শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন এমপিওভুক্তি ও শিক্ষার মান

এমপিওভুক্তির অর্থ, শিক্ষার মান উন্নয়ন হবে এমন ভাবনা সঠিক হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে তা অনেক সময় দেখা যায় না। এমনও উদাহরণ রয়েছে এমপিওভুক্তির পর অনেক প্রতিষ্ঠানের ফলাফল আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। এটা আমাদের জন্য কখনো স্বস্তির খবর নয়।
সাহাদাৎ রানা
  ১৯ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

সম্প্রতি সরকার সারাদেশে ২ হাজার ৭৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তির ঘোষণা দিয়েছে। এটা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক খবর। কারণ দীর্ঘদিন ধরে এমপিওভুক্তির দাবি জানিয়ে আসছিল প্রতিষ্ঠানগুলো। অবশেষে তাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। এবার নতুন এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অধীন স্কুল ও কলেজ রয়েছে ১ হাজার ৬৫১টি। এর মধ্যে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৪৩৯টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১০৮টি। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম ও দশম শ্রেণি স্তরের প্রতিষ্ঠান ৮৮৭টি, উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় ৬৮টি, কলেজ ৯৩টি এবং ডিগ্রি কলেজ ৫৬টি। এ ছাড়া কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের অধীন মাদ্রাসা রয়েছে ৫৫৭টি। এর মধ্যে দাখিল স্তরের মাদ্রাসা ৩৫৮টি, আলিম স্তরের ১২৮টি, ফাজিল স্তরের ৪২টি ও কামিল স্তরের ২৯টি মাদ্রাসা রয়েছে। সরকার একসঙ্গে এতগুলো প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তি করেছে এটা সত্যিই একটি সাহসী সিদ্ধান্ত। সাহসী সিদ্ধান্ত এ কারণে যে, এর সঙ্গে অর্থনৈতিক বিষয়টিও জড়িত। নতুন এমপিওভুক্তির আগেই দেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ২৭ হাজার ৮১০টি। এর সঙ্গে আরও ২ হাজার ৭৩০ যোগ হয়ে হয়েছে ৩০ হাজার ৫৪০টি। সরকারের এই এমপিওভুক্তির সিদ্ধান্ত গত জুলাই থেকে কার্যকর হবে। এটা এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীদের জন্য সত্যিই আনন্দের খবর।

তবে বিপরীতে কিছুটা অসন্তোষ আছে এটাও সত্য। বিশেষ করে যেসব প্রতিষ্ঠান এবার এমপিওভুক্ত হয়নি। তাদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। অবশ্য এমন অসন্তোষ থাকাটা স্বাভাবিক। কারণ সরকারের পক্ষে এক সঙ্গে সব প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা সম্ভব নয়। তারপর বিগত সময়ের তুলনায় এবার অনেক বেশি সংখ্যক প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি হয়েছে। এর আগে সর্বশেষ ২০১০ সালে ১ হাজার ৬২৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছিল। এরপর দীর্ঘদিন দাবি জানিয়ে আসছিল বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকরা। অবশেষে তাদের দীর্ঘ অপেক্ষার পর এবার এক সঙ্গে এতগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি হলো। তবে এর মাঝেও কিছু অভিযোগ রয়েছে। এমপিওভুক্তি পাওয়ার যোগ্য নয় এমন কিছু প্রতিষ্ঠানকেও এমপিওভুক্তি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই এমন প্রতিষ্ঠানও এবার এমপিওভুক্তি হয়েছে। এক রুমের কলেজ কিংবা কয়েক বছর ধরে কোনো শিক্ষার্থী পাস করে না এমন একাধিক প্রতিষ্ঠানও পেয়েছে এমপিওভুক্তির ছাড়পত্র। মিথ্যা তথ্য দিয়ে এমপিওভুক্তি বাগিয়ের নেয়ার অভিযোগও রয়েছে। এমপিওভুক্তির নিয়ম অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ও পাশের হার বিবেচনা করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী এমপিওভুক্ত হতে হলে কলেজ পর্যায়ে অন্তত ৬০ জন পরীক্ষার্থী থাকতে হবে। আর মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ে ৪০ জন পরিক্ষার্থী থাকতে হবে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান থেকে যারা পরীক্ষা দিচ্ছেন তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশ পাসের হার থাকতে হবে। আর মাদ্রাসার জন্য তা ৬০ শতাংশ। কিন্তু এবার অনেক প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি হয়েছে- যারা এসব শর্ত পূরণ করেনি। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যথাযথ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এটা ভালো সিদ্ধান্ত। তবে এসব বিষয়গুলো আরও অনুসন্ধান করে সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হতো। কারণ এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় প্রায় ৯ বছর সময় নিয়ে কাজ করেছে। এই সময়ের মধ্যেও এতগুলো ভুল কোনোভাবেই কাম্য নয়।

এখন এমপিওভুক্তির কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় ১ লাখের বেশি শিক্ষক-কর্মচারীকে সরকারের মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার অনুযায়ী মূল বেতন ও অন্য সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। এটা সরকারের জন্য কিছুটা চাপ হলেও সরকার সেই চাপটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। আর শিক্ষা ক্ষেত্রে কোনো ইতিবাচক চ্যালেঞ্জ নিলে সেই চ্যালেঞ্জে বিজয়ী হওয়াটাও স্বাভাবিক। তবে এর আগে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে এমপিওভুক্তির বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নতুন এমপিওভুক্তির পর প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'যাদের এমপিওভুক্ত করা হলো তাদের এ যোগ্যতা ধরে রাখতে হবে। নীতিমালা অনুযায়ী যোগ্যতা ধরে রাখতে না পারলে এমপিও বাতিল করা হবে। শিক্ষকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, 'এখন না পড়ালেও টাকা পাওয়া যাবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। কারণ শিক্ষার মান ধরে রাখতে না পারলে এমপিও বাতিল করা হবে।' মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই কথাটা অবশ্য শুধু শুধু বলেননি। এখানে প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কার করে দিয়েছেন মান ধরে রাখার বিষয়ে। কারণ এমপিওর ক্ষেত্রে মান খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

\হএমপিওভুক্তির অর্থ, শিক্ষার মান উন্নয়ন হবে এমন ভাবনা সঠিক হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে তা অনেক সময় দেখা যায় না। এমনও উদাহরণ রয়েছে এমপিওভুক্তির পর অনেক প্রতিষ্ঠানের ফলাফল আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। এটা আমাদের জন্য কখনো স্বস্তির খবর নয়।

এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভালো ফলাফল করতে না পারার পেছনে দেখা যায় কোচিং সেন্টারগুলো অনেকটা দায়ী। কারণ কোচিং সেন্টারে অল্প সময় দিয়ে বেশি অর্থ উপাজন করেন শিক্ষকরা। বিপরীতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেশি সময় বা মনোযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে তারা উদাসীন থাকেন। এটা খারাপ ফলাফলের পেছনে বড় কারণ। তাই কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ করতে হবে। অথচ, সরকারের একটি নীতিমালা আছে শিক্ষকরা কোচিং বাণিজ্য করতে পারবেন না। তারপরও তারা কোচিং করাচ্ছেন। এখন সরকারের উচিত হবে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা সরকারের এসব নীতিমালা কতটা অনুসরণ করছেন তা ঠিকমতো দেখা।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান একটি বড়ো বিষয়। কারণ মান বৃদ্ধি করা না গেলে কখনো শিক্ষার ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আসবে না। এ ছাড়া মানহীন শিক্ষা আমাদের জন্য একটি বড় সমস্যাও। এখন যদি এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা মনে করেন তাদের কার্য হাসিল হয়েছে তাই মনোযোগ কমিয়ে দেয়া হোক- তবে তা হবে ভুল সিদ্ধান্ত। কারণ সরকার যেমন ইচ্ছে করলে এমপিওভুক্তি করতে পারে তেমনি আবার তা বাতিল করার ক্ষমতাও সরকারের রয়েছে। তাই সংশ্লিষ্ট সবার এ বিষয়ে আরও মনোযোগী হতে হবে। বিশেষ করে যথাযথ নিয়মকানুন অনুসরণ করতে হবে। তবেই নিশ্চিতভাবে আগামী দিনে এমপিওভুক্তির প্রকৃত সুফল পাওয়া যাবে।

কারণ আমরা লক্ষ্য করছি, এখন আর আগের মতো মানসম্পূর্ণ শিক্ষার্থী উঠে আসছে না দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। এর দায় অবশ্যই ঐসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। এখন এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যথাযথ ভূমিকা নিতে হবে। আমরা সবাই অবগত আছি, প্রতিবছর দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থী উঠে আসছে। যাদের তৈরি করেন মূলত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখন এমপিওভুক্তির ফলে শিক্ষকদের আরও মনোযোগ বাড়বে বলে বিশ্বাস। এসব শিক্ষার্থীদের যদি আরও বেশি পরিচর্যা করা সম্ভব হয় তাহলে উপকৃত হবে দেশ। তাই এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এদিকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অর্থাৎ গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক মানোন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেয়াও অতি জরুরি। কারণ দেখা যায়, যেসব কলেজে কোনো শিক্ষার্থী পাস করে না, সেসব কলেজের বেশির ভাগই হলো গ্রামের কলেজগুলো। অর্থাৎ সরকারকে যেমন দেশব্যাপী মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দিকে নজর দিতে হবে তেমনি সুদৃষ্টি দিতে হবে মানসম্মত শিক্ষা বিস্তারে। ভালো শিক্ষক নিয়োগেও মনোযোগী হতে হবে। এ ছাড়া প্রতিটি উপজেলায় অন্তত একটি করে মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। এতে সব দিক দিয়েই লাভবান হবো আমরা। এর ফলে এক দিকে শিক্ষার্থীরা যেমন রাজধানীমুখী হবে না, অন্যদিকে মানসম্মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির দুশ্চিন্তার বিষয়টাও অনেকটা কমে আসবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই সম্ভব শিক্ষায় বাংলাদেশের আরও অগ্রগতি।

সাহাদাৎ রানা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<76100 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1