এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গ ও ডেঙ্গুর মতো ভয়াবহ রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য বছরব্যাপী পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ২০০০ সালে দেশে প্রথম ব্যাপকভাবে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়ার পর চলতি বছরই ডেঙ্গুর বড় প্রাদুর্ভাব হয়েছে। এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ৭০ হাজার ছাড়িয়েছে- যা গত ১৯ বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মোট রোগীর চেয়েও বেশি। এবার মৃতু্যর সংখ্যাও বেশি। আতঙ্কের যে, এ বছর সারাদেশের মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এডিস মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে বছরব্যাপী নজরদারির যে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, তা আশাব্যঞ্জক হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা যায়, ডেঙ্গুর প্রথম প্রাদুর্ভাব থেকেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম আক্রান্ত রোগী ও মৃতু্যর তথ্য রাখছে। আর তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে ৭৮৩ জন। তাদের মধ্যে ঢাকায় ৩৪৪ জন এবং ঢাকার বাইরে ৪৩৯ জন রোগী। বলাই বাহুল্য, এ বছর ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে। সঙ্গত কারণেই প্রযুক্তির ব্যবহার, ডেঙ্গু পর্যবেক্ষণের পরিধি বাড়ানো, ডেঙ্গুতে মৃতু্য পর্যালোচনা, চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধিসহ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বছরব্যাপী গৃহীত এই কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে তা ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইতিবাচক প্রভাব আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, মশা বন্ধ্যাকরণসহ প্রযুক্তির ব্যবহারে মশা নিয়ন্ত্রণে পাইলট প্রকল্প শুরু করা হবে। এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানসহ ডেঙ্গু প্রতিরোধে জাতীয় পর্যায়ে কর্মশালায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বাইরে পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশনের কর্মী, গণমাধ্যমসহ অনেককে যুক্ত করা হবে।
চলতি বছর ডেঙ্গুর প্রভাব মারাত্মক হতে পারে- এমন সতর্কবার্তা ছিল স্বাস্থ্য বিভাগের। এ সতর্কবার্তা আমলে নিয়ে যথাযথ উদ্যোগ নেয়া গেলে ডেঙ্গুর এই ব্যাপকতা রোধ করা যেত বলেও মনে করেন বিশ্লেষকরা। কিন্তু সিটি করপোরেশন এ সতর্কবার্তা আমলে নেয়নি, বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে। আবার এটাও ঠিক যে, ২০০০ সাল থেকে প্রতিবছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেও রোগ নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম ছিল না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা বছরে তিনবার ঢাকা শহরে মশার অবস্থা জানতে জরিপ চালিয়ে তাদের মতামত জানাত। ফলে এখন থেকে বিস্তারিত পরিকল্পনাসহ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া পর্যবেক্ষণ এলাকার পরিধিও বাড়ানো হবে। ডেঙ্গু রোগের ধরনে পরিবর্তন আসায় ধরন শনাক্তেও বড় ধরনের গবেষণা করা হবে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আগে ঢাকা, খুলনা ও চট্টগ্রাম এলাকায় নিয়মিতভাবে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হলেও এ বছর ব্যাপকতা বাড়ায় বরিশালও এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে। ময়মনসিংহ ও কুষ্টিয়া এলাকাও এর আওতায় আসবে। অপরদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে গত বছরের তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ বেশি বরাদ্দ প্রস্তাব করেছে ডিএনসিসি।
যেহেতু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এবং প্রাণহানির ঘটনা বেড়েই চলেছে সেহেতু এ ব্যাপারে সরকারের কর্তব্য হওয়া দরকার ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বছরব্যাপী নজরদারির কার্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গে মশা নিধনেরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যক্তি উদ্যোগকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার যে চেষ্টার কথা বলেছেন সংশ্লিষ্টরা, তাও বাস্তবসম্মত বলে প্রতীয়মান হয়। এতে বছরব্যাপী নাগরিকদের কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ বছর রাজধানীর বাইরেও ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ফলে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কার্যকর উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি ব্যক্তিপর্যায়ে সচেতনতার ওপরও গুরুত্ব দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। আমরা মনে করি, এ বিষয়টিও আমলে নিতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবাও নিশ্চিত করা জরুরি।
সর্বোপরি, ২০০০ সালে আমাদের দেশে এ রোগ শুরু হলেও এ বছর দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে দেশবাসীসহ নীতিনির্ধারদেরও। ফলে ডেঙ্গু নিয়ে হেলাফেলার সুযোগ নেই। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থারও সতর্কতা রয়েছে যে, উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে পৃথিবীজুড়ে এ রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ ছাড়া ডেঙ্গু রোগে আক্রান্তদের ৭০ শতাংশ গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে হয়ে থাকে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের দেশও এর মধ্যে পড়েছে। যত খরা, তত ডেঙ্গুর ঝুঁকি। যে কারণে ডেঙ্গু রোগ নিয়ন্ত্রণের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ও তার বাস্তবায়নের বিকল্প থাকা উচিত নয়।