শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রেমিট্যান্সযোদ্ধা ও অমানবিক চিত্র

এ দেশের নারীশ্রমিক পাঠানো নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট অনিয়ম, অভিযোগ ও দুর্নীতি। দেশের এক শ্রেণির দালাল অধিক মুনাফা লাভের জন্য নারীশ্রমিক বিদেশে পাঠাচ্ছে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ দেবে এই লোভ দেখিয়ে। কিন্তু বিদেশে গিয়ে তারা জানতে পায়, তাদের আনা হয়েছে যৌনকর্মী হিসেবে। সুতরাং তাদের একদিকে যেমন বিশ্বাস ভঙ্গ হচ্ছে, অন্যদিকে বাধ্য হয়ে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হতে হচ্ছে।
শাহজাহান আবদালী
  ২২ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

এ দেশ থেকে যারা বিদেশে গিয়ে আয়-রোজগার করে যে অর্থ স্বদেশে পাঠায়, তাকেই রেমিট্যান্স বলে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ রেমিট্যান্সযোদ্ধা কর্মরত। ১৯৭৭ সাল থেকে তারা বিদেশে যাওয়া শুরু করেছে। বর্তমানেও সেই ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে।

রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের মধ্যে অধিকাংশই স্বশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত। কখনো কখনো বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে এ দেশের জনশক্তি রপ্তানির এজেন্টগুলোর মধ্যে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরিত হয় লেবার পেশা হিসেবে। সেই লেবার ভিসায় যখন এ দেশ থেকে উচ্চশিক্ষিতরা বিদেশে যায় তখন তাদের লেবারের কাজই করতে হয়। বিদেশিরা সার্টিফিকেট দেখতে চায় না, তারা চায় কাজের দক্ষতা। সেই কারণে উচ্চশিক্ষিত রেমিট্যান্সযোদ্ধারা কেউ কেউ ফেরৎ চলে আসে। উচ্চশিক্ষিত রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকেরই থাকে এক ধরনের অহংবোধ। তারা মনে মনে বলে, উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছি, এ দেশে লেবারের কাজ কেন করব। অপরদিকে যারা স্বশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত তারাই মনের মধ্যে অসীম সাহস নিয়ে যে কোনো কর্ম করে যাচ্ছে। তারা পরিশ্রমকে পরিশ্রম মনে করে না। কষ্টের মালা গলায় ঝুলিয়ে তারা মাসের পর মাস, বছরের পর বছর পার করে দিচ্ছে, শুধু পরিবারসহ আত্মীয়স্বজনদের সুখে রাখার জন্য। তাদের মধ্যে কেউ কেউ খোলা আকাশের নিচে প্রচন্ড রোদ্রে কাজ করে। ফোরম্যানের নির্দেশে কাঁধে করে বিল্ডিংয়ের ছয়তলা কিংবা ১২তলায় সিমেন্টের বস্তা তাদের তুলতে হয়। শুধু তাই নয়, বাসায় এসে রান্না করে খেতে হয়। অনেকে মৌখিকভাবে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে রান্নার কাজ শেষ করে। আজ করব আমি, কাল করবে তুমি। রাতের বেলা একেক রুমে গাদাগাদি করে ১৫/২০ জন থাকতে হয়। বুকসেলফে যেমন বই থাকে, তেমনি রুমের ভেতরে তিন পাশে থাকে মানুষসেলফ। রুমের উপর এবং নিচের মাঝামাঝিতে তৈরি সেলফে রেমিট্যান্সযোদ্ধারা রাতে ঘুমায়। গভীর নিশিতে আত্মীয়স্বজনসহ জন্মভূমির গাছ-পালা, নদী-নালা, পশু-পাখির দৃশ্য চোখের সামনে ছবির মতো ভেসে ওঠে। এসব স্মৃতি তাদের মনে কষ্ট দেয়। কারো কারো দু'চোখে অশ্রম্ন ঝরে। কী করবে, পেটের দায়ে এখানে এসেছে। চলে গেলে সংসারে শুরু হবে অশান্তি। অনেকে মা-বাবার ভিটে-মাটি বিক্রি করে এসেছে। কেউ কেউ এসেছে ঋণ করে। সেই ঋণের টাকা পরিশোধ না করলে নিজের সুনামসহ পরিবারের সীমাহীন ক্ষতি হয়ে যাবে। অনেকে অনুশোচনা করে মনে মনে বলে, দেশে থাকতে কেন পড়াশোনা করিনি। উচ্চশিক্ষিত হতে পারলে দেশে ভালো চাকরি পাইতাম। এ দেশে এসে গোলামি করতে হতো না।

সেই কারণেই তারা ছোট ভাইবোন কিংবা কেউ কেউ নিজের সন্তানকে চিঠিতে অথবা ফোনে বারবার পড়াশোনার জন্য তাগিদ দেয়, তোমরা ঠিকমতো পড়াশোনা করবে। বিদেশে এসে বুঝতে পেরেছি লেখাপড়া কী জিনিস। বিদেশি ফোরম্যানের অধীনে কাজ করতে হয়। কখনো কখনো ফোরম্যানের ধমক খেতে হয়। কিছুই করার নেই। তাদের মতো পড়ালেখা জানলে নিজেও ফোরম্যান হতে পারতাম।

মানসিকভাবে তাদের কষ্টের অন্ত নেই। কেউ কেউ বিদেশে থাকাবস্থায় জানতে পারে, সন্তানের পিতা হয়েছে। সন্তানের মুখ সরাসরি দেখার সুযোগ নেই। বর্তমানে অনেকেই মোবাইলে ছবি তুলে ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে নবাগত সন্তানের ছবি পাঠাচ্ছে। ১০ বছর আগে তাও সম্ভব ছিল না। তখন যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল চিঠিপত্র। কোনো কিছু চাওয়া-পাওয়া থাকলে কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় নিয়ে আদান-প্রদান করতে হলে এক মাস লেগে যেত। এখন অনেক সুবিধা হয়েছে। মোবাইলে কিংবা ইমোতে সরাসরি কথা বলা সম্ভব হচ্ছে।

সত্যিকার অর্থে রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের পরিশ্রমেই দেশটি টিকে আছে। এ দেশে তাদের সঠিক মূল্যায়ন হয় না। অনেক কষ্টের ও পরিশ্রমের উপার্জিত টাকা দেশে পাঠাচ্ছে। সেই সঙ্গে দেশটিও উন্নয়ন হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে, অথচ তারা এ দেশের এয়ারপোর্টে এসে হতবাক হয়ে যায়। এয়ারপোর্টের কর্মকর্তা ও কর্মচারিরা তাদের সঙ্গে অনৈতিক আচরণ করে থাকে। মালামাল চেক করার নামে অনেকে তাদের জিনিসপত্র হাতিয়ে নেয়। অনেকে তাদের মালামাল টেনে-হিঁচড়ে ছিনিয়ে নেয়। তারা শুধু অসহায় মনোভাব নিয়ে হা করে তাকিয়ে থাকে। মুখের ভাষা তারা হারিয়ে ফেলে। মনে মনে বলে, এ কোন দেশে এলাম?

এ দেশের রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের রয়েছে সীমাহীন ক্ষোভ ও অভিযোগ। কোনো কারণে সে দেশে কারো মৃতু্য হলে সেই লাশটি এ দেশের সরকার সরকারিভাবে দেশে আনার ব্যবস্থা করে না। আপরদিকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের কোনো নাগরিকের মৃতু্য হলে সেই দেশের সরকার সরকারি খরচে লাশটি তাদের দেশে নিয়ে যায়। অথচ, এ দেশের নাগরিকরা বাংলাদেশের হাইকমিশনার অফিসে গিয়ে শতবার যোগাযোগ করেও কোনো ফল পায় না। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অতি শিগগির সরকার মনুষ্যত্ব ও মানবতার দিক বিবেচনা করে এটির সমাধানের জন্য সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া উচিত।

এ দেশের নারীশ্রমিক পাঠানো নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট অনিয়ম, অভিযোগ ও দুর্নীতি। দেশের এক শ্রেণির দালাল অধিক মুনাফা লাভের জন্য নারীশ্রমিক বিদেশে পাঠাচ্ছে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ দেবে এই লোভ দেখিয়ে। কিন্তু বিদেশে গিয়ে তারা জানতে পায়, তাদের আনা হয়েছে যৌনকর্মী হিসেবে। সুতরাং তাদের একদিকে যেমন বিশ্বাস ভঙ্গ হচ্ছে, অন্যদিকে বাধ্য হয়ে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হতে হচ্ছে।

সে দেশের পুরুষগুলো তাদের ওপরে চালায় অমানবিক যৌন নির্যাতন। কান্নাকাটি করে বাধা দিলেও তাদের কপালে জুটে থাপ্পড়সহ নানা শারীরিক নির্যাতন। তাদের সাফ কথায়, কয়েকগুণ বেশি টাকা দিয়ে তোদের আনা হয়েছে এই কাজ করার জন্য।

তাদের ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হয় না। পুলিশকে ধরিয়ে দেবে সেই ভয়ও দেখায়। এই অপকর্ম থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অশ্রম্নসজল কণ্ঠে আত্মীয়স্বজনের কাছে গোপনে ভিডিও করে পাঠায়। কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এমন পরিস্থিতিতে এ দেশের সরকার দালাল ও প্রতারকদের ধরে এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে এ ধরনের অপকর্ম কাজ দিনে দিনে বাড়তে থাকবে এবং পাপের বোঝাও ভারী হবে। রেমিট্যান্সযোদ্ধারা গ্রামে এসেও অবমূল্যায়নের শিকার হন। তারা যেন অবহেলার পাত্র। বিদেশে থাকাকালীন সময়ে এ সংগঠন, সে সংগঠন কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কত না টাকা দিয়েছে। কিন্তু সেসব প্রতিষ্ঠানে নানা বিষয়ে অনুষ্ঠান হলে তাদের নেই কোনো সম্মানজনক চেয়ার। কারণ একটাই, তাদের মধ্যে অনেকেরই নেই সার্টিফিকেট। এ দেশের শিক্ষিত ও সমাজপতিদের আচরণে তারা ভীষণ কষ্ট পায়। সেই কারণেই অনেকে স্বদেশে এসে ঘর থেকে বের হতে চান না। বিদেশে পরিশ্রম করলেও মন্দের ভালো হিসেবে তারা মানসিকভাবে শান্তিতে থাকে। সেখানে নেই কোনো ভন্ডামি। অনেকে ছয় মাসের ছুটি নিয়ে এলেও তিন মাসের মাথায় চলে যায়। তারা কর্মজীবনের হিসাব মিলাতে পারে না। বাড়িতে পাঠানো টাকা পরিবারের কাছ থেকে সঠিক হিসাব পায় না। তারা যেন দুঃখ-শোকের ঠিকানাবিহীন পথযাত্রী।

\হ

শাহজাহান আবদালী: শিশুসাহিত্যিক ও রম্যলেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<76477 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1