বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রিয়া সাহার বক্তব্য দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র

প্রিয়া সাহাকে প্রশ্ন করতে চাই, আপনি কি ৪৭-এর দেশ ভাগ দেখেছেন, আপনি কি এই উপ-মহাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখেছেন, আপনি কি ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, আপনি কি বাংলাদেশের নাগরিক? আপনার ভেতর কি দেশপ্রেম রয়েছে? আপনি কি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে ভালোবাসেন। যদি ভালোবেসে থাকেন তা হলে দেশ ও দেশের জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন কেন? কী আপনার উদ্দেশ্য? আপনি যদি বিদেশে গিয়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন, তা হলে কী করে দেশের বিরুদ্ধে কথা বললেন। এর ফলে যে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হলো তা কি আপনি বুঝতে পারছেন না।
তারাপদ আচার্য্য
  ২২ জুলাই ২০১৯, ০০:০০

বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাংলাদেশে চমৎকার একটা পরিবেশ বিরাজ করছে বহু বছর ধরে। সবার মধ্যে গড়ে উঠেছে ভাতৃত্বের বন্ধন। ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবাই দেশের স্বাধীনতার জন্য ৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ঢেলে দিয়েছিল বুকের তাজা রক্ত। এ দেশের মুসলমানরা বিপদে হিন্দুদের আশ্রয় দিয়েছে, প্রাণ বাঁচিয়েছে। এ দেশে ঈদ, পূজা পাশাপাশি পালিত হয়। মসজিদ, মন্দিরেরও অবস্থান পাশাপাশি। বিদেশ থেকে যারাই এসেছেন তারা আমাদের এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রশংসা করেছেন। অথচ প্রিয়া সাহা বললেন বিস্ময়কর এক কথা, যা সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এবং নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় বইছে।

ওয়াশিংটন ডিসিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর উদ্যোগে তিনদিনব্যাপী 'ধর্মীয় স্বাধীনতায় অগ্রগতি' শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিতে যাওয়া ১৭ জুলাই হোয়াইট হাউসে গিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রিয়া সাহা বলেন, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা মৌলবাদীদের নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। প্রায় ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নিখোঁজ হয়েছেন। উলেস্নখ্য, ১৬ জুলাই ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার ২৭ ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠক করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেখানে ১৬ দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহাও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান। প্রিয়া সাহা মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বলেন, 'আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান নিখোঁজ রয়েছেন। দয়া করে আমাদের লোকজনকে সহায়তা করুন। আমরা আমাদের দেশে থাকতে চাই।' তিনি আরও বলেন, 'এখন সেখানে ১ কোটি ৮০ লাখ সংখ্যালঘু রয়েছে। আমরা আমাদের বাড়িঘর খুইয়েছি। তারা আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, তারা আমাদের ভূমি দখল করে নিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো বিচার পাইনি।' ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ কোন উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে তুলেছেন, দেশে ফিরলে সে বিষয়ে প্রিয়া সাহাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেছেন, 'এ ধরনের খবর দেয়ার পেছনে তার নিশ্চয়ই একটি কারণ ও উদ্দেশ্য রয়েছে। দেশে আসলে নিশ্চয়ই আমরা তাকে জিজ্ঞাসা করব।' ওয়াশিংটনে গিয়ে তোলা প্রিয়া সাহার অভিযোগ নিয়ে ব্যাপক আলোচনার মধ্যে শনিবার ঢাকায় নিজের বাড়িতে সাংবাদিকদের প্রশ্নে একথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে তুলে প্রিয়া সাহা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ করেছেন দাবি করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, প্রিয়া সাহা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে যে অভিযোগ করেছেন, তা একেবারেই মিথ্যা। বিশেষ মতলবে এমন উদ্ভট কথা বলেছেন তিনি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এক বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের উদ্দেশ্যেই প্রিয়া সাহা এ ধরনের বানোয়াট ও কল্পিত অভিযোগ করেছেন। আমরাও তাই মনে করি। বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা মৌলবাদীদের নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। প্রিয়া সাহার বক্তব্য যে অন্তঃসারশূন্য এবং বিশেষ উদ্দেশ্যে জঘন্য মিথ্যাচার, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখানে বিশেষভাবে উলেস্নখ্য, বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের ২৫ শতাংশ হচ্ছে ধর্মীয়ভাবে সংখ্যালঘু, যদিও তারা মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ। সরকারের উচ্চপদে অনেক সংখ্যালঘু রয়েছেন। প্রিয়া সাহার বক্তব্য দেশের শুভবোধসম্পন্ন সব মানুষের আবেগ ও অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে। তার বিচার হওয়া উচিত।

এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার বলেছেন, আট মাসের অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশে যে ধর্মীয় স্বাধীনতা তিনি দেখেছেন তা বিশ্বের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের আয়োজনে দ্বিতীয়বারের মতো আয়োজিত 'ধর্মীয় স্বাধীনতায় অগ্রগতি' শীর্ষক তিনদিনের ওই সম্মেলনের সমাপনীতে বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেনও বক্তব্য দেন। তার আগে বুধবার বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হোয়াইট হাউসে যান। তখন প্রিয়া সাহা ওই কথা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বলেন।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশের প্রিয়া সাহা যেসব কথা বলেছেন, তা বাংলাদেশের হাজার বছরের চেতনাবিরোধী এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দর্শনকে অস্বীকার অবজ্ঞা করার সামিল। তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়েছেন। প্রিয়া সাহা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন। তাই

প্রিয়া সাহাকে প্রশ্ন করতে চাই, আপনি কি ৪৭-এর দেশ ভাগ দেখেছেন, আপনি কি এই উপ-মহাদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখেছেন, আপনি কি ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, আপনি কি বাংলাদেশের নাগরিক? আপনার ভেতর কি দেশপ্রেম রয়েছে? আপনি কি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে ভালোবাসেন। যদি ভালোবেসে থাকেন তা হলে দেশ ও দেশের জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন কেন? কী আপনার উদ্দেশ্য? আপনি যদি বিদেশে গিয়ে দেশের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন, তা হলে কী করে দেশের বিরুদ্ধে কথা বললেন। এর ফলে যে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হলো তা কি আপনি বুঝতে পারছেন না।

তার এ বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। কোনো একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্তের অংশ হিসেবে প্রিয়া সাহা এ ধরনের অদ্ভুত ও অসত্য বক্তব্য প্রকাশ করেছেন বলে সবার ধারণা।

এটা ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশ ১১ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিককে সাময়িকভাবে আশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের এই মানবিক মনোভাব ও উদারতা সারা বিশ্বে প্রশংসা পাচ্ছে। আর আপনি বলছেন উল্টো কথা। অনেকের ধারণা, তিনি সংখ্যালঘুদের কথা চিন্তা করে নয়, বরং তার যে দুই মেয়ে আমেরিকা প্রবাসী তাদের নাগরিকত্ব পেতে ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করেছেন। ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি অনেক কঠিন। তিনি মিথ্যাচার করে তার দুই মেয়ের নাগরিকত্ব নেয়ার পথ পরিষ্কার করছেন। এই ধারণা একেবারে অমূলক নয়। আমরা আশা করব সরকার তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে (অবশ্য ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাষ্ট্রদোহী মামলা হয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তার বক্তব্য না শুনে মামলা নয়)। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষা ও দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই।

পাদটীকা- ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ডের ৪৪ বছর পর যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, আমি আমার প্রিয় বাংলাদেশে কেমন আছি। সহজ উত্তর ভালো আছি।

তারাপদ আচার্য্য: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<59224 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1