একটু ফিরে তাকানো যাক। সময়টা ২০১৭ সাল। রোগের নাম চিকুনগুনিয়া। আমাদের কাছে একেবারে নতুন। মশা কামড়ালে এ রোগে আক্রান্ত হয় মানুষ। নতুন সেসময় রোগাক্রান্তদের বেশ আতঙ্কিত করে তুলেছিল চিকুনগুনিয়া। তবে এবার আর চিকুনগুনিয়ার দেখা নেই। কয়েক বছর বিরতি দিয়ে এবার উপিস্থিত ডেঙ্গু। ডেঙ্গুও আমাদের পূর্বপরিচিত। কিন্তু এবার চিকুনগুনিয়াকে বিদায় করে দিয়ে ডেঙ্গু আমাদের কাছে উপস্থিত হয়েছে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে। প্রায় এক যুগের বেশি সময় আগে প্রথমে ডেঙ্গুর দেখা মিললেও এখন আর ডেঙ্গু আগের অবস্থানে নেই। এর ব্যাপকতায় কেবল বাংলাদেশেই নয় বিশ্বেরই এখন বিশেষ আলোচিত বিষয়। বিশ্বের ১২৬টি দেশে এই রোগের প্রকোপে দিশেহারা মানুষ। এডিস মশাবাহিত এ রোগে মৃতু্যর মিছিল আমাদের দেশে দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান আতঙ্কের সঙ্গে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে এ বছর ডেঙ্গু প্রায় প্রাদুর্ভাবের আকার ধারণ করেছে। বন্যা। ডেঙ্গু শুরুর আগে এটাই ছিল দেশে খবরের প্রধান শিরোনাম। সেই খবরও বাস্তবিক আমাদের স্বস্তি দেয়নি। তবে ডেঙ্গুর কারণে এই খবর খানিকটা পেছনে পড়ে গেলেও উদ্ভূত পরিস্থিতি মানুষকে বিপাকেই ফেলেছে। বলতেই হবে, এবার অনেক জেলায় বন্যার নতুন রেকর্ড হয়েছে। অনেক জায়গায় পানি নেমে গেলেও কমেনি মানুষের দুর্ভোগ। বন্যা বিষয়টা আমাদের জীবনের সঙ্গে অনেকটা জড়িত। কারণ বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়ায় বন্যার সঙ্গে আমাদের দেশের অর্থনীতির বৈরী সম্পর্ক। কৃষকদের উৎপাদনের ওপর ভিত্তি করে আমাদের অর্থনীতি সবসময় চলমান থাকে। অধিক উৎপাদন আমাদের অর্থনীতিকে রাখে গতিশীল। তাই বন্যায় কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাস্তবিক অর্থে ক্ষতি হয় দেশের।
বলতে দ্বিধা নেই, এই সময়ে আমাদের কাছে বন্যা ও ডেঙ্গু সমার্থক হয়ে গেছে। কারণ দুটি বিষয়ই আমাদের জীবনব্যবস্থাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। অথচ উভয়ের নেপথ্যে রয়েছে মানবসৃষ্ট কিছু কারণ। এখন সারা বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দৃশ্যমান। এর বাইরে নয় বাংলাদেশও। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে পরিবেশের ওপর। প্রতিনিয়ত পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঋতুবৈচিত্র্য ও বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে যাচ্ছে। এমন প্রভাবে আমরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র বিশ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। লক্ষ্য করা যাচ্ছে উষ্ণতা বা তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে মেরুদেশের বরফ গলে যাওয়ায় বাড়ছে সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা। এ ছাড়া এর সঙ্গে প্রতিবছর যোগ হচ্ছে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, তাপমাত্রার আকস্মিক এবং ব্যাপক ওঠানামাসহ নানা অস্বাভাবিক সব পরিস্থিতি। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে আকস্মিক বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের। প্রকৃতির এই খেয়ালিপনায় শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বজুড়েই জনজীবন নানাভাবে প্রভাবিত ও বিঘ্নিত হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের জীবনকে বিস্রস্ত করে তুলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাবে বাংলাদেশের এই স্বাভাবিক চিত্রটি বাস্তবিকই অনেকখানি বদলে গেছে। শুধু বাংলাদেশ বললে ভুল হবে। বিশ্বের অনেক দেশেই এর প্রভাব বিদ্যমান। উপরন্তু বাংলাদেশের ইদানীংকালের জলবায়ুতে দৃশ্যমান পরিবর্তনও দৃশ্যমান। এ তো গেল প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে তা কিন্তু নয়; বরং বিভিন্ন রোগের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ এর সঙ্গে বিভিন্ন রোগেরও সম্পর্ক রয়েছে। দেখা যায় আগে যেখানে মশা জন্ম নিতে পারত না সেখানে এখন ব্যাপক হারের মশা বংশবিস্তার করছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি অতি বৃষ্টির কারণে জন্ম নিচ্ছে এডিস মশা। বৃষ্টির সময় পানি জমে থাকার কারণে এডিস মশার প্রজনন বেড়ে যাচ্ছে। অবশ্য বিষয়টি শুধু যে বাংলাদেশে হচ্ছে তা নয়- জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের অনেক দেশেই জন্ম নিচ্ছে এডিস মশা। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। এখানে একটি পরিসংখ্যান আমাদের সবার মনে আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক তথ্যে বলা হয়েছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এবার শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই এডিস মশার বিস্তার তাই প্রমাণ করে। এখানে সবচেয়ে বড় উদাহরণ ফিলিপাইন। ফিলিপাইনে এবছর প্রায় ৬০০ জনের বেশি মানুষের মৃতু্য হয়েছে ডেঙ্গুজ্বরে। অর্থাৎ এখানে কোনো না কোনোভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব ভূমিকা রাখছে। কখনো সরাসরি আবার কখনো পরোক্ষভাবে। বাস্তবতা হলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শুধু মশা নয়, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে অন্যান্য কীটপতঙ্গ প্রজননের উর্বর ক্ষেত্রও তৈরি হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হলো- বন্যা ও ডেঙ্গুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কি? সহজ কথায়, উপায় আমাদের কাছেই। মানুষের কারণেই যেহেতু বৈশ্বিক পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে তাই মানুষের কাছেই রয়েছে এর সমাধান। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন মানুষের ব্যাপক সম্পৃক্ততা। সবার সচেতনতা। বন্যা হওয়ার প্রধানতম কারণ বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব। এমন বিরূপ প্রভাবের বাইরে নই আমরা। দিন দিন জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি আরও ব্যাপকভাবে আমাদের সামনে আসছে। এর একটাই কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পৃথিবীতে বসবাসরত মানুষের জীবনব্যবস্থায় নেতিবাচক পরিবর্তন লক্ষণীয়। বাংলাদেশও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তাই আমরা নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হচ্ছি প্রায় নিয়মিত। যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বন্যা। অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের সামনে দাঁড়িয়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমগ্র বিশ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
আর ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবও অনেকাংশে দায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। কেননা, আমরা শহরের প্রাকৃতিক জলাধারগুলো দখল-দূষণে জর্জরিত করে তুলছি। কিছু কিছু খাল রয়েছে সেগুলো যেন এক একটি মশা তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে। তাই পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা মানে পরিকল্পিত নগরায়ণ, নগরের জলাধার রক্ষা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জলাবদ্ধতা রোধ, প্রকৃতি রক্ষা, দূষণ রোধের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিলে অনেকাংশে কমে যাবে এসব সমস্যা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের কার্বন নিঃসরণ বিশেষ অনুঘটক হচ্ছে। এজন্যই এর বিরূপ প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে হলে সবুজের বিকল্প নেই। কেননা,
ব্যাপক বনায়নই পারে কার্বন নিঃসরণ রোধ করে প্রকৃতির বৈরিতা থেকে আমাদের অনেকাংশে রক্ষা করতে। কারণ বাংলাদেশে যে পরিমাণ সবুজ থাকার কথা এর বিপরীতে আছে সামান্যই। কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করে প্রকৃতিকে প্রকৃত বন্ধু করে তুলতে পারাটাই হবে আমাদের প্রধান লক্ষ্য। এজন্য প্রয়োজন আমাদের চারপাশকে সবুজে শ্যামল করে তোলা। তাহলে আমরা বন্যা ও ডেঙ্গুর হাত থেকে অনেকটা রক্ষা পেতে পারি।
সাহাদাৎ রানা : সাংবাদিক ও কলাম লেখক