বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জেলহত্যা ও পূর্বাপর ওমর খালেদ রুমি

বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাকে বাঁচাতে হলে অতীতের মতো আর কোনো ষড়যন্ত্রকে বাংলার মাটিতে সফল হতে দেওয়া যাবে না। দেশনেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
নতুনধারা
  ০৭ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি যে আপাতত সাফল্য লাভ করেছিল তা পাকাপোক্ত করার জন্যই তারা পরবর্তী সময়ে অন্যান্য যে কুকর্ম করেছিল তার মধ্যে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক ঘটনাটি হলো জেলখানায় জাতীয় চার নেতার হত্যাকান্ড। বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী পরিস্থিতি থেকে দেশকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ যখন এক কাউন্টার কু্য'র মাধ্যমে খুনিদের উৎখাত করার বন্দোবস্ত প্রায় করে ফেলেছেন ঠিক তখনি খুনিরা জেলখানায় অবস্থানরত জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মতো ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। খুনিরা বুঝতে পেরেছিল তাদের হয়তো দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। তাই তারা ৩ নভেম্বর দিবাগত রাতে জেলখানায় বন্দি অসহায় চার নেতাকে তাদের কক্ষেই নৃশংসভাবে হত্যা করে। ঠান্ডা মাথায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করতে তাদের বুক যে একটুও কাঁপেনি তা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সময়ে দেয়া সাক্ষাৎকার এবং কথোপকথনেই সুস্পষ্ট। বরং তাদের আচার আচরণ ও প্রকাশ ভঙ্গিতে এমন একটা ঔদ্ধত্য আর অহমিকার প্রকাশ ছিল যেন তারা কোনো মহৎ কর্ম সম্পাদন করেছে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা এবং ৩ নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা মূলত একই সূত্রে গাঁথা। ভুলে গেলে চলবে না ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পরাজিত শক্তির পাশাপাশি যারা বিজয়ীদের দলভুক্ত হলেও মনে প্রাণে পাকিস্তানপন্থি ছিল তারা; রাতারাতি উধাও হয়ে যায়নি। বঙ্গবন্ধুর উদারতার সুযোগ নিয়ে তারা ধীরে ধীরে ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে এবং বিস্তার করতে থাকে নানান ষড়যন্ত্রের জাল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে ব্যর্থ করতে তারা সুগভীর ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকে। একপর্যায়ে তারা সফলও হয়। রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি কিছু উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তার মৌন সম্মতিও তারা উপলব্ধি করতে পারে। আর এভাবেই তারা ধীরে ধীরে সামনে এগোতে থাকে। মূলত স্বাধীন দেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের অস্তিত্বের সংকট দেখা দিয়েছিল- যা তাদের একটা নিদারুণ অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। তারা চাইছিল এ থেকে বেরিয়ে আসতে। এর মধ্যে পাকিস্তান আমলের প্রভাবশালী ধনিক শ্রেণি, মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, বুর্জোয়া ও পেটিবুর্জোয়া শ্রেণি, সামরিক বাহিনীর কিছু উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা এবং তাদেরই অনুগত কিছু মাঝারি সামরিক কর্মকর্তা, স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে দারুণ চাপে থাকা বামদের একটা অংশ এবং সর্বোপরি কিছু ক্ষতমালোভী ও মোনাফেক সরকারদলীয় নেতারা এতে শামিল হয়ে ছিল।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার মাধ্যমে তারা প্রাথমিকভাবে সাফল্য লাভ করে। ধীরে ধীরে গর্তের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে লুকিয়ে থাকা পরাজিত শক্তি এবং তার দোসররা। এ প্রসঙ্গে উলেস্নখ্য যে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর হঠাৎই হাওয়া হয়ে যাওয়া জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী এই অনুকূল পরিবেশে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে দেশব্যাপী তিনি তার সুকণ্ঠের কারণে জনপ্রিয় ইসলামিক বক্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। সে যা হোক, যে কথা বলছিলাম, এ রকম একটা অনুকূল পরিবেশে যাবতীয় বিরোধী আগাছা পরগাছা দ্রম্নত বিকাশ লাভ করতে শুরু করে। পুতুল সরকার খোন্দকার মোশতাক মূলত পরিচালিত হচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের স্টেনগানের মুখেই। বঙ্গভবন ছিল তাদেরই দখলে। কিন্তু সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায় ৩ নভেম্বরে এসে।

ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ কাউন্টার কু্য করলে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয়। খোন্দকার মোশতাককে সরিয়ে তিনি রাষ্ট্রপতি করেন বিচারপতি এ এস এম সায়েমকে। খুনিরা যখন দেখল অবস্থা বেগতিক তখন তারা একটি ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। পরবর্তী সময়ের জন্য বাধা অপসারণের লক্ষ্যে তারা জেলখানায় বন্দি জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এরা হলেন- সর্বজনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন (অব.) মনসুর আলী। খালেদ মোশাররফ বুঝে শুনেই এগোচ্ছিলেন। কিন্তু সাতই নভেম্বরে এসে তিনি ব্যর্থ হলেন। ব্যর্থ যে হলেন তার কারণ আজও উদ্ঘাটিত হয়নি, তবুও একথা তো নিশ্চিত সত্য যে পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ এটাই প্রমাণ করে তার কাছের দুজন মানুষ যেমন- শাফায়াত জামিল এবং নুরুজ্জামানের ভূমিকাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। সবচেয়ে রহস্যময় ভূমিকাটি ছিল সম্ভবত জিয়াউর রহমানের- যিনি ছিলেন তৎকালীন সামরিক বাহিনীর প্রধান। খোন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় বসার পর তৎকালীন সামরিক বাহিনীর প্রধান কে এম শফিউলস্নাহকে সরিয়ে জিয়াউর রহমানকে সামরিক বাহিনীর প্রধান করেছিলেন।

খালেদ মোশাররফ তাকে গৃহবন্দি করলেন। কান্ডজ্ঞানহীন আর আবেগ তাড়িত আহত সিংহ কর্নেল তাহের প্রতি বিপস্নবের নেতৃত্ব দিলেন। তিনি খালেদ মোশাররফকে হত্যা করলেন এবং জিয়াকে মুক্ত করলেন। তার প্রত্যাশা ছিল জিয়া তাকে বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করবেন। ইতিহাস সাক্ষী জিয়াউর রহমান সেই ঐতিহাসিক ভুলটি করলেন না। তিনি তাহেরকে শুলে চড়ালেন এবং নিজের আসন পাকাপোক্ত করেই ক্ষমতায় বসলেন। সামরিক বাহিনীর প্রধান থেকে প্রধান সামরিক প্রশাসক হলেন এবং পরবর্তী সময়ে নিজেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে নিলেন। বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার খুনিসহ সব সমমনাদের বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত করলেন। এই সময় অনেক আওয়ামীপন্থি ও স্বাধীনতাপন্থি বুদ্ধিজীবীকেও তার করুণা প্রার্থী হতে দেখে গেছে। এভাবেই একজন নির্বোধ, মাথামোটা, কান্ডজ্ঞানহীন সামরিক কর্মকর্তা দেশ ও জাতির সর্বনাশের ঘণ্টা বাজিয়ে দিলেন- যা পরবর্তী সময়ে প্রায় ২০০৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন কায়দায়, বিভিন্ন মেয়াদে স্থায়ী হয়েছিল। আর এরকম কয়েকটি ভয়াবহ ঘড়যন্ত্রের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় এই খুনি অপরাধী চক্র ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে নিশ্চিহ্ন করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি হত্যা ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অর্জিত তাদের অতীত সাফল্যই বারবার তাদের উৎসাহিত হতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে। ভুলে গেলে চলবে না যারা একবার কোনো বিশেষ পন্থায় সাফল্য লাভ করে তারা বারবার অনুপ্রাণিত হয় ওই একই পন্থায় সামনে আগাতে। যার লক্ষণ আজও সুস্পষ্ট। বিগত দিনের আগুন সন্ত্রাস, পেট্রোলবোমা এরই সাক্ষ্য বহন করে।

জেলহত্যা মামলা আদালতে বিচারাধীন ছিল। অবশেষে ২০ অক্টোবর ২০০৪ সালে জেলহত্যা মামলার রায় হয় এবং ২৪ আগস্ট ২০০৮ সালে গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের সাজা কার্যকর হয়। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ এই নিয়ে পরপর তিনবার সরকার গঠন করল কিন্তু যদি এমনটা ভাবা হয় যে, শক্র খতম হয়েছে- তা হবে বোকার স্বর্গে বাস করা। পরাজিত শত্রম্নরা ঘাপটি মেরে আছে, অপেক্ষায় আছে, সুযোগ পেলেই ছোবল মারবে। তাই সাধু সাবধান।

বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাকে বাঁচাতে হলে অতীতের মতো আর কোনো ষড়যন্ত্রকে বাংলার মাটিতে সফল হতে দেওয়া যাবে না। দেশনেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

ওমর খালেদ রুমি: কবি, কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<69923 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1