দেশে বাড়ছে বীভৎস, বিকৃত, রোমহর্ষক খুনের ঘটনা। আপনজনরাও ঘটাচ্ছে অবিশ্বাস্য খুন-খারাবি। মা খুন করছে সন্তানকে, স্ত্রী খুন করছে স্বামীকে, স্বামী পুড়িয়ে মারছে স্ত্রীকে, ভাই খুন করছে ভাইকে। ধর্ষণ শেষে আলামত গোপন করতে করা হচ্ছে খুন। খুনের পর লাশ রাখা হচ্ছে শয়নকক্ষে, রাস্তায়, বালুর ভেতর, বস্তার ভেতর, কাদার ভেতর, পানির ট্যাঙ্কে, ড্রেনে কিংবা ডাস্টবিনে। প্রায়ই এ ধরনের খুনের ঘটনা পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়ে আসছে। সম্প্রতি রাজধানীর মগবাজারে বিয়ের আসরে কনের বাবাকে ছুরিকাঘাতে খুন করেছে সজীব আহমেদ রকি নামের এক উত্ত্যক্তকারী। এসব খুনের ঘটনা অত্যন্ত আতঙ্কজনক এক বাস্তবতাকেই স্পষ্ট করে।
তথ্য অনুযায়ী, প্রায় দুই বছর ধরে কনে স্বপ্নাকে উত্ত্যক্ত করে আসছিল ঘাতক সজীব। মেয়েকে উত্ত্যক্ত করায় চলতি বছরের মার্চ মাসে স্বপ্নার পিতা সজীবের বিরুদ্ধে হাতিরঝিল থানায় মামলা করে। এ মামলায় সজীব একমাস জেল খেটে বেরিয়ে আবারও স্বপ্নাকে উত্ত্যক্ত করতে থাকে। স্বপ্নার অন্যত্র বিয়ে হওয়ার বিষয়টি মানতে পারেনি রকি। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, দুপুর পৌনে ১টার দিকে কমিউনিটি সেন্টারের দোতলায় কনেকে সাজানো হচ্ছিল। সজীব ভবনটিতে ঢুকেই তুলা মিয়াকে দেখতে পান। তুলা মিয়া তখন সজীবের কাছে এখানে আসার কারণ জানতে চান। শুরু হয় কথা কাটাকাটি। একপর্যায়ে তুলা মিয়াকে সজীব তার সঙ্গে থাকা ছুরি দিয়ে আঘাত করে। তার চিৎকারে ফিরোজা এগিয়ে এলে তাকেও ছুরিকাঘাত করে সজীব। উপস্থিত জনতা সজীবকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে। এ খুনের ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে।
অপরাধ ও সমাজ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এসব খুন-খারাবির পেছনে ইন্টারনেটের অপব্যবহার. অসহিষ্ণুতা, অতিমাত্রার ক্ষোভ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেও মানুষের মধ্যে দিন দিন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে নিষ্ঠুরতা। তুচ্ছ কারণে অসহিষ্ণু হয়ে খুনের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। যার মনে ক্ষোভ যত বেশি, তার দ্বারা হত্যাকান্ডে নৃশংসতা তত বেশি হয় বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা। অস্বীকারের উপায় নেই যে, মানুষের চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আইন থাকলেও এর সঠিক প্রয়োগ না থাকা এবং বিচারের দীর্ঘসূত্রতাও এমন খুনের ঘটনাকে উৎসাহিত করে বলেও মন্তব্য করেন বিশ্লেষকরা। বলার অপেক্ষা রাখে না, হত্যার ঘটনা বেড়ে যাওয়া সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি। ফলে এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনি কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি সামাজিক-পারিবারিক মূল্যবোধ জোরালো করার বিকল্প থাকতে পারে না।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও মনে করেন, সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়া, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, ইন্টারনেটের অপব্যবহার অপরাধ সংঘটনে অন্যতম কারণ হতে পারে। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হলে একটা মানুষ খারাপ কাজ করতে একটু ভাবে। তারা খারাপ কাজ পরিহার করে মানবিক আচরণগুলো করে। কিন্তু পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে মানুষের মনে নিষ্ঠুরতার মাত্রা বাড়তে পারে। পুলিশ প্রশাসন খুনের ঘটনাগুলো তদন্ত করে অপরাধীকে আইনের আওতায় নিয়ে আসছে সত্য; কিন্তু এরপরও অপরাধপ্রবণতা না কমার বিষয়টি উদ্বেগের জন্ম দেয় বৈকি।
আমরা মনে করি, প্রতিটি হত্যার ঘটনায় দায়ী ব্যক্তির দৃষ্টান্তমূলক সাজা নিশ্চিত হওয়া অত্যন্ত জরুরি একটি বিষয়। সমাজ-রাষ্ট্র থেকে অপরাধ নির্মূল করতে হলে আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং বিচারের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতারও অবসান ঘটাতে হবে। অপরাধীকে অপরাধী হিসেবেই গণ্য করতে হবে। সাধারণভাবে খুন-খারাবি বেড়ে যাওয়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিই নির্দেশ করে। দেশে আইনের শাসন, অপরাধীর উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা বলবৎ থাকলে অপরাধপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণে থাকারই কথা। আমাদের দেশে এ ক্ষেত্রে যে দুর্বলতা আছে তা স্বীকার করতেই হবে। অনেক আলোচিত চাঞ্চল্যকর হত্যা-নির্যাতনের ঘটনাও দিনের পর দিন বিচারহীন থাকছে। অপরাধীরা নানাভাবে প্রভাব খাটিয়ে লঘু দন্ডে পার পেয়ে যেতে পারছে। নাগরিকদের রক্ষা করাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব। যে কোনো অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর দ্রম্নত তার রহস্য উদ্ঘাটন করা এবং অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনার কোনো বিকল্প নেই। মগবাজারের সাম্প্রতিক হত্যাকান্ডসহ ইতিপূর্বে ঘটে যাওয়া সব হত্যাকান্ডে দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিত হোক- এটাই প্রত্যাশা।