শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রশ্নবিদ্ধ ছাত্ররাজনীতি ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা

এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, ছাত্ররাজনীতির গৌরবদীপ্ত ফসল বর্তমান জাতীয় রাজনীতি। দেশ ও রাজনীতিতে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা এক সময়ে ছাত্ররাজনীতি করেছেন। ঐতিহ্যময় ছাত্ররাজনীতি একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ও লাল-সবুজ পতাকার জন্ম দিয়েছে। সুতরাং ছাত্ররাজনীতি বন্ধ নয়, পরিচালিত করতে হবে ইতিবাচক ধারায়। সেজন্য এর আমূল সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে।
সালাম সালেহ উদদীন
  ১৬ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের হত্যার ঘটনায় দেশবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। দেশ থেকে এর প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে বিদেশেও। সোশ্যাল মিডিয়ায়ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। দলমত নির্বিশেষে আবরারের হত্যাকারীদের শাস্তি দাবি করছেন সবাই। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের পাশাপাশি বিশ্ব গণমাধ্যমে আবরার হত্যার খবর ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে।

বুয়েটে আবরারকে পিটিয়ে হত্যার পর ছাত্ররাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ছাত্রদের নৈতিক স্খলনের ভয়াবহ চিত্র দেখে অবাক হয়েছেন দেশের সচেতন জনসাধারণ। একে একে তাদের নানা অপরাধের খবর বেরিয়ে এসেছে। বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কিনা এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। দেশের সচেতন মানুষ মনে করছেন, শিক্ষার্থীদের উচিত লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হয়ে বিশ্বে স্বদেশের মুখ উজ্জ্বল করা এবং দেশের ভেতরে নানা ধরনের কল্যাণমুখী কাজে অবদান রাখা। তাদের মধ্যে স্বদেশপ্রেম ও স্বদেশী চেতনা জাগ্রত করা। যে বিশ্ববিদ্যালয় ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছে সেখানেও চলছে অনিয়মের মহোৎসব। হলে হলে টর্চার সেলের মাধ্যমে চলছে সাধারণ ছাত্রদের ওপর অকথ্য নির্যাতন। অথচ নির্যাতনের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চুপ। একজন আবরার বাংলাদেশকে অনেক কিছুই দিতে পারত। কিন্তু আমরা আজ তাকে হারিয়েছি। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও সবসময়ই রাজনৈতিক অস্থিরতা লেগে থাকে। আবাসন সংকট, মিছিল, মিটিং ইত্যাদিতে ব্যস্ত ঢাবির ক্যাম্পাস। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোর অবস্থা যদি এমন হয়, তাহলে দেশের অন্যান্য উচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোর অবস্থা কেমন হবে তা বলাই বাহুল্য।

এই পর্যন্ত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫১ জন মেধাবী ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো- একটি হত্যাকান্ডের বিচারেও কারও শাস্তি হয়নি। ঘাতকরা বাংলাদেশে শাস্তি পায় না বরং পুরস্কৃত হয়। কেবল তাই নয়, ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ৩৯ জন নিহত হয়েছে। অন্য ছাত্র সংগঠনের ১৯ জন ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্নমত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে গণতন্ত্রের সূতিকাগার। মতের পাশাপাশি ভিন্নমত থাকবে, এটাই হচ্ছে উচ্চশিক্ষার সৌন্দর্য। কিন্তু এখন প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলছে ক্ষমতার অপব্যবহার, পেশিশক্তির জয়ধ্বনি। বিরোধী মত দমন ও সন্দেহের বশে চলছে নির্যাতন হত্যা। বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করার ঘটনা সেটাই প্রমাণ করে।

আমরা যদি পেছনের দিকে তাকাই তা হলে দেখতে পাবো, ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জীবন দিয়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করেছিলেন। ১৯৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলনে, ১৯৬৯ সালের গণ-অভু্যত্থানেও ছাত্রদের ছিল উলেস্নখযোগ্য ও অগ্রণী ভূমিকা। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের ছাত্ররা যে অবদান রেখেছেন তা জাতি কোনো দিন ভুলবে না এবং শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশের ছাত্রদের যে অসামান্য ভূমিকা তাও অবিস্মরণীয়।

তবে দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, নব্বই দশকের পরে বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতি অনেকাংশেই অপরাজনীতির শিকার হয়েছে। যাদের কাছে জিম্মি সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ক্ষমতার অপব্যবহার যার মূলমন্ত্র। সেই ধারা এখনো সচল ও সক্রিয় রয়েছে। আজ শুধু বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, দেশের স্কুল-কলেজেও ছাত্ররাজনীতি রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছে। এটা জাতির জন্য এক অশুভ বার্তা। আর যাই হোন এমন ছাত্ররাজনীতি তো আমরা চাইনি। দেশ গড়ার বাতিঘর বলা হয় দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে। গৌরবময় ইতিহাস, ঐতিহ্যের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। অথচ আমরা কী দেখতে পাচ্ছি। অসুস্থ ও নোংরা ছাত্ররাজনীতির বলি হচ্ছে দেশের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। তারা স্বাভাবিক জীবনযাপন ও লেখাপড়া করতে পারছে না। সাধারণ ছাত্রদের নির্যাতনের জন্য হলে হলে টর্চার সেল গঠন করা হয়েছে। কথার অবাধ্য হলেই সাধারণ ছাত্রদের ওপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ। ছাত্ররা তো লেখাপড়া করতে এসেছে, অত্যাচার নির্যাতন হত্যার নিষ্ঠুর শিকার হতে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেনি। তারা বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে এসেছে, স্বপ্ন চূরমার করতে নয়। বুয়েট হচ্ছে বাংলাদেশের একটি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। সেখানে দেশের সব মেধাবী শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করে। তারা আমাদের দেশের মহামূল্যবান সম্পদ। তারা দেশকে সমৃদ্ধ করতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমাদের সমাজে বুয়েটের শিক্ষার্থীদের বিশেষ নজরে দেখা হয়। বুয়েটের শিক্ষার্থীদের সমাজের মানুষ আলাদাভাবে সম্মান ও সমীহ করে। আমরা আর চাই না রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আর কোনো মেধাবী আবরারের প্রাণ দিতে হয়। আমরা আবরার হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করি।

আমরা যদি দেশের জাতীয় রাজনীতির দিকে তাকাই তা হলে কী দেখতে পাবো। জাতীয় রাজনীতিতে চলছে পেশিশক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার লুটপাট আর দুর্নীতির মহোৎসব। সম্প্রতি ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি তার বড় প্রমাণ। অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন জনপ্রতিনিধিরাও। এর প্রভাব ছাত্ররাজনীতিতে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। কথায় আছে নগর পুড়িলে দেবালয় কি রক্ষা পায়? আমরা দীর্ঘদিন থেকে লক্ষ্য করে আসছি, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন একের পর এক অপরাধ করেই যাচ্ছে। হেন কোনো অপকর্ম নেই তা তারা করছে না। সাধারণ ছাত্রদের অত্যাচার-নির্যাতন, মারধর, খুন, অপহরণ চাঁদাবাজি ধর্ষণও আধিপত্য বিস্তার এসব যেন নৈমিত্তিক ব্যাপার। সাধারণ ছাত্ররা এদের ভয়ে সবসময় তটস্ত থাকে। আমাদের রাষ্ট্র, আমাদের সংবিধান যে কোনো নাগরিককে ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার দিয়েছে। বাকস্বাধীনতা মানবাধিকারও বটে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ বর্বরতা, হিংসাত্মক নিমর্মতা আর কতকাল চলবে। স্বাধীন দেশে আর কত অপকীর্তি প্রত্যক্ষ করবে জাতি। এ থেকে মুক্তি পাবে না দেশ?

আসলে আমরা আজ যে রাষ্ট্র ও সমাজে বাস করছি সে সমাজ রাষ্ট্র আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। আমরা নানারকম সামাজিক সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হচ্ছি। পা পিছলে ক্রমান্বয়ে নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছি। সমাজের একজন সুস্থ এবং বিবেকবান মানুষ হিসেবে এমন পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী তা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কি সামাজিক ক্ষেত্রে, কি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে- সর্বক্ষেত্রেই অবক্ষয় দেখতে পাচ্ছি, যা একজন শান্তিকামী মানুষ হিসেবে আমরা স্বাধীন ও একটি গণতান্ত্রিক দেশে কল্পনা করতে পারছি না। এ অবক্ষয় ইদানীং আরও প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। সামাজিক মূল্যবোধ তথা ধৈর্য, উদারতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃষ্টিশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, পারস্পারিক মমতাবোধ ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলি লোপ পাওয়ার কারণেই সামাজিক অবক্ষয় দেখা দেয়। যা বর্তমান সমাজে প্রকট। সামাজিক নিরাপত্তা আজ ভূলুণ্ঠিত। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে, দেশের সামগ্রিক যে অবক্ষয়ের চিত্র এর থেকে পরিত্রাণের কোনো পথই কি আমাদের খোলা নেই? আমাদের অতীত বিস্মৃতির অতল গহ্বরে নিমজ্জিত, বর্তমান অনিশ্চিত এবং নিরাপত্তাহীনতার দোলাচলে দুলছে এবং ভবিষ্যৎ মনে হচ্ছে যেন পুরোপুরি অন্ধকার।

যারা সমাজকে, রাষ্ট্রকে পদে পদে কলুষিত করছে, সমাজকে ভারসাম্যহীন ও দূষিত করে তুলছে, সমাজের মানুষের নিরাপত্তা ও অধিকার ক্ষুণ্ন করছে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। চারদিকে যে সামাজিক অবক্ষয় চলছে, চলছে তারুণ্যের অবক্ষয়- এর কি কোনো প্রতিষেধক নেই?

ছাত্ররাজনীতি তার গৌরব হারিয়ে ফেলেছে। ছাত্রসমাজ অতীত ইতিহাস ভুলে তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে। এক সময় ছাত্ররাজনীতি করা ছিল অতি গৌরবের। যারা ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল, সমাজে তাদের আলাদা কদর ছিল। তাদের মর্যাদার চোখে দেখা হতো। দেশের মানুষ জানত, এই ছাত্রসমাজ নিজেদের স্বার্থ বলী দিয়ে দেশ ও মানুষের স্বার্থে রাজনীতি করে। বর্তমান প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন। আমাদের ছাত্রসমাজের অধিকাংশই ছাত্ররাজনীতি বিমুখ। ছাত্ররাজনীতি যেন তাদের কাছে একটা জঞ্জাল ও আতঙ্কের নাম। আমরা দেখি, যখনই যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসে, সেই দলের ছাত্র সংগঠন সারাদেশজুড়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তারা টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, মাদক ব্যবসা, খুন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িত হয়ে যায়। নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে দেশজুড়ে একটা অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা সময়ের দাবি। না হলে আমাদের সামনে কঠিন বিপদ অপেক্ষা করছে।

এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, ছাত্ররাজনীতির গৌরবদীপ্ত ফসল বর্তমান জাতীয় রাজনীতি। দেশ ও রাজনীতিতে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা এক সময়ে ছাত্ররাজনীতি করেছেন। ঐতিহ্যময় ছাত্ররাজনীতি একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ও লাল-সবুজ পতাকার জন্ম দিয়েছে। সুতরাং ছাত্ররাজনীতি বন্ধ নয়, পরিচালিত করতে হবে ইতিবাচক ধারায়। সেজন্য এর আমূল সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে।

একাত্তরের ত্রিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলার স্বাধীনতা জাতিকে যে গৌরব এনে দিয়েছিল সে গৌরব বয়ে নেয়ার উপযোগী শক্তি ছাত্রসমাজ। এরাই ভবিষ্যতের কর্ণধার, দেশের কান্ডারি। তাদের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠা যাতে বাধাগ্রস্ত না হয় রাষ্ট্রকে সেদিকে গভীর মনোযোগ দিতে হবে, রাখতে হবে সতর্ক দৃষ্টি এবং এর কোনো বিকল্প নেই।

সালাম সালেহ উদদীন: কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<71268 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1