শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পেশা হিসেবে শিক্ষকতা কতটা আকর্ষণীয়

সব স্তরেই শিক্ষা ও শিক্ষা পদ্ধতি এবং শিক্ষার্থী নিয়ে প্রচুর গবেষণা করার সুযোগ রয়েছে। সুতরাং সে রকম একটি সময় হয়তো একদিন আসবে যেদিন শিক্ষকরা হবেন সবচেয়ে মেধাবী আর তাদের সুযোগ-সুবিধা হবে সর্বোচ্চ পর্যায়ের।
অলোক আচার্য
  ১৮ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

একটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো সেই দেশের মেধাবী সন্তান এবং সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সেই মেধাবীদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা। তার ওপর নির্ভর করে সেই দেশ কত দ্রম্নত এগিয়ে যাবে বা উন্নত হবে। যদি মেধাবীরা অবহেলিত থাকে তবে তা দেশের জন্য অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়। সেই মেধাবী সন্তানরা প্রথম পছন্দ হিসেবে কোন পেশা বেছে নেবে তা নির্ভর করে সেই দেশের সেই পেশার আর্থিক সুবিধা, সামাজিক স্বীকৃতি, পদমর্যাদা এবং সামাজিক অবস্থানের ওপর। আমাদের দেশে যেমন মেধাবীরা প্রথম পছন্দ হিসেবে বেছে নেয় বিসিএস দিয়ে কোনো সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করার। যাদের সামর্থ্য আছে তারা চলে যায় বিদেশে এবং এক সময় সেখানেই স্থায়ী হয়। কিন্তু যদি কোনো দেশের চিত্র এমন হয় যে সেই সব দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীরা চাকরি করছে শিক্ষকতায়। ছোটবেলা থেকেই একটি শিশু স্বপ্ন দেখছে তার শিক্ষকের মতো বড় কেউ হওয়ার। শিক্ষকরা রাষ্ট্র থেকে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। সেই সব মেধাবী শিক্ষকরা তৈরি করছে আরও মেধাবী সন্তান। সেই দেশটা নিয়ে মেধাবী সন্তানরা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষকরা নিজেদের এবং নিজের ছাত্রছাত্রীদের উন্নয়নে অধিকাংশ সময় চিন্তাভাবনা করে সময় কাটাচ্ছে। তাকে ন্যায্য বেতনের দাবিতে রাস্তায় আন্দোলন করতে হচ্ছে না। পৃথিবীর উন্নত অনেক দেশেই শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। আমি আমাদের দেশেও এরকম একটি চিত্র আশা করি। এ দেশে শিক্ষকের মর্যাদা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মুখে, বাস্তবতা ভিন্ন। আজও শিক্ষকরা কষ্টেই দিনযাপন করছে। শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে বহু অপ্রাপ্তি আর এসব অপ্রাপ্তি নিয়েই তারা শেখানোর কাজটি করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু আমাদের দেশের চিত্র তার বিপরীত। একথা ঠিক যে, শিক্ষকরা আগের চেয়ে অনেক বেশি ভালো আছে। কারণ তাদের বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে তার সঙ্গে কি দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি ঘটেনি। একজন শিক্ষককে কেন সর্বোচ্চ বেতন দেয়া হবে অথবা কেন একজন শিক্ষক সর্বাধিক সুযোগ-সুবিধা পাবেন সেই প্রশ্ন আসতে পারে। একেকজন শিক্ষক হলো একেকজন সুপার হিউম্যান। এ কথার পেছনে কারণ হলো একজন শিক্ষককে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারি হতে হয়। সেই তালিকায় বহু গুণ রয়েছে। আমাদের দেশে শিক্ষকদের ভেতরেও রয়েছে প্রকার ভেদ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক যারা আজও তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদা পান, সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক, এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ, নন-এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ, সরকারি কলেজ- এসব শিক্ষকের বেতনেও রয়েছে পার্থক্য। ফলে সামাজিক পার্থক্য বিদ্যমান। প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বারবার বলা হলেও এই শ্রেণির শিক্ষকদের দিকে সুদৃষ্টি আজও পড়েনি কর্তৃপক্ষের। যে স্তরটিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলা হচ্ছে সেই স্তরের শিক্ষকরা কিভাবে তৃতীয় শ্রেণির চাকরি করেন তা আমার বোধগম্য নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদের চাকরিরতদের থাকবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব।

মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল-কলেজগুলোতে বর্তমানে এনটিআরসিএ মেধা যাচাইয়ের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়ায় ম্যানিজিং কমিটির সেই সনাতন রীতি আর নেই। ফলে ধরেই নেয়া যায় এরা নিঃসন্দেহে মেধাবী। কিন্তু এই এত বছর ধরে যে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে সেখানে চূড়ান্ত মেধাবীরা নিয়োগ পেয়েছে কি না তার নিশ্চয়তা কে দেবে। শিক্ষক নিয়োগে ম্যানেজিং কমিটির দৌরাত্ম্যের কথা আজ কারও অজানা নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ম্যানেজিং কমিটির প্রয়োজনীয়তা নিয়েও বহু লেখালেখি হয়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থানীয় প্রভাবশালী এবং অধিকাংশই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় প্রভাব খাটিয়ে তাদের পছন্দসই প্রার্থীকে নিয়োগ করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই কোনো মেধাবী চাইলে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ পায়নি। কারণ চাকরি পেতে টাকা বা সে রকম কেউ আত্মীয় হয়তো তার ছিল না। কিভাবে এটা হয়েছে আজ তা সবার জানা। সেসব মেধাবীদের চোখের জল ঝরানো ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। আজ যে পদ্ধতিতে শিক্ষক নিয়োগ করা হয় এটি আরও অনেক আগেই প্রয়োগ করা উচিত ছিল বলে আমার মনে হয়। তাহলে আমরা আমাদের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায় মেধাবীদের দেখতে পেতাম। একজন মেধাবী শিক্ষক একজন মেধাবী ছাত্র তৈরি করতে বেশি পারদর্শী। আজ যেমন একজনের স্বপ্ন থাকে বিসিএস, ব্যাংক বা এরকম বড় কোনো পদে চাকরি করার, তেমনি এই স্বপ্ন যদি শিক্ষক হওয়ার হতো তাহলে বেশ ভালো হতো। শিক্ষকতা পেশায় প্রবেশের আগে যদি তার যাচাই পদ্ধতি ওইসব বড় বড় চাকরির মতো হতো এবং পরবর্তী সুযোগ-সুবিধা সেসব চাকরির মতো হতো তাহলে আজ শিক্ষকতা হলো সবার প্রথম পছন্দের পেশা। শিক্ষকদের জন্য আলাদা একটি বেতন কাঠামো তৈরির কথা বলা হলেও আজ অবধি তা সম্ভব হয়নি। শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতিতেও বহুনির্বাচনী, লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে তারপর নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু একজন ভালো ফলাফল করা বা প্রচুর জানা একজন যে ভালো শিক্ষক হতে পারবেন সবসময় এটি সঠিক নয়। শিক্ষকের বাচনভঙ্গি, বোঝানোর দক্ষতা এবং কৌশল, তার শারীরিক অঙ্গভঙ্গি এরকম বহু বিষয় আছে যা ভালো শিক্ষক হতে সাহায্য করে। যদিও নিয়োগের পর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এসব বিষয়ে শেখানো হয়। তবে কিছু জন্মগত গুণ রয়েছে যা সেই ব্যক্তির জন্মগতভাবেই থাকে। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগের আগে তাকে পরীক্ষামূলকভাবে শ্রেণিতে পাঠদান করতে হয়। এতে দেখা যায়, সেই ব্যক্তি তার জ্ঞান বা দক্ষতা শ্রেণিতে প্রয়োগে কতটুকু দক্ষ বা ছাত্রছাত্রী সেই শিক্ষকের সঙ্গে কত দ্রম্নত মানিয়ে নিতে পারে। কিন্তু আমাদের নিয়োগ পদ্ধতিতে এরকম বাস্তবভিত্তিক কোনো পরীক্ষা নেয়া হয় না।

আমাদের পরীক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক শ্রেণি থেকেই সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন করা হয়। এই পদ্ধতি চালু হওয়ার এত বছর পরেও দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের একটি বড় অংশ সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র তৈরি করতে পারেন না। স্কুলের পরীক্ষায় অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাইরে থেকে প্রশ্ন কিনে পরীক্ষা নেন। এখন প্রশ্ন হলো কেন এত বছর পার হলেও একজন শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে পারবেন না। এর মধ্যে সরকার শিক্ষক প্রশিক্ষণে বিপুল অর্থ খরচ করেছে। আমার কথা হলো সারাজীবন মুখস্থ পদ্ধতিতে পড়ালেখা করে পাস করা শিক্ষকরা এত সহজে বিষয়টি ধরতে পারছেন না। কারণ এক সময় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল পুরোপুরি মুখস্থনির্ভর। অনেকেই সৃজনশীল পদ্ধতির কাটাছেঁড়া করেন। অথচ দোষ পদ্ধতির না দোষ হলো আমাদের সময়ানুযায়ী প্রয়োগের। যেখানে মেধা প্রয়োগের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেখানে কোনো আপস করা উচিত নয়। ক্ষমতা দিয়ে অমেধাবীদের নিয়োগ দিয়ে সেখান থেকে ভালো কিছু আশা করা বোকামি। আজ যেমন বিসিএস পাস করে বড় বড় চাকরি করেন সেরকম কোনো কঠিন পরীক্ষার ভেতর দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে শিক্ষকতা পেশায় এসে নিজেকে নিয়োজিত করত তাহলে ভালো হতো। আর বিভিন্ন স্তরের শিক্ষকের ভেতর পার্থক্য না থেকে সবাই যদি একই রকম সুবিধাপ্রাপ্ত হতো তাও আমাদের জন্য মঙ্গলজনক। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষকদের তৃতীয় শ্রেণির চাকরি থেকে উচ্চ পদমর্যাদায় নেয়া উচিত। তৃতীয় শ্রেণির মানুষের কাছ থেকে প্রথম শ্রেণির মানুষ তৈরির আশা না করে প্রথম শ্রেণির মানুষের কাছ থেকেই আশা করা উচিত। আর এমপিওভুক্ত, নন-এমপিওভুক্ত, সরকারি- বেসরকারি এতসব পার্থক্য না করে যোগ্যতম ব্যক্তিকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সবাইকে এক মর্যাদায় দেখতে হবে। তাহলে শিক্ষকদের ভেতর কোনো ক্ষোভ থাকবে না। কারণ সরকারি বলেন আর বেসরকারি বলেন, প্রাথমিক, মাধ্যমিক বা কলেজ পর্যায় বলি কাজ তো শেখানো। ক্লাসে পাঠ দেয়া। সেই একই কাজের এত পার্থক্য থাকবে কোন কারণে আমার বোধগম্য নয়। প্রতিটি স্তরেরই সমান গুরুত্ব রয়েছে এবং একটি স্তরে উত্তীর্ণ না হলে অন্য স্তরে যাওয়া সম্ভব না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া করছে তারা কোনো না কোনো প্রাথমিক বা মাধ্যমিক স্তরে লেখাপড়া করে তবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জ্ঞান অর্জন করেছে।

সব স্তরেই শিক্ষা ও শিক্ষা পদ্ধতি এবং শিক্ষার্থী নিয়ে প্রচুর গবেষণা করার সুযোগ রয়েছে। সুতরাং সে রকম একটি সময় হয়তো একদিন আসবে যেদিন শিক্ষকরা হবেন সবচেয়ে মেধাবী আর তাদের সুযোগ-সুবিধা হবে সর্বোচ্চ পর্যায়ের।

অলোক আচার্য: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<58632 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1