বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীর বাসযোগ্যতা ও বিকল্প ভাবনা

ঢাকা শহরের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে রাজধানী স্থানান্তর কিংবা অন্য কোনো স্থানে প্রশাসনিক রাজধানীর কথা চিন্তা করা যেতে পারে। এতে করে রাজধানী ঢাকার ওপর চাপ অনেকটাই কমে যাবে।
সাধন সরকার
  ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০০:০০

যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)' প্রতিবছরের ন্যায় চলতি বছরও 'বৈশ্বিক বসবাসযোগ্যতা শীর্ষক জরিপ-২০১৯' প্রকাশ করেছে। যথারীতি এ তালিকায় বসবাসযোগ্যতার দিক দিয়ে ঢাকার অবস্থান ১৪০টি শহরের মধ্যে ১৩৮তম। গত বছর এ তালিকায় 'গেস্নাবাল লিভেবিলিটি ইনড্রেক্সে' ঢাকার অবস্থান ছিল ১৩৯তম। ২০১৫ সালেও এ সংস্থার জরিপে বসবাসের সবচেয়ে অনুপযোগী দ্বিতীয় শহর হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল ঢাকা। জরিপে এ বছর বসবাসের সবচেয়ে বেশি ভালো তথা যোগ্য শহর বিবেচিত হয়েছে ভিয়েনা, মেলবোর্ন, সিডনি, ওসাকা ইত্যাদি। আর সবচেয়ে অযোগ্য শহর হিসেবে বিবেচিত হয়েছে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক ও নাইজেরিয়ার রাজধানী লাগোস। ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধবিধ্বস্তে জর্জরিত দামেস্ক শহর বসবাসের অযোগ্য হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে এর কাছাকাছি স্থান হবে রাজধানী ঢাকার! হঁ্যা, ঢাকায় নীরব জীবন যুদ্ধ করে নগরবাসী টিকে আছে। কোনো রকম জরিপ ছাড়াই রাজধানীবাসী প্রতিদিন হাড়ে হাড়ে এই সত্য উপলব্ধি করছে! জরিপে বসবাসযোগ্যতা নির্ধারণে সুপরিসর আঙ্গিকে বেশ কয়েকটি মানদন্ড বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা এবং অবকাঠামো ইত্যাদি। তথ্য সূত্রে, ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা নগরও বটে! এ কথা অবলীয়ায় বলা যায় যে, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও জনবহুলতার কারণে ঢাকায় যে কোনো দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হবে অবর্ণনীয়।

'ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)' বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকা প্রকাশের কয়েকদিন আগে আবার এই সংস্থা কর্তৃক নিরাপদ শহর সূচক-২০১৯' শীর্ষক একটি তালিকা প্রকাশিত হয়। এ তালিকায় বিশ্বের নিরাপদ শহরগুলোর ৬০ শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ৫৬তম। গত প্রায় কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন জরিপে বসবাসঅযোগ্য দেশি-বিদেশি বিভিন্ন শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান প্রথম সারির দিকে! ঢাকা শহরের মানুষকে প্রতিদিন নানা সমস্যার মধ্যে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। বাতাসে সিসা, খাদ্যে ভেজাল, গ্যাস ও পানির সমস্যা বহুদিন ধরে চলে আসছে। গণপরিবহন বলতে যা বুঝায় তা কি ঢাকায় আছে! উচ্চ খরচে চিকিৎসাসেবা পাওয়া গেলেও তার মান নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। একটু বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতায় পড়তে হয় নগরবাসীকে। লাখ লাখ টাকা খরচ করে শহরের রাস্তার ফুটপাতের ড্রেনগুলো প্রতিবছর নতুন করে তৈরি ও খনন করা হচ্ছে। কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনা ও নগরবাসীর সচেতনতার অভাবে তা আবার অকেজো হয়ে পড়ছে। ঢাকার ফুটপাত যাদের জন্য সেই পথচারীরা ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে পারে না। ফুটপাত চলে গেছে দখলকারীদের কব্জায়। সড়কে ও অলিতে-গলিতে তারের জঞ্জাল এ শহরে অন্যতম এক সমস্যা। এমন কোনো মাস নেই যে মাসে ভয়াবহ আগুন লেগে এ শহরে লাখ- কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে না!

টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে শহরবাসীর জন্য স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। দিনে দিনে ঢাকার আকার বাড়ছে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই। জলাভূমি ভরাট হয়েছে, খাল দখল ও ভরাট হয়েছে, কোথাও বক্স কালভার্ট বানানো হয়েছে। ফলে বৃষ্টির পানি নামার কোনো পথ নেই। শিক্ষার্থী ও কর্মজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের যানজটে পড়ে নাকাল হতে হচ্ছে। যানজটের কারণে নগরবাসীর প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা! ঢাকায় যানবাহনের গতি ধারাবাহিকভাবে কমছে। ২০০৪ সালে ঢাকায় যানবহনের গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। এখন তা ৭ কিলোমিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। গণপরিবহনে নারী, শিশু ও বয়স্ক মানুষের ভোগান্তি- হয়রানি যেন নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা! রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনা নগরবাসীর জন্য বাড়তি আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঠ ও পার্কগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে। চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় নগরবাসী উদ্বিগ্ন। মূলত সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় ঢাকার জনসংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

ঢাকায় প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে ১ হাজার ৭০০ জন। পৃথিবীর মেগাসিটিগুলোর মধ্যে জনঘনত্ব সবচেয়ে বেশি ঢাকায়। প্রতি বর্গকিলোমিটারে এখানে ৪৩ হাজার ৫০০ মানুষ বাস করে। নগরবাসীকে উন্নতমানের সেবার প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে বিভক্ত করা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সেবার মান কতটুকু বেড়েছে? ক'দিন আগে ডেঙ্গু মশা নিয়ে তুলকালাম ঘটে গেল। গত প্রায় দু'মাস ধরে শহরবাসীকে রীতিমতো ডেঙ্গু আতঙ্কের মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। এত সব সমস্যার দায় সরকার ও দুই সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না। কত-শত প্রতিষ্ঠান ঢাকার উন্নয়নে কাজ করলেও ঢাকাকে দেখার আসলে কেউ নেই! বুয়েটের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকার ৬৫ শতাংশ ভূখন্ড সবসময় তপ্ত থাকে। প্রচন্ড দাবদাহের এ অবস্থার মূলে রয়েছে পরিবর্তনশীল আবহাওয়া ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ। ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা ও বালু- এ চারটি নদীই আজ দুর্বিষহ দূষণের শিকার। খালগুলো তো বহু আগেই দখল হয়ে আছে। আবার যে খালগুলো টিকে আছে সেগুলোও আবার মারাত্মক দখল-দূষণের শিকার। ঢাকায় সুউচ্চ অট্রালিকার সংখ্যা বাড়ছে। উড়াল সড়কও হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু ঢাকার জীবনযাপন সুগম ও সুন্দর হয়েছে বলে মনে হয় না। বিশেষ করে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্যই এই শহর নরক যন্ত্রণার সমান। এ নগরীতে পানিদূষণ ও বায়ুদূষণের ফলে নতুন নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। ক্ষতিকর বায়ু গ্রহণ করেই এ শহরে জীবনযাপন করতে হচ্ছে! ভারী ধাতুর দূষণ মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। অতি মাত্রায় শব্দদূষণ নগরবাসীকে মারাত্মকভাবে ভোগাচ্ছে। বিল্ডিং কোড না মেনে ও অপরিকল্পিতভাবে ভবন গড়ে তোলার ফলে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপক ঝুঁকিতে রয়েছে রাজধানী ঢাকা।

বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে সমন্বয়ের অভাবের দরুন মাঝেমাঝেই নগরবাসীর বিরক্তির সীমা অতিক্রম করে। রাজধানী ঢাকা যেন শত সমস্যার নগরী! কোনো রাজধানী শহর এভাবে চলতে পারে না। এটা বুঝতে কষ্ট হচ্ছে যে, পরিস্থিতি আর কত খারাপ হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের টনক নড়বে? এখানে পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশের সুন্দর রাজধানীর কথা বলা যেতে পারে যেমন: কুয়ালালামপুর, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর বা দিলিস্ন। কর্তৃপক্ষের সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও নগরের অধিবাসীদের ইতিবাচক সহযোগিতায় বসবাসের জন্য এসব শহর নিরাপদ ও আকর্ষণীয় বলে পরিচিতি লাভ করেছে। মূলত অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে ঢাকার এই করুণ দশা। ঢাকা শহরকে বসবাসের উপযোগী করে তুলতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে থানা ও জেলা শহরগুলোতে সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে ঢাকামুখী মানুষের চাপ কমাতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ব্যাংকিং সেবা বিকেন্দ্রীকরণের ব্যবস্থা করতে হবে। আঞ্চলিক শহরে শিল্প গড়ার উদ্যোগ নিয়ে কর্মসংস্থানের বিকেন্দ্রীকরণ ঘটাতে হবে। রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনা ও গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে তথা দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারলে ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব বলে মনে করি। সর্বোপরি ঢাকাকে বাঁচাতে দরকার সবার অংশগ্রহণ ও ইতিবাচক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের সৎ সাহস। 'আমাদের রাজধানী আমরাই গড়বো' নিরাপদ বসবাসের জন্য আজ এ উপলব্ধি সবার মধ্যে থাকা সবচেয়ে বেশি জরুরি। আগামী প্রজন্মের জন্য হলেও আমাদের বাসযোগ্য রাজধানী ও টেকসই আধুনিক শহর ব্যবস্থাপনার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে সবার আগে। বর্তমান সরকার 'গ্রাম হবে শহর' এ স্স্নোগান নিয়ে গ্রামকে শহর তৈরির যে মহাপরিকল্পনা নিয়েছে তা সত্যিই শুভ উদ্যোগ ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ। তবে এটা কতটা সফল তা সময়ই বলবে। পৃথিবীর অনেক দেশে দুটি রাজধানী আছে। আবার অনেক দেশে রাজধানী সরিয়ে অন্যত্র স্থাপনেরও নজির আছে।

ঢাকা শহরের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে রাজধানী স্থানান্তর কিংবা অন্য কোনো স্থানে প্রশাসনিক রাজধানীর কথা চিন্তা করা যেতে পারে। এতে করে রাজধানী ঢাকার ওপর চাপ অনেকটাই কমে যাবে।

সাধন সরকার: কলাম লেখক ও পরিবেশ কর্মী

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<68912 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1