শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শোকাবহ আগস্ট ও জনকল্যাণের রাজনীতি

বঙ্গবন্ধু শারীরিকভাবে আজ না থাকলেও মানুষের হৃদয়জুড়ে তার অবস্থান। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- 'নয়ন সম্মুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই।' তাই শোককে শক্তিতে পরিণত করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
ড. হারুন রশীদ
  ১৬ আগস্ট ২০১৯, ০০:০০

দেশের একটা বৃহৎ অংশের মানুষ বন্যার দুর্ভোগে। এডিস বাহিত মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে প্রাণ যাচ্ছে মানুষের। এই পরিস্থিতিতেই এবার আগস্ট মাস এসেছে বাঙালির জীবনে। শোকাবহ আগস্টে বাঙালি জাতি হারিয়েছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যার অঙ্গুলির নির্দেশে গোটা বাঙালি জাতি একাত্তরে 'যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে শত্রম্নর মোকাবেলা' করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীন বাংলার লাল সবুজ পতাকা। সেই তাকেই কিনা জীবন দিতে হলো এ দেশেরই কিছু বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে। যা ছিল কল্পনারও অতীত।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্যদিয়ে তার নাম নিশানা মুছে ফেলতে চেয়েছিল ঘাতক চক্র। শুধু তাই নয়- মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশকে তারা ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল পাকিস্তানি ভাবধারায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার যাতে হতে না পারে সে জন্য খন্দকার মুশতাক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে খুনিদের রক্ষায়। জিয়া সেই অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করে। ৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় গিয়ে এই কালো আইনটি বাতিল করে। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী বিচারের পথ প্রশস্ত হয়। এবং সময়ের ধারাবাহিকতায় আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার হয়েছে। ফাঁসির দন্ডও কার্যকর হয়েছে। তবে এখনো পলাতক আছেন বেশ কয়েকজন। তাদের দন্ড কার্যকরের ব্যাপারে যথাসাধ্য চেষ্টা চালাতে হবে। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা পার পেয়ে যাবে এটা কিছুতেই হতে পারে না। যেসব দেশে দন্ডপ্রাপ্ত খুনিরা আশ্রয় নিয়েছে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে দন্ড কার্যকরে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কেননা এই খুনিরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি দেশকেও সরিয়ে নিয়ে গেছে একাত্তরের চেতনাধারা থেকে।

সত্যি বলতে কী, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর রাজনীতির বিপথগামিতা শুরু হয়। পঁচাত্তর পরবর্তী নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্যদিয়ে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হওয়ার পর প্রকৃত রাজনীতিবিদদের কাছে টানতে না পেরে দলছুটদের নিয়ে দল গঠন করলেন ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য। হালুয়া-রুটির আশায় অনেকেই ভিড়লেন সে দলে। দলছুটদের পেয়ে তার মনে আত্মবিশ্বাস দৃঢ় হলো। কীভাবে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করা যায় তার জন্য নানা ফন্দিফিকির করতে লাগলেন। রাজনীতিবিদরা যাতে তার জন্য হুমকি না হতে পারেন সে জন্য তিনি এমনসব বিধিব্যবস্থা প্রণয়ন করলেন যাতে প্রকৃত রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি করাটা সত্যি কঠিন হয়ে পড়ল।

জিয়া নিজেই ঘোষণা করলেন, রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করার কথা। যে ছাত্ররা ভাষা আন্দোলন করলেন, ৬ দফাকে জনপ্রিয় করলেন, '৬৯-এর গণঅভু্যত্থান সৃষ্টি করলেন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অগ্রসৈনিকের ভূমিকা পালন করলেন সেই ছাত্ররাজনীতির ঊর্বর ভূমিতে রোপণ করা হলো স্বার্থপরতা এবং ক্ষমতালিপ্সার বিষবৃক্ষ। অস্ত্র, টাকা, আর ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে ছাত্রদের একটি অংশকে দলে টানতে সক্ষম হলেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। আরেক সামরিক শাসক এইচএম এরশাদ ক্ষমতায় এসে সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখলেন। বিষবৃক্ষে জল ঢাললেন। অনেক ছাত্রনেতা ক্ষমতার ভাগ-ভাটোয়ারা পেয়ে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হলেন। এর মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিতে কলুষতার ষোলোকলা পূর্ণ হলো।

ক্ষমতায় থাকা এবং যাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকল ছাত্র নেতারা। অনেকেই এমপি, মন্ত্রী পর্যন্ত হলেন। অস্ত্র টাকা হাতে পেয়ে অরাজকতায় লিপ্ত হলো ওইসব ছাত্ররা। ছাত্র রাজনীতিতে থেকে আদর্শ নামক বস্তুটি হারিয়ে যেতে থাকল। সেই সঙ্গে জাতীয় রাজনীতি থেকেও। কেননা সামরিক শাসনামলে একটি নব্য ধনিক শ্রেণির সৃষ্টি হওয়ায় তারা ক্ষমতার অংশীদার হতে চাইলেন। টাকা দিয়ে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার সংস্কৃতি চালু হলো। এবং আরও বেশি টাকা দিয়ে মন্ত্রিত্বের আসন কেনারও ব্যবস্থা হলো। এভাবে রাজনীতি চলে গেল ব্যবসায়িক শ্রেণির হাতে। নির্বাচনী ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ত্যাগী আদর্শবাদী রাজনীতিবিদরা অনেকেই রাজনীতির মাঠ থেকে ছিটকে পড়লেন।

অন্যদিকে সামরিক শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় মৌলবাদী রাজনীতি ফুলেফেঁপে উঠল। এমনকি তারা ক্ষমতার অংশীদার পর্যন্ত হলো। শুধু রাজনীতি নয়- ধর্মকে পুঁজি করে তারা ব্যাংকবিমাসহ অনেক ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানও স্থাপন করলেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে, রাজনীতিতে 'মৌলবাদের অর্থনীতি' এক বিরাট সমস্যা হয়ে দেখা দিল। রাজনীতিতে জায়গা করে নিল সাম্প্রদায়িকতা। স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হওয়ায় একটি সুস্পষ্ট বিভাজন সৃষ্টি হলো। সামরিক শাসকদের সৃষ্টি করা দলগুলো এই বিভাজনকে আরও প্রকট করে তুলল। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে এভাবে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে রাখা হলো। সামরিক, বেসামরিক প্রশাসন এমনকি বিচার বিভাগকেও ক্ষতবিক্ষত করা হলো দলীয়করণের মাধ্যমে। এভাবে গণতান্ত্রিকচর্চা ব্যাহত হতে থাকল। এরপর নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের পর গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা শুরু হলেও সে পথও কণ্টকাকীর্ণ হয়ে পড়ল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির হাতে ফিরে না আসায়। এক সামরিক সরকার হটিয়ে সেনাছাউনিতে জন্ম নেয়া দলটিকেই আবার ক্ষমতাসীন করা হলো।

এভাবে গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে কার্যত সামরিক শাসকের উত্তরসূরিরাই ক্ষমতায় থেকে গেল। ফলে গণতন্ত্র কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিকশিত হতে পারল না। এরপর দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিকাশ শুরু হয়। এত দিনের পুঞ্জীভূত পাহাড়সম সমস্যার সামনে দাঁড়িয়েও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হন। দ্রব্যমূল্য, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বিদু্যৎ-জ্বালানি, রাস্তা-ঘাটসহ অবকাঠামোগত খাতে তারা ব্যাপক উন্নয়ন করেন। এই সময় রাজনীতিতেও একটি গুণগত পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়।

এবার আগস্ট এসেছে এমন এক সময়ে যখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায়। সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে। সাকা-মুজাহিদ, নিজামী, কামারুজ্জামান, কাদের মোলস্নাসহ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর অনেকেরই ফাঁসির দন্ড কার্যকর হয়েছে। আর্থ-সামাজিক নানা দিক থেকেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা। মহাকাশেও পৌঁছে গেছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। বলা হচ্ছে উন্নয়নের মহাসড়কে এখন বাংলাদেশ। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে রাজননৈতিক নানা বিরোধ এখনো রয়েই গেছে। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে একমত হতে পারছে না দলগুলো।

পঞ্চম সংশোধনী পাস হওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলোপ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো বিকল্প হচ্ছে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন। এখন দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে সরকার, বিরোধী দলসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পর নির্বাচন কমিশন যেন সরকারের প্রভাবমুক্ত থেকে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে সেটি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প হচ্ছে নির্বাচন কমিশন। এখন নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার জন্য দৃশ্যমান কিছু পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। এ জন্য সবার আগে নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ, নির্ভরশীলতা কমিয়ে কমিশনকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে যাতে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা রাখতে পারে।

কী পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে কিংবা ক্ষমতায় থাকা না থাকার ইসু্যগুলোই রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে প্রাধান্য পাচ্ছে। ফলে জনস্বার্থ উপেক্ষিত হচ্ছে। সমঝোতার পরিবর্তে বৈরিতাই স্থান করে নিচ্ছে রাজনীতিতে। এ অবস্থা দেশকে এক সঙ্কটজনক অবস্থায় নিপতীত করছে। কিন্তু এ অবস্থা তো কারও কাম্য হতে পারে না। তাই জনকলাণ্যের রাজনীতিই সবার প্রত্যাশা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে জনকল্যাণই ছিল মুখ্য বিষয়। তাকে হত্যার মধ্যদিয়ে রাজনীতিতে যে বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জাতীয় শোকের মাস আগস্টে নতুন করে শপথ নিতে হবে যাতে জনকল্যাণই মুখ্য বিষয় হয় রাজনীতির। অনিশ্চিত অন্ধকারের পথে আর এক মুহূর্ত নয়। হীন স্বার্থ নয়, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের একটি সুখীসমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল বঙ্গবন্ধুসহ সব শহীদের রক্তঋণ শোধ করা সম্ভব। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছাতেই হবে।

বঙ্গবন্ধু শারীরিকভাবে আজ না থাকলেও মানুষের হৃদয়জুড়ে তার অবস্থান। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- 'নয়ন সম্মুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই।' তাই শোককে শক্তিতে পরিণত করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

নিঃস্বার্থপরতা, মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, সর্বোপরি ঘাতকের বুলেটের সামনে বাংলাদেশসম বুক পেতে দিয়ে দেশপ্রেমের যে নিদর্শন তিনি দেখিয়ে গেছেন সে পথেই হাঁটতে হবে। যে কোনো সঙ্কটে এবং সম্ভাবনায় বঙ্গবন্ধু হোক আমাদের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক।

ড. হারুন রশীদ : সাংবাদিক, কলামিস্ট

যধৎঁহথঢ়ৎবংং@ুধযড়ড়.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<62387 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1