শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রেন দুর্ঘটনারোধে আমাদের করণীয়

অরক্ষিত লেভেলক্রসিং, অপরিকল্পিত সংযোগ সড়ক এবং অসচেতনতার অভাবের পাশাপাশি রেলে দুর্ঘটনার পেছনে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর অব্যবস্থাপনাও দায়ী।
মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক
  ১৮ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

সড়ক পরিবহণ আইন যখন আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে ঠিক তখন অকাতরে প্রাণ ঝরছে সড়কে। দুর্ঘটনায় বাড়ছে মৃতু্যর মিছিল। কোনোভাবেই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃতু্য ঠেকানো যাচ্ছে না। দুর্ঘটনাও যেন পিছু ছাড়ছে না। অরক্ষিত লেভেলক্রসিং, অপরিকল্পিত ও অননুমোদহীন সংযোগ এবং অসচেতনতার কারণে অকাতরে প্রাণ যাচ্ছে। আলোচিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় দুই ট্রেনের সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন ১৬ জন। গত মঙ্গলবার ভোর পৌনে ৩টার দিকে কসবা উপজেলার ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ১৬ জন নিহত ও শতাধিক যাত্রী আহত হয়েছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলায় দুই ট্রেনের সংঘর্ষের ঘটনা শুধুমাত্র ট্রেনচালকদের উন্নত প্রশিক্ষণের অভাবে সংঘটিত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার পেছনে এ ছাড়াও অবহেলার অভিযোগ অন্যতম। গত একটি প্রতিবেদন দ্বারা জানা যায়, আড়াই বছরে রেল দুর্ঘটনায় (নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-গাজীপুর) মারা গেছেন আট শতাধিক লোক। আহত ও পঙ্গুত্ববরণ করেছেন ছয় শতাধিক। রেলওয়ে পুলিশের হিসাব মতে মৃতুু্যর সংখ্যা ৭০০। বাংলাদেশ রেলওয়ে পুলিশের (জিআরপি) কমলাপুর থানা সূত্র মতে, ২০১৫ সালে রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২৯২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২৪৮ জন, নারী ৪৪ জন। অপমৃতু্য (ইউডি) মামলাসহ মোট মামলার সংখ্যা ২৮৫টি। ২০১৬ সালে রেল দুর্ঘটনায় মারা যান ৩০৫ জন। তন্মধ্যে মধ্যে পুরুষ ২৪৪ জন, নারী ৬১ জন। (ইউডি) মামলাসহ মোট মামলা ৩০৫টি। গত বছর জানুয়ারি থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত মারা গেছেন ১০৩ জন। এর মধ্যে শুধু জানুয়ারিতে ৩২ জন, ফেব্রম্নয়ারিতে ২৫, মার্চে ২৩ ও এপ্রিলে ২২ জন মারা যান।

অরক্ষিত লেভেলক্রসিং, অপরিকল্পিত সংযোগ সড়ক এবং অসচেতনতার অভাবের পাশাপাশি রেলে দুর্ঘটনার পেছনে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর অব্যবস্থাপনাও দায়ী।

রেলওয়ের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিন কারণে রেল দুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে লেভেলক্রসিং দুর্ঘটনা, সিগন্যাল লাইনে ত্রম্নটি এবং উন্নয়ন কাজ চলা অবস্থায় ট্রেন লুপ লাইন কিংবা সাইডলাইনে চলে গিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হয় বলে দেখা যায়। রেল যাতায়াত অনেকটা সাশ্রয়ী ও নিরাপদ হওয়ায় লোকজন রেলে ভ্রমণ করে থাকেন। সরকারও রেলের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। মেট্রো রেলের যুগেও প্রবেশ করতে যাচ্ছে আমাদের দেশ। ভবিষ্যতে রেলপথও বাড়বে। সেই তুলনায় নিরাপদ হয়নি রেল যোগাযোগ। রেলপথের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, এখনো স্পষ্ট নয়।

সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক লেভেলক্রসিং। দেশের দুই হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার রেলপথে প্রায় দুই হাজার ৫৪১টি লেভেলক্রসিং রয়েছে। বেশির ভাগেই কোনো গেট নেই। কোনো সংকেতবাতি ও যান নিয়ন্ত্রণের কোনো কর্মীও নেই। শহরের বাইরে বহু ব্যস্ততম লেভেলক্রসিং রয়েছে। যার দুয়েকটি স্থানে গেটম্যান রয়েছে। বেশির ভাগ ক্রসিংয়ে নেই গেটম্যান। মহাসড়ক, আঞ্চলিক মহাসড়ক, গ্রাম্য সড়ক, বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে রয়েছে এসব লেভেলক্রসিং। ট্রেনের টাইম অনুযায়ী অনেক সময় লেভেলক্রসিং এলাকায় থাকা সাধারণ জনগণ নিজ দায়িত্বে গেটম্যানের কাজ করে। কিন্তু তার পরও ঘটছে ট্রেন দুর্ঘটনা। নিয়ম অনুযায়ী কোনো রেললাইনের ওপর দিয়ে সড়ক নিয়ে যেতে হলে গেট নির্মাণ, কর্মী নিয়োগসহ আনুষঙ্গিক সব স্থাপনা নির্মাণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সেবা সংস্থার। সর্বশেষ দুর্ঘটনায় ১৬ জন মারা গেছেন। নিহতদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের পাশে দাঁড়ানো একান্ত জরুরি। আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। রেল যোগাযোগ নিরাপদ করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা চালাতে হবে। নতুন পরিবহন আইন নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। কিন্তু দুর্ঘটনা কমছে না। একটি ঘটনার রেশ না কাটতেই আরেকটি ঘটনা ঘটছে। প্রতিদিনই গণমাধ্যমে দুর্ঘটনার খবর প্রকাশ হচ্ছে। এসব ঘটনায় হতাহতের সংখ্যাও অনেক। এর জন্য প্রতিকার অত্যন্ত জরুরি।

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্য শুধু একটি পরিবারে গভীর শোক ও ক্ষত সৃষ্টি করে না, আর্থিকভাবেও পঙ্গু করে ফেলে পরিবারকে। কোনো কোনো দুর্ঘটনায় একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি প্রাণ হারায়। তখন পরিবারের যে কী অবস্থা হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যারা পঙ্গুত্ববরণ করে তাদের পরিবারের অবস্থা আরো শোচনীয়। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সড়ক দুর্ঘটনার ফলে বছরে গড়ে বাংলাদেশের জিডিপির দেড় শতাংশ নষ্ট হয়, যার পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা। বিগত ১৫ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৫৫ হাজার মানুষ। আর দুর্ঘটনাজনিত মামলা হয়েছে প্রায় ৭৭ হাজার। এসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনা এখন অন্যতম জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই সমস্যা থেকে মানুষজনকে মুক্ত রাখার সার্বিক পদক্ষেপ গ্রহণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। যে সব কারণে সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয় সবাই কমবেশি জানি। তন্মধ্যে দেশে সড়ক অবকাঠামো এবং স্থলভাগের আয়তন অনুপাতে জনসংখ্যার চাপ বেশি। সড়কের তুলনায় মোটরযানের সংখ্যা বেড়ে গেছে। একই সড়কে চলছে বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার, রিকশাসহ মিশ্র যানবাহন। সড়ক ও মহাসড়কগুলো ত্রম্নটিপূর্ণ। দেশব্যাপী মহাসড়কের অনেক স্থানেই রয়েছে বিপজ্জনক আকা-বাঁকা পথ। এসব আকা-বাঁকা পথের জন্য প্রায়ই জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া অবকাঠামোগত কারণেও দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি ও ঝুঁকি খুব বেশি বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। সম্প্রতি দুর্ঘটনা মহামারি আকার ধারণ করার জন্য যেসব কারণকে দায়ী করা হচ্ছে তার অন্যতম হচ্ছে চালকের অসতর্কতা ও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো। এই সমস্যা বারবার চিহ্নিত হলেও এর কোনো প্রতিকার নেই।

সড়ক দুর্ঘটনা হয় না এমন দেশ নেই। কিন্তু দুর্ঘটনার সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতি যত কমিয়ে আনা যায়, সেটিই লক্ষ্য হওয়া উচিত। ভালো যান, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালক, সড়কব্যবস্থা উন্নতকরণ, সিগন্যালিং ব্যবস্থা আধুনিক ও যুগোপযোগী করার বিষয়গুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দুর্ঘটনায় পতিতদের দ্রম্নত চিকিৎসা পাওয়ার বিষয়টিও অত্যন্ত জরুরি। অনেক সময় আইনি জটিলতার কারণে আহতদের চিকিৎসা দিতে সমস্যা হয়। এ সমস্যাটি সমাধানেও ব্যবস্থা নিতে হবে। রেল ও সড়কপথে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। বিনিয়োগ বাড়ছে। অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধাও বাড়ছে। মেট্রো রেল হচ্ছে। রেলের আধুনিকায়ন এখন দৃশ্যমান। অন্যদিকে উড়াল সড়ক, মহাসড়কগুলো কোথাও চার লেন, কোথাও আট লেন করার কাজ এগিয়ে চলছে। কিন্তু এর সঙ্গে পালস্না দিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা। যে কোনো ব্যবস্থার উন্নয়ন হয় সেখান থেকে যাতে সুফল পাওয়া যায় সে জন্য। রেল ও সড়কপথ নিরাপদ হওয়াটাই এখন দেশের মানুষের একমাত্র চাওয়া। দেশে লাশের মিছিল মানুষ আর দেখতে চায় না। রেল ও সড়ক নিরাপত্তায় নতুন করে ভাবতে হবে। এটাই আমাদের সবার প্রত্যাশা।

মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<75922 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1