বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ক্রিকেট অঙ্গনের অবস্থা

এক সময় বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল বর্তমানে জরাগ্রস্ত। এ দেশে ফুটবলকেও আগের অবস্থায় এনে ক্রিকেটকেও আগের মতো শক্তিশালী পর্যায়ে কীভাবে আনা সম্ভব তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে নিরপেক্ষভাবে।
আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ
  ২৯ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

প্রাক-বাংলাদেশ আমলে এ দেশে ক্রিকেট কোনো জনপ্রিয় খেলা ছিল না। হকির চর্চা হলেও সর্বত্র এর প্রচলন ছিল না। এখন ঢাকার বশির ফুটবল ও অন্যান্য খেলায় একমাত্র পরিচিত নাম ছিল। শৈশবে অনেকেই ডান্ডাগুলি, হাডুডু, মার্বেল ও লাট্টু খেলার সঙ্গে ঘুড়ি ওড়ানো বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। অনেক কিশোরই হাতে চলন্ত লাট্টু তুলে নিতে পারত। এর পাশাপাশি অনেকে গুলতি তৈরি করে গাছের পাখি মারার চেষ্টা করত। হালকা লোহার বড় গোল রিং তৈরি করে অনেকেই রাস্তায় চালাত বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে। এসব খেলা আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে গেছেই বলা চলে, শুধু কোনো কোনো অঞ্চলে বেঁচে আছে হাডুডু আর ঘুড়ি ওড়ানো।

এ দেশে প্রচলিত বহুকালের পুরনো খেলাকে সরিয়ে ক্রমেই নিচের স্থান করে নিয়েছে ভলিবল, লন টেনিস, টেবিল টেনিস (পিংপং), ব্যাডমিন্টন, হকি, ক্রিকেট আর নতুন অবায়বে ফুটবল।

একটা দিক অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এ দেশের গ্রামগঞ্জ থেকে শুরু করে সর্বত্র প্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। ফুটবল ব্রিটিশ আমল থেকেই এ দেশে ক্রমেই প্রচলিত হতে থাকে। স্বাধীনতার আগে ঢাকায় ওয়ান্ডারার্স স্পোর্টিং, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং, ওয়ারি, আজাদ স্পোর্টিং, মোহামেডান, পুলিশ, রহমতগঞ্জসহ আরও বেশ কয়েকটা ফুটবল ক্লাব ছিল। অনেক ক্লাব ছিল এলাকা বা পাড়াভিত্তিক। তখনকার ক্লাবের বৈশিষ্ট্য ছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরের ভালো ভালো খেলোয়াড়দের ঢাকার নিজেদের ক্লাবে অন্তর্ভুক্ত করা এবং অনেক খেলোয়াড়ের দক্ষতার কারণেই ক্লাবগুলো ভালো রেজাল্ট করত। প্রত্যেক ক্লাবেই একাধিক খ্যাতিসম্পন্ন খেলোয়াড় ছিলেন। প্রাক-বাংলাদেশ আমলে কলকাতার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবভালো টিমের বিরুদ্ধে খেলার দিন ওয়ান্ডার্সের একজন খ্যাতিমান খেলোয়াড়কে বিমানে কলকাতায় নিয়ে যেত খেলার জন্য। বাংলাদেশের ফুটবল খেলার এই গতিধারার ওপর কাঠামোগত প্রথম পরিবর্তন করে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং। তারা তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কেয়ামারি মোহামেডান এবং আরও কয়েকটা থেকে এগারো জন অবাঙালি পেস্নয়ার এনে ঢাকায় খেলতে থাকে। প্রথম বছর তারা সার্থকতা লাভ করলেও পরে ঢাকার অন্যান্য ক্লাব তাদের ক্লাবের অবাঙালি পেস্নয়ারদের নিজেদের দলে ভাগ করে নেয়। ঢাকায় বিদেশ থেকেও একজন করে ভালো খেলোয়াড় অনেক দলই একসময় আনত। বিদেশি দেশের মধ্যে অন্যতম ছিল নেপাল, শ্রীলংকা, ইরান, ইরাক, রাশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া। ইন্দোনেশিয়ার সুজিপতোর (স্টার ফরোয়ার্ড) খেলা অনেকেই হয়তো এখনো ভোলেননি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবাহনী ফুটবল খেলার স্টাইল অনেকটা বদলে দেয়। তখন ফুটবল খেলার দিন দলের সমর্থকরা সব কাজ ভুলে বিকালে ছুটে যেতেন ঢাকা স্টেডিয়ামে। স্টেডিয়াম পূর্ণ হয়ে যেত সমর্থকদের জন্য। স্বাধীনতার পর ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ও আবাহনীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাব দর্শকদের ওপর প্রভাব বিস্তারের কারণে দুই দলের সমর্থকরা স্টেডিয়ামের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে বসতেন।

সারা বাংলাদেশের প্রিয় খেলা ফুটবলের গৌরব এখন অস্তমিত। সব খেলার স্থান এখন দখল করেছে ক্রিকেট। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রমী দেশ এ জন্য যে, এখানে ফুটবলের জনপ্রিয়তা হারালেও সারা পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশ থেকেই ফুটবল গৌরবে অবস্থান করছে। ইংল্যান্ডে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল, ক্রিকেট ও লন টেনিস। সারা ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা- কোথাও থেকে ফুটবল বিদায় নেয়নি- টিমটিম করে শুধু আলো জ্বলছে বাংলাদেশে। এই ফুটবলকে নতুন করে জাগানো প্রয়োজন। ক্রিকেটের পাশে ফুটবলও হয়ে উঠুক শক্তিশালী ক্রীড়া। এ দেশও পেলে, ম্যারাডোনা, মেসি ওরোনালডোর মতো খেলোয়াড় তৈরি হতে পারতেন, পারেননি শুধু সুযোগের অভাবে আর এই পেশাকে গ্রহণ না করার জন্য।

এখন সমগ্র বাংলাদেশের একমাত্র প্রিয় ও পরিচিত খেলা ক্রিকেট। আস্তে আস্তে ক্রিকেট সব খেলাকে পেছনে ফেলে ওপরে উঠে গেছে। এটা অবশ্য দেশের জন্য আনন্দের সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এ দেশের ক্রিকেট একসময় শক্তিশালী হয়ে ওঠার পর অনেক বড় বড় দেশকে হারিয়ে কৃতিত্ব অর্জন করেছে।

ক্রিকেটকে উন্নত করার প্রয়োজনে এবং ভালো খেলোয়াড় তৈরি করার জন্য বিশেষ প্রণোদনার দরকার। বাংলাদেশের প্রতিটি শহরে ক্রিকেট খেলার সুযোগ দিলে সেখানে ভালো ক্রিকেটিয়ার জন্ম নিতে পারে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন শহরের দলের মধ্যে লিগ খেলার ব্যবস্থা। বর্তমানে এ দেশে বিপিএলের আয়োজন করা হলেও দক্ষ খেলোয়াড় বেরিয়ে আসতে পারেনি যে নয়; কিন্তু বেশিদিন দক্ষতা ধরে রাখতে সমর্থ হয়নি। আর ভালো খেলোয়াড়কে আইপিএল খেলতে অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ চিন্তা করতে হবে, বিশেষ করে অল্পবয়স্ক খেলোয়াড়দের ক্ষেত্রে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, বোলার মুস্তাফিজুরের বলে যে ধার ছিল তা আইপিএল খেলার পর প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। কারণ, আইপিএলে খেলোয়াড়রা প্রচুর অর্থ পেলে অনবরত এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যাওয়া ও অনুশীলনে ক্লান্ত হয়ে পড়ায় আগের ফর্ম ঠিক রাখতে পারে না। এখানে দেশের স্বার্থ প্রধান বলে বিবেচনার মধ্যে আনতে হবে, অর্থ নয়।

এ ক্ষেত্রে একটা প্রশ্নও গুরুত্বর সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। ক্রিকেটাররা যাতে সারা বছর সচল থাকেন এবং তাদের আর্থিক ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়। প্রথম ক্ষেত্রে দেশে ক্রিকেট খেলার সঙ্গে দেশের বাইরে ক্রিকেট খেলার প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে খেলোয়াড়দের ভালো পারিতোষিক বা মাইনের ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয় আরও একটি বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী। দল নির্বাচনের সময় বিদেশি দলের বোলারদের বোলিং কৌশল লক্ষ্য করার পর তাদের মুখোমুখি হতে সক্ষম ও যোগ্য খেলোয়াড় নির্বাচন না করলে দলের পক্ষে জয়ী হওয়া কঠিন। একই ভাবে বিদেশি দলের ব্যাটসম্যানদের দুর্বলতা লক্ষ্য করে বোলার নির্বাচন না করলে দলের পক্ষে সফলতা অর্জন সম্ভব নয়। অন্যদিকে শক্তিশালী দল গঠনে নিরপেক্ষতা ও প্রয়োজনীয়। দেশের দলের জন্য কোচ, বোলিং ও ফিল্ডিংয়ের জন্যও খ্যাতিমানদের নিয়োগের দিকে তাকাতে হবে। একজন দক্ষ ক্রিকেট খেলোয়াড় চিরদিন সবার মধ্যে বেঁচে থাকেন। ফুটবলে ইউসেফ ও লেভ ইয়াসিন পেলে- ম্যারাডোনার মতো যেমন বেঁচে আছেন, ঠিক একই ভাবে ক্রিকেটে সোবার্স, হল, ফানহাই, হানিফ মোহাম্মদ, ফজল মাহমুদরা বেঁচে আছেন আরও অনেক তারকা খেলোয়াড়ের মতো।

ক্রিকেটে একটা মসমস্যা দলের অনেক ক্ষতি সাধন করতে পারে। বিদেশি জুয়াড়িরা ভালো ভালো ক্রিকেট খেলোয়াড়ের সুনাম ও ভবিষ্যৎ শেষ করতে পারে। বাংলাদেশের মতো ছোট দেশের প্রথম দক্ষ তরুণ খেলোয়াড় আশরাফউদ্দিন তখন খ্যাতির তুঙ্গে সে সময় তিনি জুয়াড়িদের প্রলোভনে দীর্ঘদিন শাস্তিভোগের কারণে আজ আর তার আগের ফর্ম নেই। পাকিস্তানের তিন খেলোয়াড় যখন মারাত্মক ফর্ম নিয়ে খেলছিলেন সে সময় তারা জুয়াড়িদের খপ্পরে পড়ে আজ শুধু অতীতের ফর্মের স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছেন। যে হ্যান্স ক্রনিয়ে দলের অধিনায়ক হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে একটা শক্তিশালী দলে পরিণত করেন তিনিও পরে জুয়াড়িদের কবলে পড়ে ক্রিকেট ছাড়তে বাধ্য হন। সম্ভবত পরে পেস্নন এক্সিডেন্টে মৃতু্যবরণ করেন। আর এ বছর (২০১৯) বাংলাদেশের খ্যাতমান খেলোয়াড় সাকিব জুয়াড়িদের ষড়যন্ত্রে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে অর্থ না নিলেও বর্তমানে ক্রিকেট জগৎ থেকে দূরে বসে এক বছরের জন্য নিষ্ক্রিয়ভাবে আছেন। সাকিবের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল খানিকটা দুর্বল ও মনোবল হারিয়ে ফেলেছেন তাতে সন্দেহের অবকাশ কম।

বর্তমানে ভারতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল টি-টেন ম্যাচে তিনটে ম্যাচের মধ্যে একটাতে জয়ী হয়েছে। আরেকটায় জিততে জিততে হেরেছে, আর তৃতীয় ম্যাচে পরাজিত হয়েছে। তাদের জয়ের পরিসংখ্যান ২:১। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ভারতে যেভাবে টেস্ট খেলছে তা দেশের লোককে দুঃখ ছাড়া আর কিছুই দিচ্ছে না। বাংলাদেশের খেলোয়াড়দেরর্ যাটিং দেখে মনে হচ্ছে এরা কোনোদিন ক্রিকেট খেলেননি। ব্যাট হাতে শুধু মাঠে আসা-যাওয়া করছেন। পাঁচদিনের খেলা আড়াই দিনেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। আর ফলাফল হচ্ছে এক ইনিংস আর অনেক রানে পরাজয়। বাংলাদেশ তো এমন ক্রিকেট কোনোদিন খেলেনি। বিশ্ব ক্রিকেটে পাকিস্তানকে হারিয়েছে। ঢাকায় ভারত ক্রিকেট খেলতে আসার সময় মুস্তাফিজ চার উইকেট নেওয়ার পর তার বলে ধনী আউট হওয়ায় মুস্তাফিজকে হাতের কনুই দিয়ে আঘাত করার পর তাকে সেবা নিতে হয়েছিল, কিন্তু ধনীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনা হয়নি। মুস্তাফিজের দুর্দান্ত ফর্মের সময় আর এক তরুণ বোলার মেহেদিও ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলার সময় দারুণ ফর্মে ছিলেন। মেহেদির আরেকটা গুণ হলো তিনি ভালো ব্যাটিংও করতে পারেন। ভালো অনুশীলন দিলে মেহেদিও দলে অল রাউন্ডার হতে পারেন।

ভারতের বিরুদ্ধে খেলায় নাঈম ভালোই খেলেছেন একজন তরুণ ব্যাটসম্যান হিসেবে। অন্যদের মধ্যে একমাত্র জ্বলজ্বল তারকা মুশফিক। মাহমুদুলস্নাহর প্রতি দর্শকদের অনেক আশা ছিল, কিন্তু তিনিও নিষ্প্রভ। লিটনের দিকেও অনেকে তাকিয়েছিলেন কিংবা সৌম সরকারের দিকে। কিন্তু যখন ব্যাটসম্যানরা পরপর আউট হয়ে তিন-চারটে শূন্য পান, তখন দর্শকদের সব আশা নিভে যায়। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের এই অবস্থার পর বিশেষভাবে বিবেচনা করে আগের অবস্থায় কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায় তা গভীরভাবে পর্যালোচনার প্রয়োজন।

এক সময় বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল বর্তমানে জরাগ্রস্ত। এ দেশে ফুটবলকেও আগের অবস্থায় এনে ক্রিকেটকেও আগের মতো শক্তিশালী পর্যায়ে কীভাবে আনা সম্ভব তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে নিরপেক্ষভাবে।

ড. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ: কথাসাহিত্যিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<77504 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1