শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ রাসেল: একটি শৈশবের অপমৃতু্য নবেন্দু সাহা জয়

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ি সেদিন যেন গণহত্যার মঞ্চ হয়ে উঠেছিল। ঘাতকদের নির্মম বুলেট মাত্র দশ বছর বয়সি এই শিশুটির প্রাণও কেড়ে নেয়, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। কোনো কাকুতি-মিনতি কিংবা নিষ্পাপ মুখশ্রী নিষ্ঠুর দুর্বৃত্তদের মন টলাতে পারেনি।
নতুনধারা
  ১৮ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাস, সময়টা ছিল লড়াই আর যুদ্ধের আভাস। একেকটি দিন বড় অন্ধকার, বড়ই অবরুদ্ধ, অনিশ্চিত। ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সামনে দাঁড়িয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। ইতিহাসের কালো অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটিয়ে রাঙা আভার স্বপ্ন দেখছে এই অঞ্চলের মানুষ। যার হাত ধরে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটবে তার ঘর আলোকিত করে জন্ম নিল এক ছোট্ট শিশু। শিশুটির আগমনে পুরো পরিবারে বয়ে যায় আনন্দধারা। নতুন শিশুকে নিয়ে সবাই উৎসবে মেতে ওঠে। সকাল থেকে রাত সে কী খাবে, কখন ঘুমাবে, কখন গোসল করবে এসব নিয়েই ব্যস্ত সবাই। শিশুর নাম আগেই ঠিক করে রাখা হয়েছিল, নাম রাখা হবে রাসেল। কিন্তু এত নাম থাকতে কেনই বা রাসেল! কারণ শিশুটির মায়ের প্রিয় নাম ছিল রাসেল। মা ছিলেন বই পোকা মানুষ, বই পড়তে ভালোবাসতেন এবং ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের খুব ভক্ত ছিলেন। তাই মহান বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে নামকরণ করা হয় রাসেল। সামনে যুক্ত হয় পারিবারিক টাইটেল, শেষে শিশুটির পুরো নাম হয় শেখ রাসেল।

স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের কথা বলছিলাম। ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবনে আলোকবর্তিকা হয়ে আসে ছোট্ট শিশু শেখ রাসেল। ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবন তখন হয়তো আজকের রূপে ছিল না। দোতলার কাজ তখনও শেষ হয়নি, ধীরে ধীরে বাড়ির কাজ চলছে। নিচতলার উত্তর-পূর্বদিকের ঘরটা ছিল শেখ কামাল ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। সেই ঘরেই রাসেল জন্ম নিল রাত দেড়টায়। রাসেলের জন্মটি পরিবারের সবার কাছে ভিন্ন আনন্দের মাত্রা প্রদান করে। রাসেলের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে বড় ভাইবোনদের সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে রাসেলের পরিচর্যায়। রাসেলের সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নিতেন বঙ্গবন্ধু। সভা-সমাবেশ করে ফিরতে রাত হলেও রাসেলকে ঘুমের মধ্যে আদর করতেন শেখ মুজিব। জন্মলগ্ন থেকেই রাসেল ছিল চঞ্চল প্রকৃতির। সারা বাড়ি সব সময় মাথায় তুলে রাখত। তবে রাসেলের দুর্ভাগ্য বাবাকে খুব বেশি কাছে পায়নি। রাসেলের ছোটকাল কেটেছে বাবাকে ছাড়াই। কারণ তার বাবা রাজনৈতিক বন্দি হয়ে কারাগারে ছিলেন দীর্ঘদিন। বাবাকে দেখতে না পেয়ে মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে আব্বা বলে সম্বোধন করতেন রাসেল। এই চাপা কষ্ট যেমন অনুভব করতেন ছোট্ট শিশু রাসেল ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধুও। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে তার ভেতরের কষ্টের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। 'কারাগারে রোজনামচা' বইয়ে শেখ মুজিব অসংখ্যবার রাসেলের কথা তুলে ধরেছেন এবং তার কাছে যে ছোট্ট সন্তান খুব প্রিয় ছিল সেটিও ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি মাঝেমধ্যে নিজেকে বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতেন ছেলেকে সময় না দিতে পারার কারণে। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনের পর থেকেই রাজবন্দি হিসেবে জেলে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কারাগারে দেখা করার সময় রাসেল কিছুতেই তার বাবাকে রেখে আসবে না। এ কারণেই তার মন খারাপ থাকতো। 'কারাগারের রোজনামচা'তে শেখ রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন : '৮ ফেব্রম্নয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, আব্বা বাড়ি চলো।' কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, 'তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।' ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শেখেনি। তাই মাঝেমধ্যে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে। এই ছিল শেখ রাসেলের প্রতি বঙ্গবন্ধুর দরদ যা ফুটে ওঠে জাতির পিতার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে।

রাসেলের শিক্ষাজীবন শুরু হয় ৪ বছর থেকে। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের মাধ্যমে পড়াশোনা শুরু। প্রথম দিকে পরিবারের কাউকে না কাউকে স্কুলে দিয়ে আসতে হতো। ধীরে ধীরে নিজেই আগ্রহ নিয়ে স্কুলে যেত এবং স্কুলে তার বেশ কিছু বন্ধুও জুটেছিল। বন্ধুবৎসল ছিল রাসেল। পর্যায়ক্রমে পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে ওঠে রাসেল। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে শেখ রাসেলের জন্য একজন গৃহশিক্ষিকা রাখা হয়। শেখ হাসিনার স্মৃতিচারণে জানা যায়, শিক্ষিকাকে খুব সম্মান করতেন শেখ রাসেল। খুব দুষ্টপ্রকৃতির ছিল তাই শিক্ষককে রাসেলের কথা শুনতে হতো নইলে সে পড়াশোনায় মনোযোগী হতো না। তাই শিক্ষিকাও রাসেলের কথা অনুযায়ী শিক্ষাদান করতেন। শিক্ষিকার খাবার-দাবারের ব্যাপারে খুব সচেতন ছিল শেখ রাসেল। প্রত্যেক দিন শিক্ষিকার জন্য দুটি করে মিষ্টি বরাদ্দ থাকতো এবং শিক্ষিকাকে তা খেতে হতো রাসেলের ইচ্ছানুযায়ী। এভাবেই চলছিল শেখ রাসেলের বাল্যকাল।

শেখ রাসেলকে নিয়ে যেন স্মৃতির শেষ নেই। যখনই শেখ হাসিনা বা শেখ রেহানা স্মৃতিচারণ করতে বসেন তখন গলা ধরে আসে, চোখ ভিজে যায়। বেশিক্ষণ বলতে পারেন না কিছু। প্রয়াত সংসদ সদস্য, সাংবাদিক এবং শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী বেবী মওদুদের লেখনীর মাধ্যমে জানা যায়, রাসেল একদিন মাকে জিজ্ঞেস করে, 'মা আব্বার কাছে যাবে না?' মা কোনো উত্তর দেন না। শুধু তাকে বুকের কাছে টেনে আদর করেন। রাসেল আবার জিজ্ঞেস করে, 'মা, আব্বার নাকি ফাঁসি হবে। ফাঁসি কি মা?' মা বলেন, 'কে বলেছে তোমাকে এ কথা?' রাসেল উত্তর দেয়, 'সেদিন কাকা আর দুলাভাই, কামাল ভাই বলছিল, আমি শুনেছি মা।' এমনকি বেবী মওদুদের লেখায় উঠে আসে শেখ রাসেলের 'জয় বাংলা' বলে উচ্চৈঃস্বরে স্স্নোগান দেয়ার ঘটনাও। রাসেল বেশ অনুভূতিপ্রবণ ছিলেন। গল্প শুনতে ভীষণ ভালো লাগত তার। বাড়ির লাইব্রেরি থেকে বই এনে রাসেলকে গল্প পড়ে শোনাত বোনেরা। মজার ব্যাপার হলো, একই গল্প কদিন পর রিপিট করতে গিয়ে দুয়েক লাইন বাদ পড়লেই রাসেল ধরে ফেলত, বলত- সেই লাইনটা পড়লে না কেন? সব কিছু নিয়েই যে তার একটা আলাদা চেতনা কাজ করত ওই বয়স থেকে সেটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার! এ ক্ষেত্রে একটি ঘটনার কথা উলেস্নখ করা যায়। একদিন একটা কালো বড় পিঁপড়া তাকে কামড় দেয়। সঙ্গে সঙ্গে ওষুধ দেয়া হয় কিন্তু আঙুলটা ফুলে যায়। তারপর থেকে সে আর কালো পিঁপড়া ধরতে যেত না কিন্তু ওই পিঁপড়ার একটা নাম দিয়ে দিল। কামড় খাওয়ার পর থেকেই কালো বড় পিঁপড়া দেখলে বলত 'ভুট্টো'!

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়ি সেদিন যেন গণহত্যার মঞ্চ হয়ে উঠেছিল। ঘাতকদের নির্মম বুলেট মাত্র দশ বছর বয়সি এই শিশুটির প্রাণও কেড়ে নেয়, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। কোনো কাকুতি-মিনতি কিংবা নিষ্পাপ মুখশ্রী নিষ্ঠুর দুর্বৃত্তদের মন টলাতে পারেনি।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ। বঙ্গবন্ধু তার নিজের মানুষকে বিশ্বাস করেই সবচেয়ে বড় ধোঁকাটি খেয়েছিলেন সেদিন। ছোট্ট রাসেল অবশ্য এত কিছু বুঝতে পারেনি। সে জানতো না কি ঘটতে চলেছে, কি হতে যাচ্ছে। বুঝে ওঠার আগেই এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে হয়েছিল শেখ রাসেলকে। বত্রিশ নম্বরের দুইতলা থেকে যখন তাকে নিচতলায় আনা হলো তার শিশু মন ভয়ানক ধাক্কা খেয়েছিল। আ ফ ম মুহিতুল ইসলাম যিনি বঙ্গবন্ধুর বত্রিশ নম্বর বাড়ির রিসিপশনিস্ট ছিলেন তিনি এই নৃশংস ঘটনার সাক্ষী। সেই অন্ধকার রাতে রাসেল তাকে জড়িয়ে বলেছিল, 'ভাইয়া ওরা আমাকে মারবে না তো?' মুহিতুল আশ্বস্ত করেছিলেন না, ওরা তোমাকে কিছু করবে না। হয়তো তিনি নিজেও বিশ্বাস করেছিলেন যে, এরকম একটি নিষ্পাপ শিশুর শরীরে কোনো জঘন্যতম পাপীও আঘাত করতে পারে না। কিন্তু মুহিতুলের সেই বিশ্বাস ভাঙতে সময় লাগেনি। রাসেল মায়ের কাছে যেতে চাইলে ঘাতকদেরই একজন তাকে সেখানে নিয়ে যায়। রাসেল সেখানে তার মায়ের মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে অশ্রম্নসিক্ত কণ্ঠে মিনতি করেছিল, আমি হাসু আপার কাছে যাব। কিন্তু ইতিহাসের ঘৃণিত ঘাতকদের মন এতে গলেনি। ঘাতকদের একজন এই সময় শিশু রাসেলকে গুলি করে হত্যা করে। পরবর্তী সময়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যে জাতি যখন এই নির্মম কাহিনী জানতে পারে তখন কারও পক্ষে চোখের পানি রাখা সম্ভব হয়নি। কোনো মানুষের পক্ষে এ ধরনের অপকান্ড করা সম্ভব তা যেন সবার কাছে বিশ্বাসেরও অতীত। আজ থেকে চলিস্নশ বছর আগে শিশু রাসেলের মৃতু্য হলেও শেখ রাসেল আছে এ দেশের প্রতিটি মানুষের অন্তরে।

মৃতু্যকালে শেখ রাসেল ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিরা তাকে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় তাদের অপচেষ্টা শতভাগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। শহীদ শেখ রাসেল আজ বাংলাদেশের শিশু-কিশোর, তরুণ, শুভবুদ্ধিবোধ সম্পন্ন মানুষের কাছে ভালোবাসার নাম। অবহেলিত, পশ্চাৎপদ, অধিকার বঞ্চিত শিশুদের আলোকিত জীবন গড়ার প্রতীক হয়ে গ্রাম-গঞ্জ-শহর তথা বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ জনপদ-লোকালয়ে শেখ রাসেল আজ এক মানবিক সত্তায় পরিণত হয়েছেন।

নবেন্দু সাহা জয়: তরুণ রাজনীতিক ও সমাজকর্মী

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<71534 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1