শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

শিক্ষাঙ্গনের বিপর্যয় বনাম শিক্ষাব্যবস্থা

নতুনধারা
  ১৮ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

বিশ্ববিদ্যালয় হলো একটি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ। বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় জ্ঞান সৃষ্টি, আহরণ ও বিতরণ কেন্দ্র। দেশের সর্বোচ্চ মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিচরণ করে নিজেদের সৎ, যোগ্য, আদর্শবান ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, একটি দেশ ভালো হয়, যদি সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভালো হয়। বর্তমান সময়ে অবশ্য এই উক্তিটি জাদুঘরে স্থান পেতে চলেছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদকে হারিয়েছি। যে আবরার এইচএসএসিতে ঢাকা বোর্ডে টপ ২০-তে ছিল। নটর ডেম কলেজের তার ব্যাচের সেরাদের একজন ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টপ সাবজেক্ট জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং পেয়েছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজেও চান্স পেয়েছিল। বিদেশের একটি নামকরা প্রতিষ্ঠানে নিউক্লিয়ার সাইন্স ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু এসব জায়গাতে ভর্তি না হয়ে সে বুয়েটের টপ সাবজেক্ট তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগে ভর্তি হয়। একজন আবরার বাংলাদেশকে অনেক কিছুই দিতে পারত। কিন্তু আমরা আজ তাকে হারিয়েছি। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও সবসময়ই রাজনৈতিক অস্থিরতা লেগে থাকে। আবাসন সংকট, মিছিল, মিটিং ইত্যাদিতে ব্যস্ত ঢাবির ক্যাম্পাস। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোর অবস্থা যদি এমন হয়, তাহলে দেশের অবস্থা কেমন হবে?

বর্তমানে শিক্ষকদের নৈতিক চরিত্রের যে অধঃপতন শুরু হয়েছে তা দেশের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষাকে বলা হয় জাতির মেরুদন্ড। আর সে মেরুদন্ড গড়ার কারিগর হলেন শিক্ষকরা। শিক্ষকদের দেশের জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশের কর্ণধার ভাবা হয়। সুশিক্ষা, নৈতিকতা, সততা, নিষ্ঠার শিক্ষা দিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে আদর্শ মানুষরূপে গড়ে তুলবেন, এটিই শিক্ষকদের কাছে জাতির প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু আজ শিক্ষক সমাজের চরিত্রেই যেন ঘুণে ধরেছে। সম্প্রতি বেশ কজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, ঘুষ এবং বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে। যা একটি জাতির জন্য হুমকি। যারা জাতিকে সঠিক পথ দেখাবে তারা যদি অভিশপ্ত কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে তাহলে তাদের কাছ থেকে জাতি কি আশা করতে পারে! একজন আদর্শবান শিক্ষক একটি সমাজকে আলোকিত করতে পারেন আবার একজন চরিত্রহীন শিক্ষক একটি সমাজকে ধ্বংসও করে দিতে পারেন।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে সম্বন্ধ অত্যন্ত সত্য হওয়া দরকার। বিদ্যা যে দেবে এবং বিদ্যা যে নেবে তাদের উভয়ের মাঝখানে যে সেতু সেই সেতুটি হচ্ছে ভক্তি-স্নেহের সম্বন্ধ। সেই আত্মীয়তার সম্বন্ধ না থেকে যদি কেবল শুষ্ক কর্তব্য বা ব্যবসায়ের সম্বন্ধই থাকে তাহলে যারা পায় তারা হতভাগ্য, যারা দেয় তারাও হতভাগ্য। রবীন্দ্রনাথ ঠিকই বলেছেন। আজ নিজেকে হতভাগ্য মনে হয়। বর্তমানে ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে ভক্তি-স্নেহের সম্পর্ক নেই বললেই চলে। আজ ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে। মিশেল ফুকোর মতে, আমাদের সমাজটা বিশাল কারাগার। প্রতিটা প্রতিষ্ঠান কারাগার।

বর্তমানে কিছু প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। ইন্টারভিউ নামক একটি নাটকে আনিসুল হক বলেছেন, স্কুলে বাচ্চারা শিখতে আসবে, তারা তো জজ-ব্যারিস্টার হয়ে এসে ভর্তি পরীক্ষা দেবে না। আর স্কুল হতে হবে সবার জন্য, যেখানে কালো-ফরসা, ধনী-গরিব, আইকিউ বেশি, আইকিউ কম, কথা বলতে পারে, কথা বলতে পারে না- সবার সমান সুযোগ থাকবে, কোনো ধরনের বৈষম্য থাকবে না। অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে সন্তান ভর্তি করাতে হলে অভিভাবকের নির্দিষ্ট পরিমাণ মাসিক আয় থাকতে হয়। সরকারের উচিত ব্যবসায়ী এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেয়া।

আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে মেরুদন্ডহীনভাবে দাঁড় করিয়েছি। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থা বলার মতো নয়। যা জাতির কাছে দৃশ্যমান। আমাদের এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে মানবিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে এবং শিক্ষকদের মানবিক হতে হবে। শিক্ষার্থীদের সিলেবাসের পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা, বিতর্ক, কবিতা আবৃত্তি, আউট বই পড়া, সংস্কৃতির চর্চা এবং বিভিন্ন সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বড় একটি সমস্যা হচ্ছে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা আনন্দহীন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, আনন্দহীন শিক্ষা শিক্ষা নয়, যে শিক্ষায় আনন্দ নেই, সে শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষা হতে পারে না। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আনন্দমূলক ও শিশুবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আর শিক্ষককেও আনন্দমূলক শিক্ষার কৌশল রপ্ত করতে হবে। শ্রেণিকক্ষে নাটকীয় ভঙ্গিমায় চিত্তাকর্ষক পাঠদান করতে হবে। শিশুর মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে হবে। এতে তাদের কোমল মনে চিন্তার প্রসারতা ঘটবে। তার মনে বিশ্বকে জয় করার মানসিকতা গড়ে উঠবে। শিশুর শিক্ষার জন্য সমাজকেও ভূমিকা রাখতে হবে। সমাজ হতে হবে শিশুর শিক্ষার উপযোগী। শিশুর বিদ্যালয়ে যাতায়াতসহ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সমাজের দায়িত্ব। সমাজকে শিশুর চিত্তবিনোদনের জন্য খেলার মাঠ, ক্লাব, পাঠাগার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে। বৃত্তিমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে শিশুদের সামাজিকভাবে উৎসাহিত করতে হবে। সমাজকে নিশ্চিত করতে হবে, শিশুর অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের সুব্যবস্থা। প্রতিটি শিশুর শিক্ষা, বেড়ে ওঠা, আচরণসহ সব বিষয়ে সমাজের মানুষকে সচেতন ও সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। মূলকথা হচ্ছে আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ভালো হলে আলোকিত মানুষ তৈরি হবে। আলোকিত মানুষ তৈরি হলে দেশও উন্নত হবে।

আরিফ ইকবাল নূর

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<71535 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1