শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের রাজনীতির পুনর্পাঠ

আজ বিএনপির নেতানেত্রীরা দলে দলে পদত্যাগ করছেন। তারাও বুঝতে পারছেন দুর্নীতির কারণে জেলবন্দি দলীয় চেয়ারপারসন ও তার দেশপলাতক অভিযুক্ত পুত্রের পক্ষে রাজনীতি করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে এখন রাজনীতি করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই ধারণ করতে হবে। মৌলবাদী অপশক্তিকে ব্যবহার করে বাংলাদেশে আর রাজনীতি করা সম্ভব নয়। উন্নয়নমুখী বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আজ বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা- দিকভ্রান্ত রাজনীতিবিদরা সঠিক পথের দিশা খুঁজে পাক।
মোনায়েম সরকার
  ১৪ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

ষাটের দশক স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ সময়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীন হওয়ার প্রেরণা বাঙালি জাতি মূলত ষাটের দশকের কাছ থেকেই পায়। ষাটের দশকে ক্ষেত্র প্রস্তুতি চলছিল, ১৯৭১ সালে সেই প্রস্তুতিই চূড়ান্ত বিজয়ে রূপ নেয়। ষাটের দশকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমার প্রবেশ। বাম-প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ করলেও পরে মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হই এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। দীর্ঘকাল স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিকে কাছ থেকে দেখেছি এবং এখনো দেখছি। আজকের বাংলাদেশে রাজনীতির যে চিত্র দেখছি তার সঙ্গে আগের রাজনীতির পার্থক্য কি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম তা বুঝতে পারছে না- নতুন প্রজন্মের উপলব্ধির জন্যই বাংলাদেশের রাজনীতির পুনর্পাঠ জরুরি।

বাংলাদেশের রাজনীতি কখনোই সুস্থ স্বাভাবিক ধারায় চলেনি। সূচনাকাল থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ষড়যন্ত্র ছিল। ১৯৭১ সালের শুরু থেকেই তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল বাংলার কতিপয় ষড়যন্ত্রকারী। এ ক্ষেত্রে খোন্দকার মুশতাক ও তাহের উদ্দীন ঠাকুরের নাম প্রকাশ পেলেও আওয়ামী লীগের আরও দুই-একজন প্রভাবশালী নেতার নামও যুক্ত করতে হয়। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র মুক্তিযুদ্ধের কাল থেকেই বাংলাদেশের পিছু নিয়েছে। সেটা সফল হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পরে। জাসদের সৃষ্টি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বিভ্রান্ত করার একটা প্রয়াস। কেন জাসদ সৃষ্টি হয়েছিল সেটা বুঝতে হবে। জাসদই বঙ্গবন্ধুকে রাজনৈতিকভাকে হত্যা করেছে। স্বাধীনতার পরে আমি আবদুলস্নাহ সরকার ও মানবেন্দ্র লারমাকে বাকশালে যোগদান করতে অনুরোধ জানাই। আবদুলস্নাহ সরকার বাকশালে যোগ না দিয়ে জাসদে যায়। মানবেন্দ্র লারমা যায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে উস্কানি দিতে। দুজনেই জড়িয়ে পড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকান্ডে। এমন কর্মকান্ডে সেদিন আরও অনেকেই জড়িয়ে ছিল।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে দীর্ঘদিন বাংলাদেশে রাজনীতি ও বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ নিষিদ্ধ করা হয়। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার রুদ্ধ করা হয়। খুনিদের রাষ্ট্রদূত বানানো হয়। তখনকার সামরিক শাসক যা বলতেন তা-ই ছিল রাজনীতি। মূলত ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অন্ধকার যুগ চলেছে। ১২০১ সাল থেকে ১৩৫০ সাল যেমন বাংলা সাহিত্যে অন্ধকার যুগ বলে খ্যাত, তেমনি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে স্বৈরাচার এরশাদের পতন পর্যন্ত সময়কালও বাংলাদেশের রাজনীতিতে অবক্ষয়ের কাল।

১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে এলে আওয়ামী রাজনীতি নতুন প্রাণ নিয়ে জেগে ওঠার চেষ্টা করে। সে সময়ও চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হয় আওয়ামী লীগ। দলের প্রবীণ নেতাদের দ্বন্দ্বের কারণে দুটি প্যানেলে বিভক্ত হয় আওয়ামী লীগ- একটি প্যানেলের নেতৃত্ব দেন জোহরা তাজউদ্দীন ও ড. কামাল হোসেন, অন্য প্যানেলের নেতৃত্ব দেন আবদুস সামাদ আজাদ ও আবদুর রাজ্জাক। কথা ছিল ভোটাভুুটি হবে। আমি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে ৩৫০০ টাকা দিয়ে হল ভাড়া করলাম, এই টাকা দিয়েছিল আখতারুজ্জামান বাবু। ভোটাভুটি হলো না। পরে শেখ হাসিনাকে সভানেত্রী করে কাউন্সিল শেষ হয়। শেখ হাসিনাকে সভানেত্রী না করলে যে সমস্যার সমাধান হবে না সেটা আমি আবদুর রাজ্জাককে বলেছিলাম। তিনিও আমার কথারই প্রতিধ্বনি করেছিলেন সেদিন। এমনকি আমি পিএন হাকসারকেও শেখ হাসিনার বিষয়ে বলেছিলাম। তিনি তখন বলেছিলেন- ণবং, ুবং, ুড়ঁ পধহ ঁংব :যব বসড়ঃরড়হ ড়ভ ইধহমধনধহফযঁ. এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো- আমি বাম ধারার রাজনীতি করলেও ১৯৭৫-পরবর্তী কাল পর্বে উপলব্ধি করি গণতান্ত্রিক ধারা ছাড়া বাংলাদেশে আর কোনো রাজনৈতিক ধারা স্থায়ী হবে না- তাই মতিয়া চৌধুরীসহ আমরা ১৭ জন আওয়ামী লীগে যোগদান করি ১৯৭৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর।

১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বর বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রার্থী হন ড. কামাল হোসেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাকসহ আমরা সবাই চেয়েছিলাম জেনারেল আতাউল গণি ওসমানিকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করতে, কিন্তু ড. কামাল হোসেনকে প্রার্থী করার ক্ষেত্রে এককভাবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। ৭নং বেইলী রোডে কামাল হোসেনের নিজ বাড়িতে নির্বাচনী অফিস খোলা হয়। এখান থেকেই নির্বাচনী কর্মকান্ড পরিচালনা করি আমরা। সেই নির্বাচনে আমি অর্থ বণ্টনের দায়িত্বে ছিলাম। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা আমার মনে পড়ছে। 'ইতিহাস কথা কও' নামে আমরা একটি গীতি-আলেখ্য করেছিলাম উদীচীর তৎকালীন সভাপতি প্রয়াত সংগীতশিল্পী কলিম শরাফীর নেতৃত্বে ও উদীচীর সহযোগিতায়। গীতি-আলেখ্যটি ক্যাসেট বন্দি করার জন্য কলিম শরাফী আমার কাছে আট হাজার টাকা চাইলেন। আমি তাকে দশ হাজার টাকা দিতে চাইলাম, তিনি দশ হাজার না নিয়ে আট হাজার টাকাই নিলেন। সেদিনে কলিম শরাফীর সততা দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। অথচ আরেকজন নেতা এসে আমার কাছে ৫০ হাজার টাকা চেয়েছিল। আমি জানতাম এত টাকা ব্যয় করার মতো কর্মী তার নেই, তাই তাকে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে বিদায় করি। নির্বাচনে ড. কামাল হোসেন হেরে যান। এ নির্বাচনে হারানো হবে এটা আওয়ামী লীগ আগেই জানতো। তবুও গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার জন্য এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করে।

একটি দেশের রাজনীতিতে উত্থান-পতন হতেই পারে। সময়ের প্রয়োজনে অনেক সময়েই পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে ওঠে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে কতিপয় স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদ যে ভূমিকা অতীতে রেখেছেন এবং বর্তমানে যে ভূমিকা পালন করছেন তা দেশের মানুষ ভালো চোখে দেখছেন না।

আজ আ স ম আবদুর রবসহ অনেকে বড় বড় কথা বলছে, কিন্তু আ স ম রব ও তার স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে অ্যালামনাই সম্মেলনে কয়েক বছর আগে আওয়ামী লীগে যোগদানের ব্যবস্থা করতে বলেছিলেন। মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে কথা বলা ঠিক নয়। তবুও বলি সাদেক হোসেন খোকাও আওয়ামী লীগে যোগদানের প্রস্তাব আমার কাছে করেছিলেন কয়েক বছর আগে। এ প্রস্তাব তিনি ঢাকায় থাকা অবস্থায় ও আমেরিকা থেকেও দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ নেত্রী বলেছিলেন, 'আমাদের এত বড় নেতার দরকার নেই'।

আজ জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দ্রম্নতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের এই উন্নতিতে সবার উচিত দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের স্বার্থে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা। কিন্তু দেশের স্বার্থে কাজ না করে যারা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাদের কোনোদিনই বাংলার মানুষ সমর্থন দেবে না।

আমরা যদি ইতিহাস দেখি, তাহলে দেখব, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পরে ১৯৯৬ সাল এবং ২০০৮ সালেই বাংলাদেশের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যখনি বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তখনি আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশভাবে জয়ী হয়েছে। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ কখনোই ক্ষমতায় যেতে চায়নি। ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ কখনোই আস্থা রাখেনি। অথচ আজ যারা ষড়যন্ত্র করছে তারা মূলত কী চায়? তারা কি চায় বাংলাদেশ আবার পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরে যাক? ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ হয়ে উঠুক স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদীগোষ্ঠীর লীলাভূমি? রাজনীতির মাধ্যমেই একটি দেশ সামনের দিকে অগ্রসর হয়। যদি সেই রাজনীতিতে গলদ থাকে, তাহলে দেশে উন্নতির চেয়ে অবনতিই বেশি হয়।

শেখ হাসিনা ধর্ম যথাযথ পালন করেন, তবে তার অবস্থান ধর্মনিরপেক্ষতায়। তিনি কাউকেই বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করেননি। যেসব ঘাতক তাকে ১৯ বার হত্যার পরিকল্পনা করেছে তাদেরও তিনি কখনো আক্রোশের বশে আঘাত করেননি। একজন মানুষ কতটা দেশপ্রেমিক আর ক্ষমাশীল হলে এমন কাজ করতে পারেন তা আমাদের উপলব্ধি করার সময় এসেছে। গুটি কয়েক লোক নিয়ে গোলটেবিল আলোচনা, ব্যক্তিগত চেম্বারে বৈঠক কিংবা প্রেস ক্লাবের ছোট্ট অডিটোরিয়ামে ১০-১৫ জনের প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশে রাজনীতি করার সময় এখন আর নেই। মানুষের স্বার্থে কাজ করতে হলে এখন এ দেশের রাজনীতিবিদদের গণমানুষের কাতারে নেমে আসতে হবে। মানুষের উন্নয়নের কাজ না করে দেশবিরোধী চক্রান্ত করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে টিকে থাকা আকাশ-কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কি হতে পারে? সাইনবোর্ড সর্বস্ব রাজনৈতিক দলের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। বিশেষ করে বর্তমানে বামপন্থিদের এক শতাংশ ভোটও নেই। এমনকি বিএনপির মতো ওরস্যালাইন পার্টিও আজ বাংলাদেশ-বিরোধী রাজনৈতিক আদর্শ ও স্বাধীনতা-বিরোধী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকার কারণে হুমকির মুখে পড়েছে এবং ব্যাপকভাবে জনসমর্থন হারাচ্ছে।

আজ বিএনপির নেতানেত্রীরা দলে দলে পদত্যাগ করছেন। তারাও বুঝতে পারছেন দুর্নীতির কারণে জেলবন্দি দলীয় চেয়ারপারসন ও তার দেশপলাতক অভিযুক্ত পুত্রের পক্ষে রাজনীতি করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে এখন রাজনীতি করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই ধারণ করতে হবে। মৌলবাদী অপশক্তিকে ব্যবহার করে বাংলাদেশে আর রাজনীতি করা সম্ভব নয়। উন্নয়নমুখী বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আজ বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা- দিকভ্রান্ত রাজনীতিবিদরা সঠিক পথের দিশা খুঁজে পাক।

\হ

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<75353 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1