যাদি), রেল, নৌ, আকাশ ইত্যাদির মাধ্যমে যাতায়াতে করে থাকেন। তাদের মধ্যে আবার আবালবৃদ্ধবনিতা, ছেলেমেয়ে, প্রতিবন্ধী, অসুস্থ ইত্যাদি সব ধরনের যাত্রী আছে। যেহেতু আমাদের যাত্রী সংখ্যা অনেক এবং তাদের ধরনও কিছুটা বৈচিত্র্যময়- সেহেতু তাদের সেবা ও অধিকারসহ অন্যান্য বিষয়ের আওতায় ব্যাপক এবং কিছুটা চ্যালেঞ্জিংও বটে। তাই তাদের অধিকার ও সেবার মান নিশ্চিত করা এবং সেবাদানকারী সংস্থা/প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ও কার্যক্রমও ব্যাপকভিত্তিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশে যাত্রী অধিকার কিংবা তাদের সেবাসংক্রান্ত বিষয়গুলো এখনো যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। অথচ একবিংশ শতাব্দীর এ সময়ে এবং বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি সরকারি, আধাসরকারি আর অসরকারিসহ সবপর্যায়েই যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। আমি এই লেখার মাধ্যমে আমাদের দেশের যাত্রী অধিকার ও যাত্রীসেবা সংক্রান্তসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোর মূল্যায়ন এবং করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করার চেষ্টা করব। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যাত্রী অধিকার ও সেবাসংক্রান্ত কার্যক্রম নিঃসন্দেহে একটা বড় পস্নাটফর্ম। এ সেক্টরের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট বিআরটিসিসহ সব সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা, রেল, নৌ, বিমান কিংবা অন্যান্য ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সংস্থা, ইত্যাদি মূলত সেবাদানকারী ব্যবসায়িক (সরকারি, আধাসরকারি অথবা ব্যক্তিগত) প্রতিষ্ঠান। তাদের কাছে শুধু সেবার চেয়েও লাভ-লোকসানের হিসাবটি বেশি গুরুত্ব পায়। পাশাপাশি যাত্রীদের সেবা ও অধিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে সরকার ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দরকষাকষির কারার মতো যোগ্য ব্যক্তিত্ব, কার্যকরী সংগঠন কিংবা প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যাত্রীকল্যাণ ফাউন্ডেশন, যাত্রীকল্যাণ সমিতি, যাত্রী অধিকার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ইত্যাদি নামে যে কয়েকটি দুর্বল প্রতিষ্ঠান যাত্রী অধিকার নিয়ে কাজ করে একদিকে তাদের নেতৃত্ব খুবই দুর্বল (সামাজিক, আর্থিক ও শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে)/ ব্যক্তিকেন্দ্রিক অন্যদিকে তাদের প্রায় সবাইকে নিজেদের জীবন-জীবিকার জন্য পূর্র্ণসময় কাজ করতে হয়। অনেকে আবার কোনো না কোনোভাবে পত্রিকা বের করে বিজ্ঞাপনের টাকায় নিজের ও পরিবারের খরচ বহন এবং সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ফলে তাদের কার্যক্রম। মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক বক্তৃতা-বিবৃতি, প্রেস কনফারেন্স, কিছু মিটিংয়ে অংশগ্রহণ ইত্যাদির মধ্যে সীমিত থাকে। তাই সবার প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই বলতে হয়, তাদের দ্বারা বাংলাদেশের যাত্রীদের অধিকার, সেবা আর মঙ্গলসংক্রান্ত কাজে উলেস্নখযোগ্য কিছু অর্জন করা সম্ভব নয়। ফলে আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। যাত্রীদের অধিকার, চিন্তা-চেতনা, সেবা ইত্যাদি বিষয়গুলো অপ্রকাশিত কিংবা উপেক্ষিত থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অনেক দেশে থাকলেও আমাদের দেশে যাত্রী অধিকার নিয়ে এককভাবে স্বয়ংসম্পূূর্ণ কোনো আইন নেই। বরং ২০১৮ সালে 'সড়ক পরিবহন আইন-১৮' নামে একটি আইন করলেও তার মনিটরিং কমিটিতে যাত্রীদের কিংবা যাত্রী অধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের কোনো প্রতিনিধিই রাখা হয়নি। যাত্রী অধিকার ও সেবা নিয়ে প্রায়ই বিশেষ করে কোনো বড় ধরনের দুর্ঘটনার পর পত্রপত্রিকায় অনেক লেখালেখি হলেও বিষয়টি নিয়ে বড় ধরনের কোনো গবেষণা কিংবা স্বয়ংসম্পূূর্ণ স্টাডি/কাজ আমাদের দেশে এখনো হয়নি। অতএব, বাংলাদেশে এই ক্ষেত্রেটিতে যথাযথ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক কাজ করা প্রয়োজন আছে। পৃথিবীর সব দেশেই যাত্রী অধিকার, তাদের নিরাপত্তা, সুবিধা-অসুবিধা ইত্যাদির ওপর আইন এবং যাত্রীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য কার্যকরী সংগঠন আছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে 'রাডে ট্রান্সপার্টে এবং সেপটি বিল-২০১৪', 'এভিয়েশন বিল-২০১৯'সহ কয়েকটি আইন এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দরকষাকষির মাধ্যমে যাত্রীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য 'এয়ার প্যাসেঞ্জার অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া'সহ অনেক সংস্থা কাজ করে থাকে। তবে পশ্চিমা দেশগুলোতে এই বিষয়টিকে অনেক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা হয়। ইউরোপের প্রতিটি দেশের পাশাপাশি ইইউর যাত্রীদের জন্য 'ইইউ রুলস্থ অন প্যাসেঞ্জার রাইট'-এর মতো অভিন্ন আইন-কানুন আর 'ইইউ প্যাসেঞ্জার রাইট ক্যাম্পেন'-এর মতো অভিন্ন প্রতিষ্ঠান যাত্রীদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করে থাকে। পাশাপাশি প্রতিটি সদস্য দেশের জন্য তাদের জাতীয় এনফোর্সমেন্টবডি (সড়ক, রেল, নৌ ও আকাশ পথের জন্য পৃথক বডি) থাকে। 'ণড়ঁৎ ঊঁৎড়ঢ়ব' ওয়েবসাইটে যাত্রী অধিকারসংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্যাদি পাওয়া যায়। এখন আমাদের দেশের যাত্রীসেবা ও অধিকারের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। বাংলাদেশে 'সড়ক পরিবহন আইন-১৮', 'এভিয়েশন আইন' 'রেলওয়ে আইন' ইত্যাদি আইন-কানুনে। ইতস্তত-বিক্ষিপ্তভাবে যাত্রীদের সেবা আর অধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য আইন-কানুনের মতোই তার প্রয়োগ অত্যন্ত সীমিত। তা ছাড়া আমাদের যাত্রীরা তাদের অধিকার সম্পর্কে খুব একটা সচেতনও নয়। পাশাপাশি আমাদের দেশে যারা যাত্রীসেবা প্রদান করেন তারা (সরকারি ও আধাসরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা) এবং মালিক-শ্রমিক পক্ষ সচেতনভাবে তাদের দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে যান কিংবা তা পালনে অবহেলা করেন। আবার যাত্রীদের পক্ষে কার্যকরীভাবে দরকষাকষি করার মতো উলেস্নখযাগ্যে সংস্থা কিংবা প্রতিষ্ঠানও আমাদের দেশে নেই। ফলে আমাদের দেশের যাত্রীরা তাদের প্রাপ্য সেবা ও অধিকার থেকে শুধু বঞ্চিতই হয় না বরং জানমালের নিরাপত্তাহীনতাসহ প্রায়ই শারীরিক ও মানসিকভাবে হয়রানি ও হেনস্তা এবং কষ্ট পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ প্রতিনিয়ত তাদের মানবিক ও মৌলিক অধিকার খর্ব হচ্ছে। আমাদের এয়ারপোর্টে যাত্রীদের হয়রানির ভয়াবহ চিত্র/অভিযোগ বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমরা অহরহই পেয়ে থাকি। সড়ক, রেল, নৌসহ অন্যান্য গণপরিবহনেও যাত্রীসেবার মানের অবস্থা একই রকম নাজুক এবং অনেকটা উপেক্ষিতও বটে। রাস্তা-ঘাটসহ সব সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা এবং রক্ষণা-বেক্ষণের অভাব, পুরাতন আর ঝুঁকিপূর্ণ ও অপর্যাপ্ত যানবাহন, ধারণ ক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি যাত্রী পরিবহন, অহরহ সময়সূচি না মানা, পরিষ্কার-পরিছন্নতার অভাব, বিশ্রামাগার ও রেস্টরুমসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার অপর্যাপ্ততা ইত্যাদি আমাদের দেশের পরিবহন সেক্টরের একটা কমন চিত্র। বাংলাদেশে যাত্রীদের জানমালের বিমা সুবিধাও যথেষ্ট নয়। এ আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে যাত্রীদের সেবা ও অধিকারসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, বিদ্যমান আইন-কানুন এবং সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি শুধু অপর্যাপ্তই নয় বরং ভীষণভাবে উপেক্ষিত। বাংলাদেশের যাত্রীদের অধিকার রক্ষা করা আর সেবার মান বাড়ানো/নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। এই প্রয়োজনকে গভীর, যথার্থ ও কার্যকরীভাবে দেখার জন্য প্রথমেই সরকারসহ নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ও পরিবহন নেতৃত্বের দৃঢ় অঙ্গীকার এবং সংশ্লিষ্ট সবার মন-মানসিকতার গুণগত পরিবর্তন ঘটাতে হবে। প্রতিটি কর্তৃপক্ষ এবং প্রতিষ্ঠানকে পর্যাপ্ত গবেষণা ও স্টাডি করে বিষয়টির প্রকৃতি, ধরন, অবস্থা, করণীয় ইত্যাদি নির্দিষ্ট করে বাস্তবতা অনুযায়ী একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সম্পদ ও সামর্থ্য অনুযায়ী তা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশে যাত্রী অধিকার ও সেবাসংক্রান্ত যে আইন-কানুন বিক্ষিপ্তভাবে আছে তা একত্রিত করে এবং সময়ের চাহিদা ও আমাদের বাস্তবতার আলোকে অন্যান্য বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিয়ে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আইন ('বাংলাদেশ যাত্রী অধিকার সংরক্ষণ আইন') প্রণয়ন করা যেতে পারে। যাত্রীদের অধিকার, সুযোগ-সুবিধা, বিভিন্ন সংস্থার দায়বদ্ধতা এবং ট্রাফিক আইন-কানুনসহ সব বিষয়ে যাত্রীদের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচার-প্রচারণা ও স্কুল-কলেজে শিক্ষাদানসহ ব্যাপকভিত্তিক কার্যক্রম শুরু করতে হবে। সব সেক্টরের যাত্রীদের জন্য পর্যাপ্ত ও সহজ বিমা সুবিধার ব্যবস্থা থাকতে হবে। যানবাহনের সংখ্যা ও মান পর্যাপ্ত এবং উন্নত করা, রেস্টরুম ও বিশ্রামাগারসহ সব সুযোগ বৃদ্ধি করা, চলাচলের নিরাপত্তা ও সময়সূচি মানা, তথ্য আদান-প্রদান সহজকরণ, যাত্রী সেবাদান ও যাত্রীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী এবং দায়বদ্ধকরণ ইত্যাদি ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আমাদের দেশের যাত্রী অধিকার ও সেবার মান বৃদ্ধি পাবে। বিষয়টির। সঙ্গে একদিক দেশের আপামর জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তা ও আরামদায়ক ভ্রমণ- যেমন জড়িত অন্যদিকে সবার মানবাধিকার, সাংবিধানিক বাধ্যবাদকতা এবং আন্তর্জাতিকাঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তির প্রশ্নও বহুলাংশে জড়িত। তাই যাত্রী অধিকারের বিষয়টি নিয়ে আমরা যত দ্রম্নত কাজ করতে পারব ততই আমাদের ভালো হবে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জি এম কামরুল ইসলাম, এসপিপি (অব.) : কলাম লেখক ও নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে