বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

খাদ্য নিরাপত্তা এবং জলবায়ু পরিবর্তন

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমরা ঠিক কোন কোন সমস্যায় পড়তে পারি তা চিহ্নিত করতে হবে এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। খাদ্য নিরাপত্তা আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। ফলে সমস্যা সমাধানে কেবল পরিকল্পনার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকাই যথেষ্ট নয়। পর্যায়ক্রমে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
অলোক আচার্য
  ২৩ অক্টোবর ২০১৯, ০০:০০

পৃথিবীতে মৌলিক চাহিদার প্রধান হলো খাদ্য। প্রতিটি দেশেই খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি অগ্রাধিকার দেয়া হয়। সবার জন্য খাদ্য এবং তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত করা বর্তমান বিশ্বের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সরকার সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তিনবেলা খাদ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে বর্তমানে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখোমুখি। এর মধ্যে অন্যতম হলো জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর পাশাপাশি জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কৃষিজমি কমে যাওয়ার চাপ। বৈশ্বিক জলবায়ুর দ্রম্নত পরিবর্তন এবং তার সঙ্গে বৃদ্ধি পাওয়া হুমকিগুলো ক্রমেই প্রকট হয়ে ওঠার জন্য খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে। ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তা এবং তার সঙ্গে জড়িত কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেক দেশেই এখন প্রবল সমস্যার মুখোমুখি না হলেও ভবিষ্যতে যে সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত পরিবর্তনের মুখোমুখি বিশ্বের সবদেশকেই কম বেশি হতে হবে এবং তার মোকাবিলাও করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন যে সমস্যা হচ্ছে তা হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বন্যা, জ্বলোচ্ছাস বা ঘূণিঝড়ের কারণে বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকার মানুষ প্রতি বছর সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। সেসব এলাকার মানুষ অপেক্ষাকৃত নিরাপদ স্থানে (শহরাঞ্চলে) জড়ো হচ্ছে। সেখানেই তাদের বাসস্থান এবং জীবিকার সন্ধান করছে। ফলে এসব বাড়তি মানুষের চাপ পড়ছে সেই এলাকায়। ব্যাঘাত ঘটছে খাদ্য শৃঙ্খলে। প্রতি বছরই বন্যার সময় ভাঙনের কারণে বাড়িঘর,জমি-জিরাত সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ। এসব মানুষ কাজের সন্ধানে শহরাঞ্চলে আসছে। ফলে গ্রাম ও শহরের মধ্যে জনসংখ্যার ভারসাম্যে ব্যাপক তারতম্য ঘটছে। এর পাশাপাশি প্রতি বছরই জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটছে। সেই চাপও সামাল দিতে হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে খাদ্য বণ্টনে।

এই সমস্যাটা নিত্য ঘটনা, কিন্তু আজ থেকে একশ বছর পর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কি ঘটবে তার জন্য আমাদের প্রস্তুতি থাকতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে উত্তর মেরুর বরফ খুব দ্রম্নত গলছে। এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে প্রকৃতপক্ষে কি ঘটবে তা বুঝতে পারলেও এবং এটি রোধের উপায় জানা থাকলেও তা যে অত্যন্ত কঠিন কাজ তা সবাই জানি। একমাত্র উপায় হলো বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঠেকানো। পৃথিবী খুব দ্রম্নত উষ্ণ হয়ে উঠছে। যা আমাদের একার কাজ নয়। এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা এবং এর মোকাবিলাও করতে হবে সামষ্টিকভাবেই। কিন্তু আমাদের প্রস্তুতি আমাদেরই নিতে হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পৃথিবীর নিচু অঞ্চলগুলো। এর মধ্যে বাংলাদেশের নাম প্রথম সারিতেই রয়েছে। একটি বড় অংশ সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে দেশের কৃষি খাতে প্রভাব পড়বে। উৎপাদনব্যবস্থার ওপর সরাসরি প্রভাব পড়বে। সে সময় কিভাবে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হবে সেই পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষিতে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে এবং এর ফলশ্রম্নতিতে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। জলবায়ু পবির্তনের ফলে উদ্ভিদের বৃদ্ধি থেকে আরম্ভ করে ফল পরিপক্ক হওয়া পর্যন্ত পরিবর্তন আসছে। কৃষির সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের এই ধারাকে খাপ খাওয়াতে হবে। বিষয়টিকে অভিযোজন বলা হয়। অভিযোজন বা পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া আমাদের সামনে একটি বিকল্প পন্থা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চাল ও গম উৎপাদন হ্রাস পাবে। এ ছাড়াও শাকসবজির উৎপাদনের ওপরেও প্রভাব পড়বে।

ভৌগলিক অবস্থান, ঘন জনবসতি, জীবিকার জন্য প্রকৃতির ওপর নির্ভরতা এবং দারিদ্র্যসহ নানা কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। একটি গবেষণা পরিষদের হিসেবে, ২০০৭ সালের সাইক্লোন সিডরে ৩০ লাখের বেশি মানুষের বাড়িঘর ভেসে গিয়েছিল। সমুদ্রপৃষ্ঠ উঁচু হলে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত উৎপাদনশীল ভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেই অঞ্চল সুরক্ষা করতে এবং সমস্যার সমাধান করতে বিশেষ পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ লবণাক্ত খাবার পানির সমস্যায় পড়েছে। শুধুমাত্র বাংলাদেশের নয় বরং সারা বিশ্বের একটি প্রধান লক্ষ্য হলো ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়ার। সেই লক্ষ্যে অন্যতম বাধা জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়াও, যুদ্ধবিগ্রহও কম দায়ী নয়। কিন্তু যুদ্ধাবস্থা হলো কয়েক বছরের ব্যাপার- যা স্থিতাবস্থা বিরাজ করলে পরিবর্তন করা সম্ভব। আর জলবায়ু হলো সর্বাধিক কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং বিষয়। বিশ্ব নেতারা প্রতিবার জলবায়ু সম্মেলনে পরিবর্তনের মত প্রকাশ করলেও বাস্তবে তাদের কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। আমাদের প্রধান যুদ্ধ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে হলেও আমরা সে লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছি না। এ ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনে নিজের ভাষণে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশে বলেন, অস্ত্রের জন্য নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রশমনের জন্য প্রস্তুতি নেয়া। যুদ্ধ করতে হবে একটা স্বাভাবিক পৃথিবী ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে যে পৃথিবীতে কয়েক হাজার বছর ধরে আমরা বসবাস করছি। অস্ত্র উৎপাদনের জন্য অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা যদি মানুষ হত্যার (অস্ত্র কেনা) বাজেট হ্রাস করি তবেই গবেষণা ও প্রস্তুতির জন্য তহবিল থাকবে।

খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকার হলেও আশ্চর্যজনকভাবে পৃথিবীতে বহু মানুষ তিনবেলা খাদ্য পায় না। প্রতিদিন পৃথিবীতে প্রচুর খাদ্য নষ্ট হয়। মানুষ ডাস্টবিনে ফেলে নষ্ট করে। ঠিক সেই সময় একজন ক্ষুধার্ত থাকে। কিন্তু মৌলিক অধিকারের প্রথম এই চাহিদাটি পূরণ হবে না কেন। এটি কেবল উৎপাদন ব্যবস্থার ঘাটতি নয়। বরং এটি সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থার গাফিলতি। বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন বর্তমান পরিস্থিতি যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেক শক্তিশালী অবস্থানে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের যে লক্ষ্য ছিল তা পূরণ হয়েছে। কৃষিতে নতুন নতুন প্রজাতির ধান উদ্ভাবিত হয়েছে। লবণাক্ততা সহিঞ্চু, রোগ প্রতিরোধক্ষম এবং বন্যা ও খরা সহিঞ্চু বিভিন্ন জাতের ধান উৎপাদন ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন সাধন করেছে। নতুন নতুন কৃষি প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু গ্রামবাংলার অনেক কৃষকের কাছেই এসব আবিষ্কৃত প্রযুক্তি এখনো সহজলভ্য হয়নি। তা ছাড়া উৎপাদিত পণ্যের একটি অংশ উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাত পর্যন্ত পৌঁছাতে নষ্ট হয়। এসব সমস্যা সমাধান করতে হবে। খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা আরো আধুনিকায়ন করতে হবে। এক কথায় আমাদের ভবিষ্যৎ সংকটের মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে হবে। তারও আগে বর্ধিত জনসংখ্যার মোকাবিলা করতে হবে। প্রতিবছর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে। ফলে আমাদের ভবিষ্যৎ খাদ্য চাহিদা মোকাবিলায় যথেষ্ট প্রস্তুতি নিতে হবে। সেই প্রস্তুতি হবে একদিকে ধানের আরও উন্নত জাত উদ্ভাবন করতে হবে এবং প্রযুক্তির ব্যবহার খাটিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থাকে গতিশীল করতে হবে অন্যদিকে জলবায়ু সুরক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমরা ঠিক কোন কোন সমস্যায় পড়তে পারি তা চিহ্নিত করতে হবে এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। খাদ্য নিরাপত্তা আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। ফলে সমস্যা সমাধানে কেবল পরিকল্পনার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকাই যথেষ্ট নয়। পর্যায়ক্রমে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

অলোক আচার্য: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<72269 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1