শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রেন দুর্ঘটনা ও সংশ্লিষ্টদের দায়

বাংলাদেশ রেলওয়ের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। কিন্তু এসব কারণে অতীতের গৌরব আজ ক্রমেই যেন স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে আমাদের কাছে। ব্রিটিশ-ভারতের বর্তমান ভারতীয় ভূখন্ডে যখন রেলওয়ের সূচনা হয়েছিল, ঠিক এর কাছাকাছি সময় আমাদের দেশে রেল যাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু সময়ের প্রেক্ষাপটে ভারতের রেলওয়ে এগিয়েছে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি। সেই তুলনায় আমাদের অগ্রগতি অনেক কম।
সাহাদাৎ রানা
  ২৯ নভেম্বর ২০১৯, ০০:০০

অন্যসব যাতায়াতের মাধ্যমের চেয়ে রেলপথ অনেকটা নিরাপদ ও আরামদায়ক। বিশ্বের অনেক দেশে রেলপথকে তাই যাত্রীরা বেছে নেন যাতায়াতের সহজ ও নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা পুরোপুরি সত্য নয়। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় দুই ট্রেনের সংঘর্ষের ঘটনা সেই শঙ্কার কথাই জানান দিল। আলোচিত এ দুর্ঘটনায় ১৬ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। আর আহত হন প্রায় শতাধিক। এ দুর্ঘটনা পর আমাদের সম্ভাবনাময় রেল খাতকে আবারও প্রশ্নের সম্মুখীন করল। রেলপথ ও রেলওয়ের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আবারও দেখা দিয়েছে উদ্বেগ। বিশেষ করে ভ্রমণ বা যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে রেলপথ অনেকটাই নিরাপদ ও আরামদায়ক হলেও এ দুর্ঘটনার পর সামনে আসে বেশকিছু প্রশ্ন। উন্নত বিশ্বে রেলপথ অনেকটাই নিরাপদ ও আরামদায়ক হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তা পুরোপুরি সঠিক নয়। এর পেছনে রয়েছে অনেকগুলো কারণ। বিশেষ করে, সেবার নিম্নমানের কারণে যাত্রী সাধারণের ভোগান্তি দিন দিন শুধু বাড়ছেই। প্রায় সারাদেশে, বিশেষ করে ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে জরাজীর্ণ বগি, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন, সেবার নিম্নমানসহ নানাবিধ বিষয় যাত্রীদের কাছে ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে আন্তঃনগর ট্রেনগুলোর অবস্থা মোটেও প্রত্যাশিত পর্যায়ে নেই। আর মেইল ট্রেনগুলোর দুরবস্থা অনেকটা আগের মতোই রয়ে গেছে। উন্নতি তেমন একটা হয়নি দীর্ঘদিনেও।

কারণ বাংলাদেশে রেলপথে ভ্রমণ এখনও সেই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। অবশ্য এর পেছনে রয়েছে নানা কারণ। এবার একটু আমাদের দেশের রেলপথের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিতে পেছনে ফিরে তাকানো যাক। এ দেশে প্রথম রেলওয়ের সূচনা হয় ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর দর্শনা-জগতি রেললাইন নির্মাণের মাধ্যমে। এরপর সময়ের স্রোতে ধীরে ধীরে এর পরিধি বেড়েছে। কিন্তু ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় রেলপথ। স্বাধীনতার পর প্রচুর অর্থ খরচ করে সেগুলো মেরামত করা হয়। সময়ের দীর্ঘ পথ চলায় বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের ২৮৭৭ কিলোমিটার রেললাইন নেটওয়ার্ক দেশের ৪৪টি জেলার সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে। ১৯৪৭ সালের আগে অবিভক্ত ভারতবর্ষে রেলওয়ে বোর্ডের মাধ্যমে তৎকালীন রেলওয়ে পরিচালিত হতো। ১৯৭৩ সালে বোর্ডের কার্যক্রম বিলুপ্ত করে একে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। এরপর থেকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সড়ক ও রেলপথ বিভাগ হতে বাংলাদেশ রেলওয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হতো। তবে দীর্ঘদিন ধরে রেল খাতে ক্রমাগত অবহেলা আর ভুল পরিকল্পনার কারণে, রেল খাত তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। তাই রেল খাত বাঁচাতে দাবি উঠে পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনের। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর 'রেলপথ মন্ত্রণালয়' নামে স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় গঠন করে সরকার। পাশাপাশি সরকার রেল খাতকে বাঁচাতে এবং রেলওয়েকে ঢেলে সাজাতে ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নেয়। এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল যাত্রীদের সেবার মান বৃদ্ধি করে রেলপথের প্রতি সবাইকে আগ্রহী করা। রেলপথকে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সবার কাছে নিয়ে যাওয়া। যাত্রাকে নিরাপদ ও আরামদায়ক করে তোলা।

কিন্তু রেল খাতে সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়নি। এর পেছনে রয়েছে অনেকগুলো কারণ। দেশের বিভিন্ন জেলায় চলাচলকারী আন্তঃনগর ট্রেনগুলোর সেবার মান উন্নতকরণসহ বিদ্যমান ত্রম্নটি-বিচু্যতি দূর করার কথা বহুদিন ধরেই শোনা গেলেও এসব ক্ষেত্রে এখনও কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি। ইতোমধ্যে রেলওয়ের উন্নয়নে পৃথক মন্ত্রণালয় গঠন, রেলপথ মন্ত্রণালয়ে জন্য বাজেট বৃদ্ধি, রেললাইন পূর্ণনির্মাণ থেকে শুরু করে কোচ বৃদ্ধিসহ হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু এর ফলে তেমন কোনো সুফল মিলছে না। বরং সব রকম উপযোগিতা থাকার পরও বাংলাদেশ রেলওয়ে কেন যেন অজ্ঞাত কারণে সামনে এগোতে পারছে না। সেই লক্ষ্যের পথে বাধা হয়ে আসছে স্টেশন বন্ধের খবরে। জরাজীর্ণ রেল কারখানার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার খবরও বাড়ছে ক্রমশ। এ ছাড়া এ খাতে রয়েছে দীর্ঘদিনের বড় একটি অভিযোগ। মানে লোকবল সংকট। যে পরিমাণ লোকজন প্রয়োজন সুষ্ঠুভাবে রেল পরিচালনার জন্য তার তুলনায় জনবল অপ্রতুল।

এ ছাড়া রয়েছে আরও বেশি কিছু অভিযোগও। বিশেষ করে রেলওয়ের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি যে অভিযোগটির সম্মুখীন আমরা হই- তা হলো সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছতে না পারার অভিযোগ। এমন অভিযোগ যেন নিত্য দিনের। এ ছাড়া রয়েছে টিকিট পাওয়া নিয়ে যাত্রীদের ভোগান্তি কথা। যা ঈদের সময় সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায়। প্রতিবছর দুটি ঈদে যাত্রীদের ভোগান্তির খবর সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হলেও এরপর থেমে যায় সবকিছু। আলোচনাও শেষ হয়ে যায় ঈদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। এ ছাড়া অনেক রেলে আসনের অবস্থাও করুণ। সঙ্গে রয়েছে অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ। তাই এসব অবস্থা থেকে বের হতে পারছে না রেলওয়ে। তাই যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকার পরও মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে রেল যাত্রায় আগ্রহী হচ্ছে না। হচ্ছে অনেকটা বাধ্য হয়ে। অথচ নিরাপদ; যাত্রার ক্ষেত্রে রেলপথের বিকল্প খুব কমই রয়েছে।

এবার একটু দৃষ্টি দেয়া যাক রেলের লাভ- লসের বিষয়ের দিকে। পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়- দীর্ঘদিন ধরে রেলওয়ে লোকসান দিচ্ছে। এটা আমাদের জন্য পুরনো কথা। যদিও জনগণের থেকে লাভ তুলে নেয়া রেলের মূল উদ্দেশ্য নয়। বরং রেলের উদ্দেশ্য হলো যোগাযোগ নিরাপত্তা ও জনগণের উন্নত সেবা প্রদানই হচ্ছে রেলের মূল দায়িত্ব। কিন্তু সেবামূলক প্রতিষ্ঠান বলেই বিপুল চাহিদা ও সম্ভাবনা থাকার পরও যে রেলওয়েকে লোকসান দিতে হবে তারও কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। বরং বিপুল সম্ভাবনার এই খাত থেকে লাভ করাও সম্ভব। কিন্তু তার আগে রেল খাতে দুর্নীতি, ভুল নীতি, লুণ্ঠন ও অপচয় রোধ করতে হবে। অথচ, দুর্নীতি, ভুল নীতি, লুণ্ঠন ও অপ্রয়োজনীয় অপচয়ের কারণে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ রেলওয়েকে লোকসানি প্রতিষ্ঠান বানিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হলে বা অপ্রয়োজনীয় অপচয় রোধ করতে পারলে লোকসান কাটিয়ে লাভজনক করা সম্ভব বাংলাদেশ রেলওয়েকে। এখন সময় এসেছে এসব পথের বাধাগুলো চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার।

এ ছাড়া রয়েছে রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা। এক গবেষণায় দেখা গেছে গত সাত বছরে রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে প্রায় এক হাজারের বেশি মানুষ। এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এটাই আমাদের জন্য শঙ্কার কারণ। মূলত রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার প্রধানতম কারণ হলো অরক্ষিত রেলক্রসিং। আমাদের দেশে রেললাইনে অসংখ্য জায়গা রয়েছে- যা অরক্ষিত। সেই অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ে নেই গেটম্যান। যা রয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় দুর্ঘটনা প্রতিরোধে অপ্রতুল। এ ছাড়া রয়েছে গেটম্যানের অবহেলা। ট্রেন আসার নির্দিষ্ট সময় থাকলেও গেটম্যানরা সঠিক সময়ে রেলক্রসিংয়ে প্রতিরোধ সিগন্যাল বন্ধ করেন না। কাছাকাছি চলে এলে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সিগন্যাল বন্ধ করতে গিয়ে ঘটে দুর্ঘটনা। এ ছাড়া কিছু গাড়ির চালক ও পথচারীর ধৈর্যের অভাবও রেলক্রসিং দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। নিজেদের খামখেয়ালি মতো তারা রেললাইন পার হন। রেললাইনের পাশে যত্রতত্র বাস-ট্রাক রেখে দিয়ে জটের সৃষ্টি করছে। এ কারণেও ঘটছে রেল দুর্ঘটনা। আর রেলক্রসিংয়ের আশপাশে সরকারি জায়গা দখল করে প্রভাবশালীরা তৈরি করছে দোকানপাট। এমনকি রেলক্রসিংয়ের পাশে বাজারও বসছে নিয়মিত। আবার কোথাও কোথাও রেললাইনের দুই পাশে কাছাকাছি বসতি গড়ে উঠছে। আছে অসংখ্য বস্তিুও। এগুলো রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ।

বাংলাদেশ রেলওয়ের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। কিন্তু এসব কারণে অতীতের গৌরব আজ ক্রমেই যেন স্মৃতি হয়ে যাচ্ছে আমাদের কাছে। ব্রিটিশ-ভারতের বর্তমান ভারতীয় ভূখন্ডে যখন রেলওয়ের সূচনা হয়েছিল, ঠিক এর কাছাকাছি সময় আমাদের দেশে রেল যাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু সময়ের প্রেক্ষাপটে ভারতের রেলওয়ে এগিয়েছে প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি। সেই তুলনায় আমাদের অগ্রগতি অনেক কম। ভারতের সঙ্গে আমাদের রেলওয়ের মৌলিক পার্থক্য হলো, ভারতীয় রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা সে দেশে প্রসারিত হয়ে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ রেলওয়েতে পরিণত হয়েছে। ভারত ইতোমধ্যে তাদের প্রায় সব অঙ্গরাজ্যের সঙ্গে রেল যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছে। বিপরীতে আমরা সেভাবে এগুতে পারিনি। ছোট আয়তনের দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমরা এখনও ৬৪ জেলার সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপন করা সক্ষম হয়নি। এটা আমাদের জন্য অবশ্যই ব্যর্থতা। বিশেষ করে ঢাকার সঙ্গে যদি সারাদেশের রেল যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয় তবে দেশের অর্থনীতির চাকাও বেশ গতিশীল হবে। তবে এখন সময় এসেছে আর পেছনে ফিরে না তাকিয়ে আমাদের রেলের প্রতি নতুন করে মনোযোগ দেয়া। রেল খাতে যথাযথ ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা। আর এতেই রেলপথে নিরাপদ ও আরামদায়ক ভ্রমণের অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। আর সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে রেলপথ মন্ত্রণালয়কে।

সাহাদাৎ রানা: সাংবাদিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<77505 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1