বর্তমানে সারাদেশে কোচিং বাণিজ্যের দৌরাত্ম্য কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ভালোভাবেই জানেন। কোচিংয়ের নামে প্রতিষ্ঠানগুলোয় দুর্নীতিসহ নানা অনৈতিক কার্যকলাপ চলে। অনেক শিক্ষক কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনির সঙ্গে অতিমাত্রায় জড়িয়ে পড়ায় ভালোভাবে ক্লাস নেন না। শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে প্রলুব্ধ করেন। যারা কোচিং করে, পরীক্ষায় তাদের বেশি নম্বর দেন। এসব অভিযোগ তো আছেই, কিছু শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোচিংয়ের সুযোগে ছাত্রীদের ওপর যৌন নির্যাতন চালানোর মতো গুরুতর অভিযোগও উঠেছে বিভিন্ন সময়।
এ ছাড়া বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গেও কোনো কোনো কোচিং সেন্টার জড়িত বলে অভিযোগ আছে। কোচিংয়ের আড়ালে বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের মতাদর্শ প্রচারের অভিযোগ অনেক পুরনো। এসব কারণে সমাজে কোচিং ব্যবসা বন্ধের দাবি দীর্ঘদিনের। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষামন্ত্রী নিজেও কোচিংকে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অনৈতিক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তবে তিনি বলেছেন, ক্লাসে ঠিকমতো পড়াশোনা হয় না। ক্লাসে পুরো শিক্ষা শেষ করা হলে কোচিং বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি বাস্তবতার নিরিখে একথা বলেছেন সন্দেহ নেই। তবে কোচিংয়ের দ্বার অবারিত রেখে ক্লাসে ঠিকমতো পড়াশোনা নিশ্চিত করা সম্ভব কিনা, সে প্রশ্ন থেকেই।
কোচিং বাণিজ্য আজ এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, তা ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামগঞ্জেও। এটা বিশেষ করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বিষফোড়ার আকার ধারণ করেছে। অনেকে মনে করেছিলেন, সৃজনশীল পদ্ধতির প্রচলনে কোচিং বাণিজ্য নিরুৎসাহিত হবে কিন্তু সৃজনশীল পদ্ধতিতে কোচিং আরো জেঁকে বসেছে। এখন স্কুল কর্তৃপক্ষই ভালো রেজাল্টের অসিলায় নিজেরাই স্কুল কোচিং চালু করেছে। স্কুলে ক্লাস শেষ করে আবার কোচিং। এটা অনেকটা বাধ্যতামূলক। বিশেষ করে পঞ্চম ও ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য।
পিএসসি ও জেএসসিতে ভালো ফল করার প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে বিভিন্ন স্কুলের ভেতরেই কোচিং চালু করেছে। এতে শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ তো বাড়ছেই অভিভাবকদেরও বাড়তি পয়সা গুণতে হচ্ছে। সবচেয়ে অবাক করার মতো ব্যাপার হচ্ছে স্কুলের কোচিংয়েও অনেকটা নিয়ম রক্ষার। সেখানে তেমন পড়াশোনা হয় না। এরপর আবার প্রাইভেট কোচিংয়ে পড়তে হয়। ফলে একজন শিক্ষার্থী সকালে স্কুলে গিয়ে ফিরে সন্ধ্যায়। এটা যে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য কত বড় চাপ সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।
বাস্তবতা হচ্ছে কোচিং নিষিদ্ধ থাকলেও তা থেমে নেই। সরকার যদি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ক্লাসে ভালোভাবে পড়ানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে এমনিতেই কোচিং নিরুৎসাহিত হবে। সে ক্ষেত্রে শিক্ষকদের হতে হবে শিক্ষার্থীর প্রতি যথেষ্ট যত্নশীল। দুর্বল শিক্ষার্থীর প্রতি দিতে হবে বিশেষ দৃষ্টি। প্রয়োজনে ক্লাসের বাইরে বা বিশেষ ক্লাস নিয়ে তার ঘাটতি পূরণ করতে হবে। এ জন্য তার কাছ থেকে অর্থ নেয়া চলবে না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিজ দায়িত্বেই এটা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে মূল দায়িত্বটি অবশ্যই শিক্ষকের। কারণ তারাই প্রাইভেট বা কোচিংয়ের ক্ষেত্র তৈরির জন্য ক্লাসে অবহেলা করেন। কোচিং বন্ধে দায়িত্ব রয়েছে অভিভাবকদেরও। তারা সন্তানের বেশি নম্বরের আশায় তাকে নির্দিষ্ট শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়াতে উদ্বুদ্ধ করেন। সে ক্ষেত্রে পরীক্ষায় নম্বর বা ফলটাই হয়ে উঠে মুখ্য, সন্তান কতটা মানসম্পন্ন শিক্ষা গ্রহণ করছে তা নিয়ে যেন কারও মাথাব্যথা নেই। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান নিশ্চিত করার স্বার্থেই কোচিং বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ জরুরি হয়ে পড়েছে।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষা খাতে সবসময়ই কম বরাদ্দ দেওয়া হয়। শিক্ষকদেরও পরিবার-পরিজন রয়েছে। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য রক্ষা করতে গিয়ে তারা হিমশিম খান। এক শ্রেণির শিক্ষকের নৈতিক অধঃপতনের দায় পুরো শিক্ষক সমাজের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সমীচীন নয়, আমরা এটা মানি। তাই অধঃপতিত শিক্ষকদের শনাক্ত করাও আজ সময়ের দাবি। কোচিং সেন্টারে মেয়ে শিক্ষার্থীদের যৌন নিপীড়নের ঘটনাও ঘটেছে। তবে আশার কথা হলো, সমাজ ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। গণমাধ্যম তার সতর্ক দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে। সম্মিলিতভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে সাধারণ মানুষ। আমাদের প্রত্যাশা, বিলম্ব হলেও বাংলাদেশে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। কোচিংয়ের অভিশাপ থেকে জাতি মুক্তি পাবে।
শিক্ষার মানোন্নয়ন একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইসু্য। শুধু পাসের হার এবং উচ্চতর গ্রেডই শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য নয়, পাশাপাশি নৈতিক মানসম্পন্ন সুনাগরিক হিসেবে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলাই শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলো শিক্ষার মান ও শিক্ষার্থীর নৈতিক মানোন্নয়নের বদলে প্রতিষ্ঠানের পাসের হার ও জিপিএর প্রতি বিশেষ নজর দেয়ায় শিক্ষা ব্যবস্থায় মানহীনতা দেখা দিয়েছে। শিক্ষার্থীরাই পাস করে শিক্ষকসহ সমাজের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন। মানহীন ও নৈতিকতা বিবর্জিত, সার্টিফিকেট নির্ভর শিক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়ার ফলে সমাজে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইভ-টিজিং, শিক্ষকদের মানহীনতা থেকে ছাত্রীদের যৌন নির্যাতন ও হয়রানির মতো ঘটনা ঘটছে।
শিক্ষামন্ত্রীর ভাষায় এসব ঘটনা শুধু অনাকাঙ্ক্ষিত নয়, এটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য কলঙ্কজনক। এ কথা সত্য যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাদানের যথার্থ মান রক্ষিত না হওয়া এবং শ্রেণিকক্ষেও শিক্ষকদের অমনোযোগিতা ও অদক্ষতার জন্যই ভালো ফলাফলের আশায় শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট কোচিং অথবা টিউশনির দিকে যেতে হয় এবং কোচিং ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের বেশিরভাগই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক।
বর্তমান বাস্তবতায় কোচিং বাণিজ্য বন্ধের পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার মানোন্নয়নে দ্রম্নত ও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটি এবং অভিভাবকদের সক্রিয় তৎপরতা থাকলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সব ধরনের দুর্নীতি, অপতৎপরতা এবং কোচিং ব্যবসার মতো কর্মকান্ড বন্ধ করা সম্ভব।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি, বৈষম্য এবং অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে কোচিং ব্যবসা এবং শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশনি বন্ধ করতেই হবে। শিক্ষাকে কিছুসংখ্যক লোকের অনৈতিক বাণিজ্যের ধারা থেকে বের করে আনতে মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে শিক্ষকদের পূর্ণ প্রস্তুতি ও মনোযোগ দিতে।
বিশ্বের কোথাও মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এ ধরনের কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনির রমরমা ব্যবসা নেই। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও মনোযোগের বদলে প্রাইভেট টিউশনি ও কোচিং সেন্টারে বেশি সময় দেয়ার পাশাপাশি অনৈতিক পদ্ধতিতে পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের নিশ্চয়তা দেয়ার কারণে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা সন্তানদের কোচিং সেন্টারে ভর্তি করাতে প্রলুব্ধ অথবা বাধ্য হন। আমাদের শিক্ষাঙ্গন থেকে এ অনৈতিক ব্যবসা বন্ধ করতে শিক্ষার্থীদের কোচিং সেন্টারে ভর্তি ও খরচ না জোগাতে অভিভাবকদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শিক্ষার মানোন্নয়নে নৈতিক শিক্ষার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়ার পাশাপাশি ভিনদেশি অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ রোধে, অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সব সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রাখতে হবে।
নবম পে-স্কেলে শিক্ষকদের বেতন বেড়েছে। তবে তুলনামূলক কম। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য রয়েই গেছে। এটা দূর করতে হবে যে কোনো মূল্যে। শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণদানের পাশাপাশি দক্ষ, মেধাবী ও সঠিক যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের শিক্ষকতার পেশায় আকৃষ্ট করতে শিক্ষকদের বেতন কাঠামো ও সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি ও বেতন বৈষম্য দূর করার বিষয়ে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ড. হারুন রশীদ: সাংবাদিক, কলামিস্ট
যধৎঁহথঢ়ৎবংং@ুধযড়ড়.পড়স