বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণ: ভয়াবহ অবক্ষয়ের চিত্র

ধর্ষণ এখন নির্দিষ্ট কোনো ভৌগোলিক স্থানে সীমাবদ্ধ নেই, এটি এখন নির্দিষ্ট কোনো দেশের সমস্যা নয়। এটি বৈশ্বিক সমস্যা। ধর্ষণ চলছে দেশে দেশে। নারী যখন বেশি অসহায় অবস্থায় নিপতিত হয় তখন ধর্ষণের মাত্রা আরও বেড়ে যায়।
মাছুম বিলস্নাহ
  ২৮ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

ভয়াবহ রকমের অবক্ষয় যেন সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছে। আমাদের মনে অছে, নুসরাতের সঙ্গে গোটা বাংলাদেশ কেঁদেছিল। নুসরাতের হত্যার রায় দেয়া হয়েছে, যা অনেকটাই স্বস্তির কারণ; কিন্তু হত্যা, ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন কি থেমে যাবে? নিম্নপর্যায় থেকে উচ্চপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নের বহু অভিযোগ আমাদের সামাজিক ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ আছে। নিপীড়ক কখনো শিক্ষক, কখনো সহপাঠী কিংবা অন্য কেউ। তবে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-েেদৗলা বর্বরতার যে নজির সমাজ ও রাষ্ট্রের সামনে দাঁড় করিয়েছে, এর ক্ষত অনেক গভীর এবং চরম মর্মন্তুত্মদ। নুসরাত জাহান রাফির চিরবিদায় আমাদের মনে যে গভীর দাগ কেটে দিয়েছে তা সহজে মুছবে না। বরং এমন পৈশাচিক ঘটনা আমাদের সামনে অনেক প্রশ্ন দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। শিক্ষাঙ্গনকে বলা হয় সেকেন্ড হোম। কিন্তু সেখানকার পরিবেশ কতটা নিরাপদ- এ প্রশ্নের উত্তর কিন্তু বের করতে পারিনি। শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ যদি আনন্দদায়ক এবং নিরাপদ না হয়, তাহলে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীর জন্য তা অমঙ্গলই ডেকে আনে। নুসরাত হত্যার বিচার হয়েছে, অনেকটাই আনন্দের সংবাদ তবে তনু হত্যার বিচার আজও হয়নি। এ রকম দৃষ্টান্ত আরও আছে। ভারতের চম্বলের বিশ্ববিখ্যাত নারী দসু্য ফুলন দেবী গণধর্ষনের শিকার হয়েছিলেন। প্রতিক্রিয়ায় দসু্য হয়েছিলেন। ধর্ষকদের হত্যা করেছেন। তিনি যখন আশির দশকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন এবং সংসদ সদস্য হন, নারীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। তারা একজন আইকন পেয়েছেন- এমন বিশ্বাসে অনেক নারীবাদী ও নারী এনজিওকর্মীরা আশা করেছিলেন, তিনি ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের রোল মডেল হয়ে উঠবেন। আশাবাদীদের মধ্যে লেখক, সাহিত্যিক, সম্পাদক, বুদ্ধিজীবীরাও ছিলেন। অরুন্ধতী রায়ও তাদের একজন। তার নেতৃত্বে আসলেই ধর্ষণবিরোধী সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠার সুযোগ ছিল। সেই সময় ধর্ষণবিরোধী ব্যাপক জনমতও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। নারীরা জোর গলায় বলছিলেন, ধর্ষণবিরোধী সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্বের গুরুভার নারীদেরই নিতে হবে।

দসু্য ফুলন দেবীর ধর্ষণ-ঘটনা নিয়ে শেখর কাপুর ১৯৯৪ সালে 'ব্যন্ডিট কুইন' সিনেমাটি বানালেন। মোটাদাগে সিনামাটিকেও ধর্ষণবিরোধী বক্তব্যের সিনেমা বলা যায়। কিন্তু ফুলন দেবী সত্যবিকৃতির অভিযোগে তীব্র আন্দোলন শুরু করলেন। মিডিয়ায় মিডিয়ায় অভিযোগ দায়ের করে বেড়ালেন। যে হলে ছবিটি মুক্তি পাওয়ার কথা, সেই হল ঘেরাও করালেন। ছবিটি মুক্তি দেয়া হলে পার্লামেন্টের সামনে নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়ে আত্মহত্যা করবেন বলে ঘোষণা দিলেন। অরুন্ধতী রায় সিনেমা দেখে কড়া রিভিউ লিখলেন, 'ভারতীয় ধর্ষণ গল্পের দুর্দান্ত চালাকিপনা' নামে। গণধর্ষণের শিকার ফুলন দেবীকে সেলুলয়েডে আরও বহুবার ধর্ষণের অভিযোগ তুললেন অরুন্ধতী রায়। তার দেখাদেখি অন্য নারী-সমাজকর্মীরাও ফুলনের স্মরণে শেখর কাপুরকে পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি হিসেবে নিন্দা-মন্দ-সমালোচনাসহ বর্জন ও প্রতিরোধের ঘোষণা দিলেন। ভারতের পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন বিষয়টিকে মুখরোচক করে তুলেছিলেন। ফলে, ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায়ও ফুলন দেবীর বিষয়টি ভালো কাভারেজ পেল। মধ্যবিত্ত নারীবাদীরা আলোচনার নতুন টপিক পেলেন। মিডিয়ায় নারী ধর্ষণ। কিন্তু নারী ধর্ষণ ভারতে থেমে নেই, চলছেই।

জার্মানি যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে তখন এক কোটিরও বেশি সংখ্যক সোভিয়েত নারী জার্মান সৈন্যদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হন। নানচিং গণহত্যার ইতিহাস পড়লে জানা যায় যে, জাপানিরা কি পরিমাণ চীনা মেয়েদের ধর্ষণ করেছিল। ১৯৯১ সালে কাশ্মীরের কুনান ও পোশপোরা গ্রামে ৩০ জনেরও বেশি নারীকে ভারতীয় সৈন্যরা ধর্ষণ করেছিল।। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা ও ধর্ষণ করেছিল পাক-বাহিনী যা গোটা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছিল। ভারতের কাশ্মীরে এখনো ধর্ষণ চলছে, বিষয়টিকে রাজনৈতিক কালার লাগিয়ে দেয়া হয়েছে বলে, নারীবাদীরাও আর বিষয়টি নিয়ে কথা বলছে না। ফলে, এজাতীয় ধর্ষণ এক ধরনের টিকেট পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর মাধ্যমে যে গোটা মানবসমাজের স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে সেদিকে যেন কেউ খেয়াল করছেন না।

বাংলাদেশের খুব অল্পসংখ্যক হলেও পুরুষ ধর্ষণ হয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৯ শতাংশ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে পুরুষ কর্তৃক পুরুষ ধর্ষণের। এ কেমন মানসিকতা? এ কোন অদ্ভুত আচার কিংবা আচরণ? একজন পুরুষ আর একজন পুরুষকে ধর্ষণ করে কী কারণে? আমাদের দেশে কিংবা ভারতে বলা হয়ে থাকে অনেক সময় নারীদের যৌন উত্তেজক পোশাক অনেক সময় ধর্ষণের জন্য অনেকটা দায়ী; কিন্তু পুরুষ যখন পুরুষকে ধর্ষণ করে সেখানে তো পোশাকের কোনো ব্যাপার নেই। তাহলে বিষয়টি কি? কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? আসলে এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। ব্যাখ্যা একটিই বিজ্ঞানের চরম উন্নতির ফলে চারদিকে এখন চতুর্থ শ্লিপ বিপস্নবের রব উঠেছে, সেই বিপস্নব মানুষকে কোথায় নিয়ে যাবে তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই তবে, মানবিকভাবে ও আত্মীকভাবে যে, মানুষ শুধু দৈন্য নয়- চরম অবক্ষয়ের মুখে পড়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পুরুষকে যখন পুরুষ ধর্ষণ করে এ তারই আর একটি প্রমাণ।

নারীকে যখন পুরুষ ভালো না বেসে, প্রেম-নিবেদন না করে ধর্ষণ করে তার কতগুলো কু-যুক্তি রয়েছে। অসহায়কে খেলো করা, অত্যাচার করা এবং কষ্ট দেয়া, ধর্ষকরা তাদের ক্রোধকে শারীরিক নির্যাতন এবং অশ্লীল ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে প্রকাশ করে। এই ধর্ষকদের জন্য ধর্ষণ শিকারকে হীন করার একটি অস্ত্র, যা ধর্ষকের অনুভূতি প্রকাশের সর্বশেষ হাতিয়ার। এই ধরনের ধর্ষক চিন্তা করে, নির্যাতিতাকে শায়েস্তা করতে ধর্ষণই সর্বশেষ কার্যকর ভূমিকা রাখবে। ধর্ষকরা নির্যাতিতাকে যন্ত্রণা দিয়ে যৌন উত্তেজনা লাভ করে। ইচ্ছাকৃতভাবে শিকারকে তীব্রভাবে নির্যাতন করে সন্তোষ লাভ করে। সে শিকারকে নির্যাতন করে, উৎপীড়িত করে, শারীরিক ব্যথা দেয়, অসহায়ত্বের সৃষ্টি করে এক ধরনের আনন্দ লাভ করে। সে চায় নির্যাতিতা তার সঙ্গেই ধস্তাধস্তি করুক, যেটা তার জন্য এক প্রকার কামোদ মূলক অভিজ্ঞতা হবে। এ ধরনের কিছু কিছু ধর্ষক ভিক্টিমকে খুন করার মাধ্যমে সর্বোচ্চ পরিতৃপ্তি পায়।

কিছু ধর্ষণ যেমন- গণধর্ষণ সাধারণত অল্প বয়সি তরুণদের দ্বারা সংঘটিত হয়। দলবেঁধে ধর্ষণের ক্ষেত্রে আগে থেকে পরিকল্পনা করা থাকে, উচ্চাশার সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে। নারীদের অনৈতিক কাজ যেমন- স্বল্প বসন পরিধান বা ঘন ঘন বারে যাওয়াকে নিরুৎসাহিত করা হয়; কিন্তু এরপরও কোনো নারী এমন কাজে জড়িত থাকলে তার গণধর্ষণকে অনেক সময় বৈধ করে দেয়া হয়। এই কারণে কিছ জায়গায় দেখা যায়, দলবেধে ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে দেখা হয় না। পাপুয়া নিউগিনিতে অনেক নারীকে জনসম্মুকে দলবেঁধে ধর্ষণ করা হয়, এমনকি এতে সমাজের মুরব্বিদেরও সায় থাকে। আইন বহির্ভূত যুদ্ধ চলাকালে নাগরিকদের কোনো মৌলিক অধিকার তো সংরক্ষিত হয়ই না বরং তাদের অধিকার হরণ করা হয়। ২০০৮ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এ বিষয়ে বলছে 'যুদ্ধের সময় বিজয়ীদের দ্বারা বিশেষভাবে নারী ও বালিকারা যৌন নির্যাতনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়, তার সঙ্গে সঙ্গে তাদের নির্যাতন করা, শোষণ করা, তাদের মধ্যে ভীতি প্রবেশ করানো- এই সবকিছুই থাকে বিজয়ীদের অন্যতম লক্ষ্য।' অভিবাসীরা এবং আঞ্চলিকভাবে বাস্তুচু্যত মানুষ যারা যুদ্ধের সময় ঘর থেকে পালিয়ে যায় অথবা বিরাট রকমের দুর্যোগের অভিজ্ঞতার কারণে ঘর থেকে পালানোর সময় মানব পাচার চক্রের মধ্যে পড়ে যৌনদাসী অথবা গৃহকর্মী হিসেবে বিক্রি হয়ে যায়। ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যের সাধারণ সভায় নারীর ওপর নির্যাতন নিয়ে বলতে গিয়ে বলা হয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নারীর ওপর নির্যাতনের ঝুঁকি বাড়তে পারে। ২০১০ সালে হাইতির ভূমিকম্পে বিপুলসংখ্যক নারী ও বালিকা অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচু্যত হয়েছিলেন, যাদের মধ্যে অনেকেই যৌন নির্যাতনের মুখে পড়েছেন।

ধর্ষণ এখন নির্দিষ্ট কোনো ভৌগোলিক স্থানে সীমাবদ্ধ নেই, এটি এখন নির্দিষ্ট কোনো দেশের সমস্যা নয়। এটি বৈশ্বিক সমস্যা। ধর্ষণ চলছে দেশে দেশে। নারী যখন বেশি অসহায় অবস্থায় নিপতিত হয় তখন ধর্ষণের মাত্রা আরও বেড়ে যায়।

শ্রীলংকায় গৃহযুদ্ধ অবসানের পর স্বামীহারা নারীদের পার্শ্ববর্তী কেউ সহায়তা করতে এলে বা তাদের কাছে সহায়তা চাইলে তারা শর্ত আরোপ করত 'যৌন মিলন'-এর যা এক সময় ধর্ষণে রূপ নিত। এভাবে গোটা বিশ্বে নারীরা নানা কারণে নানা পরিবেশে ধর্ষণের শিকার হন। এর সমাধান বৈশ্বিকভাবে করতে হলে আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের দরকার। প্রয়োজন বৈশ্বিক আইন ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা যেখানে নারী ও পুরুষ উভয়কেই জোরালো ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। তাহলেই আমরা গড়তে পারব ধর্ষণমুক্ত শান্তিপূর্ণ বিশ্ব।

মাছুম বিলস্নাহ: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<77371 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1