শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বয়সের চেয়ে বিদ্যার ভার বেশি!

সত্যি বলতে কি, শিক্ষাঙ্গনে কোচিংব্যবস্থা এক মারাত্মক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। তার বিস্তার ঘটেছে বিপুলভাবে। অধিক উপার্জনের জন্য একশ্রেণির শিক্ষক কোচিংয়ে তার মেধা ও সময় ব্যয় করছেন। ফলে উপেক্ষিত হচ্ছে শ্রেণিকক্ষের শিক্ষাদান।
ড. হারুন রশীদ
  ১৩ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার কবিতায় শিশুদের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার কথা বলেছিলেন। এই কথার মূলে রয়েছে একটি শিশুকে যথাযথ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সঠিক শিক্ষা প্রদান। বলা হয়ে থাকে শিশুরাই আগামী........। কাজেই শিশুদের সঠিক পরিচর্যা অত্যন্ত জরুরি। যে জাতি শিশুদের সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে সহায়তা করে না সেই জাতি খুব বেশি দূর এগোতে পারে না। ইউরোপ, আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বে শিশুদের পরিচর্যা করে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে। পরবর্তী সময়ে তারাই দেশ ও জাতিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেয়। আমাদের দেশেও শিশুর পরিচর্যা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে শিশুরা যাতে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে যুগের উপযোগী দক্ষ, মেধাবী ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।

আশার কথা হচ্ছে, একটি শিক্ষিত জাতি তৈরির জন্য নানামুখী চেষ্টা চলছে। শিশুদের স্কুলগামী করার জন্য নেয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। বছরের শুরুতেই বিনামূল্যে ৩০/৩৫ কোটি পাঠ্যবই দেয়া হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। বলা যায়, সে এক বিরাট কর্মযজ্ঞ। সেসব বইয়ের কাগজ ও ছাপার মান উন্নত হচ্ছে। রঙিন হচ্ছে বইয়ের ভেতরের ছবি ও ইলাস্ট্রেশন। এর সবই হচ্ছে- শিশুরা যাতে বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে লেখাপড়ায় মনোযোগী হয় সে জন্য।

এত সবের পরও কোথায় যেন একটি গলদ রয়ে গেছে। শিশুদের শিক্ষার নামে চলছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এ কারণে পাঠ্য বইয়ের বাইরেও নানা ধরনের সহায়ক গ্রন্থ পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এটা যতটা না শিশুদের শিক্ষার জন্য তার চেয়ে বাণিজ্যমুখী প্রবণতাই কাজ করে বেশি। এ জন্য বয়সের তুলনায় বইয়ের বেশি ওজন বহন করতে হচ্ছে শিশুদের। এতে তাদের শারীরিক ও মানসিক নানামুখী সমস্যা হচ্ছে।

এর পরিপ্রেক্ষিতেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্কুলব্যাগে অনুমোদিত বই, উপকরণ ছাড়া অন্য কিছু বয়ে আনা নিরুৎসাহিত করেছে শিক্ষা অধিদপ্তর। সম্প্রতি এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে একটি পরিপত্র জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়গামী শিশুদের জন্য যে সব বই অনুমোদন করেছে তা পরিবহনে কোনো ছেলেমেয়েদের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। যে সব ছাত্রছাত্রী ব্যাগে বই বহন করে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করে হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী এর ওজন যাতে বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিশুর ওজনের ১০ শতাংশের বেশি না হয় সে বিষয়ে সতর্ক হওয়া বাঞ্ছনীয়।

পরিপত্রে আরও বলা হয়, 'ভারী ব্যাগ বহনের কারণে যাতে পিঠে ব্যথা বা সোজা হয়ে দাঁড়ানোর মতো সমস্যা দেখা না দেয়- সে জন্য অনুমোদিত বই, উপকরণ ছাড়া অন্য কিছু ব্যাগে করে বিদ্যালয়ের বয়ে আনা নিরুৎসাহিত করতে হবে।' 'এমতাবস্থায় প্রাথমিক স্তরের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ সব শিক্ষক, বিদ্যালয়ের এসএমসি (বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ) ও অভিভাবকরা বিষয়টি নিশ্চিত করবেন' বলেও পরিপত্রে উলেস্নখ করা হয়েছে।

এই নির্দেশনা অবশ্যই স্বস্তির বিষয়। যে শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ, পড়াশোনার নাম করে তাদের যদি স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে ফেলা দেয়া হয় সেটা হবে অত্যন্ত দুঃখজনক। অভিভাবকদেরও এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। শিশুর কাঁধ থেকে বিদ্যার ভারী বোঝা নামিয়ে ফেলতে হবে। আনন্দময় শৈশব উপভোগ করে প্রতিটি শিশু যেন বেড়ে উঠতে পারে নিশ্চিত করতে হবে সেটিও।

দুই.

শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন একটি নিয়মতান্ত্রিক এবং ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। একটি জাতিকে শিক্ষিত করে তুলতে হলে শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরির্বতন ছাড়া কোনোভাবেই তা সম্ভব নয়। বর্তমান সরকার নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও শিক্ষা ক্ষেত্রে একটি দৃশ্যমান পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছেন। শুধু শত শত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি হয়নি কোটি কোটি ছাত্রের হাতে ঝকঝকে ছাপানো বই পৌঁছে দিয়েছে সরকার এবং তা সময় মতো। শুধু তাই নয়, এ সময়ে একটি যুগোপযোগী এবং আধুনিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়েছে সরকার। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই শিক্ষা নীতির আলোকেই। পঞ্চম শ্রেণি পাস করেই একজন শিক্ষার্থী সার্টিফিকেট পাচ্ছে। এটা তার শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে উৎসাহব্যঞ্জক ভূমিকা রাখছে।

পরিবর্তন এসেছে সিলেবাস কারিকুলামে। পরীক্ষায় সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হয়েছে। শিক্ষায় আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে। বোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নিবন্ধন, ভর্তি প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে পরীক্ষার ফল প্রকাশ হচ্ছে এসএমএস কিংবা অনলাইনে। মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ চালু, টেলিভিশনে দেশের সনামধন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের পাঠদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে। এর সবই শিক্ষাব্যবস্থায় একটি পরিবর্তনের ধারা সূচিত করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এ সংক্রান্ত নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোনো শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের দৈহিক আঘাত, অশালীন মন্তব্য, অশোভন অঙ্গভঙ্গি করতে পারবেন না। মানসিকভাবেও ছাত্রছাত্রীদের কোনো নির্যাতন করা যাবে না। এ নীতিমালা যাতে শতভাগ নিশ্চিত করা যায় সে জন্য শিক্ষক সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষকতার পেশা মহান। যারা শিক্ষাদানকে ব্রত হিসেবে নিয়েছেন সমাজের চোখে তারা মর্যাদাবান। ছাত্রছাত্রীদের কাছে তারা আদর্শস্থানীয়। শিক্ষকের আচার-আচরণ দ্বারা ছাত্রছাত্রীরা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়। এ জন্য তাদের হতে হয় দায়িত্বশীল। বিশেষ করে ক্লাসরুমে পড়ানোর সময় ছাত্রছাত্রীদের ভুলত্রম্নটি ধরার চেয়ে তাদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করার দিকেই জোর দেয়া উচিত।

একজন স্নেহপ্রবণ শিক্ষক ক্লাসের দুর্বল ছাত্রটির কাছ থেকেও সহজেই পড়া আদায় করতে পারেন। কিংবা দুষ্টু ছাত্রকে বশে আনতে পারেন। তবে ভয়ভীতি দেখিয়ে নয়; কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের ওপর কতটা প্রভাব বিস্তার করা যায় সেটা ভাবা উচিত। ছাত্রদের পেটানো, বেত মারা, শারীরিকভাবে আহত করা এগুলো বর্তমান দুনিয়ায় চিন্তাও করা যায় না। শাসন করতে হলে সোহাগ করতে হবে আগে। তবে শাসনের সীমারেখা সম্পর্কেও সচেতন থাকতে হবে। শিক্ষার্থীরা স্কুল-কলেজে ভর্তি হয় জ্ঞানার্জনের জন্য। তারা যদি সব জানবেই তাহলে তো আর বিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হতো না। ছাত্রছাত্রীদের ভুল হতে পারে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাদের ভুলত্রম্নটি শোধরানোর দায়িত্ব তো শিক্ষকদেরই। এ জন্যই তো শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর।

আমাদের সমাজে শিক্ষকরা স্নেহময়, হৃদয়বান মহৎপ্রাণের মানুষ। কিন্তু এমন দু'চার জন শিক্ষক রয়েছেন যারা ছাত্রছাত্রীদের গায়ে হাত তোলেন। গরু-মহিষের মতো পেটান। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এদের কারণেই সমাজে শিক্ষকদের বদনাম হয়। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কটি হওয়া উচিত অত্যন্ত মধুর। সেখানে ভয়ভীতির কোনো স্থান নেই। সরকার যে নীতিমালা করেছে তা সবাইকে মেনে চলা উচিত।

অপরদিকে দীর্ঘদিন ধরে অভিভাবকদের পক্ষ থেকে কোচিংবাণিজ্য বন্ধ করতে সরকারের কাছে দাবি জানানো হচ্ছিল। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। এ সম্পর্কিত রিট আবেদনে অভিযোগ করা হয়, স্কুলের শিক্ষকরা স্কুলের বাইরে কোচিংয়ে ক্লাস করিয়ে বাড়তি টাকা পান বলে স্কুলগুলোতে ঠিকমতো ক্লাস নেন না। কিন্তু সরকার যেহেতু তাদের বেতন দেন, স্কুলে ঠিকমতো ক্লাস নেয়া তাদের দায়িত্ব। তাই শিক্ষকদের কোচিংয়ে ক্লাস নেয়া বন্ধ করার লক্ষ্যে এ আবেদন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এ কোচিংবাণিজ্য বন্ধ করা খুবই জরুরি।

সত্যি বলতে কি, শিক্ষাঙ্গনে কোচিংব্যবস্থা এক মারাত্মক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। তার বিস্তার ঘটেছে বিপুলভাবে। অধিক উপার্জনের জন্য একশ্রেণির শিক্ষক কোচিংয়ে তার মেধা ও সময় ব্যয় করছেন। ফলে উপেক্ষিত হচ্ছে শ্রেণিকক্ষের শিক্ষাদান।

\হআবার এর অন্য একটি অনৈতিক দিকও রয়েছে। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকারও একধরনের চাপ অনুভব করেন শ্রেণিকক্ষের শিক্ষকের কাছে কোচিং পড়াতে। পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার ক্ষেত্রে এটা অনৈতিক কৌশল হিসেবেই বিবেচিত হয়ে থাকে। প্রতিযোগিতামূলক সমাজে সাধারণভাবে পরীক্ষায় ভালো ফল লাভের আশায় শিক্ষার্থীরা কোচিং সেন্টারের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ছে। শ্রেণিকক্ষে যথাযথভাবে পাঠদান করা গেলে, মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে একজন শিক্ষার্থীর কোচিংয়ে পড়ার দরকার হতো না। শিক্ষক এবং ছাত্রের একটি বাস্তবসম্মত অনুপাত রক্ষা করাও সমীচীন।

সুতরাং শিক্ষার উন্নতির জন্য পুরো বিষয়টি সামগ্রিকভাবে বিবেচনা ও বিশ্লেষণ করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বৈষম্য এবং অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে কোচিং ব্যবসা এবং শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশনি বন্ধ করতেই হবে। শিক্ষাকে কিছুসংখ্যক লোকের অনৈতিক বাণিজ্যের ধারা থেকে বের করে আনতে মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে শিক্ষকদের পূর্ণ প্রস্তুতি ও মনোযোগ দিতে। বিশ্বের কোথাও মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এ ধরনের কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনির রমরমা ব্যবসা নেই। বর্তমান বাস্তবতায় কোচিং ব্যবসা বন্ধের পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার মানোন্নয়নে দ্রম্নত ও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

ড. হারুন রশীদ: সাংবাদিক, কলামিস্ট

যধৎঁহথঢ়ৎবংং@ুধযড়ড়.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<75198 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1