বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা

শুধু সরকারের আশায় বসে থাকলে চলবে না। যার যার বাড়ি, দোকান, কারখানা, অফিসের সামনের জায়গাটুকু পরিষ্কার রাখতে হবে। সর্বসাধারণেরও সচেতন হওয়া জরুরি।
মোহাম্মদ আবু নোমান
  ০৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

ঢাকার বাতাসে ভয়াবহ বিপদ! আমরা ঢাকা শহরে প্রতিনিয়ত বিষ গ্রহণ করছি! খাবারে বিষ, বাতাসে বিষ, পানিতে বিষ, মাছ-ফল-সবজিতে বিষ, চলাফেরায় ঝুঁকি। এ রকম কত কিছুর ঝুঁকি নিয়েই আমরা চলছি! এটি সত্যিই দুঃখজনক। হতাশার যেন শেষ নেই। সব জায়গায় সমস্যা! এসব দেখারও যেন কেউ নেই! অনুধাবন, বা অনুভাবন করারও যেন কেউ নেই! হায়রে দেশ! হায়রে মানুষ!

পৃথিবীর যেসব শহর বায়ুদূষণে ধুঁকছে, বরাবরই সেগুলোর তালিকার একদম শীর্ষের কাছাকাছি জায়গা হয় আমাদের ঢাকার। 'দ্য স্টেট অব গেস্নাবাল এয়ার-২০১৯' শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বের যে পাঁচ দেশের শতভাগ মানুষ দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করে, বাংলাদেশ সেগুলোর অন্যতম। বৈশ্বিকভাবে বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজু্যয়ালের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গত রোববার সকাল ৭টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত বেশির ভাগ সময় ঢাকাই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর। এরপর কয়েক ঘণ্টার জন্য মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটোর ও ভারতের কলকাতা শহর দূষণের দিক থেকে ঢাকাকে ছাড়িয়ে যায়। তবে রাত সাড়ে ৮টার পর থেকে সোমবার দিনের বেশির ভাগ সময় জুড়ে ঢাকা বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরগুলোর তালিকার শীর্ষে ছিল।

ঢাকা কেন বারবার দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় প্রথম হবে? সিটি করপোরেশন, সড়ক পরিবহন ও পরিবেশ অধিদপ্তর যদি পরিবেশ দূষণে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলে তাদের কাজটা কী? শুধু বসে বসে বেতন নেয়া? সরকা?রেরও সুম?তি হবে না? বাংলাদেশের সরকারি প্রায় সব অফিসের কর্তারা বসে বসে বেতন নিতে আগ্রহী। কাজ করতে আগ্রহী নয়। বায়ুদূষণ রোধে অনেকগুলো সংস্থা নানা ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত। বায়ুদূষণের কারণগুলো দূর করার বিষয়ে তাদের কোনো ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। কালো ধোঁয়াসহ ক্ষতিকর বস্তুকণা বাতাসে ছড়ানো, ফিটনেসহীন মোটরযানগুলোর চলাচল বন্ধ করার দায়িত্ব বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার। ঢাকার চারপাশের ইটভাটাগুলোর পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। রাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ি ও অন্যান্য নির্মাণকাজের সময় ধুলা ওড়ানো বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বাধ্য করার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। তাহলে এসব কর্তৃপক্ষের দায়িত্ববোধ আছে কী?

ধুলা-বালি, শ্বাসকষ্ট, শিশুসহ নিরীহ জনগণের স্বাস্থ্যের জন্য দায়ী দেশের কতিপয় ধান্দাবাজ প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ সেবাদানকারী নামে খ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলো। রাস্তা কাটলেই টাকা! বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কারোর সঙ্গে কারোর কাজের কোন সমন্বয় না থাকায় একই রাস্তা বছরে ২/৩ বার কাটা হয়। গবেষণায় যখন প্রকাশ হয়, 'বায়ুদূষণে এক নম্বরে ঢাকা!' তখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসে; সিটি করপোরেশন কি আছে, নাকি বিলুপ্ত হয়েছে? রাজধানীর সড়কগুলোতে ধুলা নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিন সকালে দুই সিটি করপোরেশন থেকে পানি ছিটানোর নিয়ম রয়েছে। পরিবেশ রক্ষায় সরকারের তথা সিটি করপোরেশনের কার্যত কোনো উদ্যোগ নেই। এর প্রতিকার কার কাছে আছে? কে দেবে সমাধান! অথচ পুরো দেশ ডিজিটালের উন্নয়নের স্বপ্ন নিয়ে বিভোর!

আগেতো জীবন তারপর সবকিছু। ঢাকার বায়ুদূষণের সমস্যাটি কেন স্থায়ী রূপ ধারণ করেছে? এ যেন 'বিনা পয়সার' সদয়, যা সবাইকে ইচ্ছা হোক আর অনিচ্ছায় হোক, নাকে, চোখে, মুখে, শুধু ভোগই নয়, উপভোগও করতে হবে। সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা বা রাত কোনো সময়ই, ঘরে বাইরে যার ছোঁয়া থেকে মুক্তি নেই; তা হলো- মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর ও স্বাস্থ্যঝুঁকি সংবলিত দুঃসহ, ভয়াবহ জীবনসংহারী ধুলা আর ধোঁয়া! বহু আগেই ঢাকা শহর বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। দূষণের উৎস নিয়ন্ত্রণে যেমন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, তেমনি জলাশয় সংরক্ষণ ও নতুন করে তা গড়ে তোলারও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না সরকার। বর্তমানে রাজধানীর বায়ুর মান এমন অবস্থায় পৌঁছেছে, বায়ুদূষণকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংকট হিসেবে ঘোষণা ও পরিবেশগত 'জরুরি অবস্থা জারি' করার সময় হয়েছে। চলতি মাসের প্রথম দিকে ভারতের রাজধানী দিলিস্নতে বায়ুদূষণের কারণে সেখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে হয়েছে।

বায়ুদূষণ মোকাবিলার প্রথম কাজ হচ্ছে- দূষণের উৎস বন্ধ করা। পরের কাজ হচ্ছে- শহরের বিভিন্ন স্থানে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলা এবং জলাশয়গুলো রক্ষা করা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডবিস্নউএইচও) ও যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইপিএর হিসেবে কোনো একটি শহরের বায়ুর মানের সূচক ২০০-এর বেশি হলে তাকে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। গত রোববার রাত ৯টায় ঢাকার বায়ুর মানের গড় সূচক ছিল ২২০। এর মধ্যে ঢাকার কারওয়ানবাজার এলাকার বায়ুর মান ছিল ২৯৮, যা মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর। কোনো শহরের বায়ুর মানের সূচক ২০০ ছাড়ালে ওই শহরের মানুষকে মাস্ক (মুখোশ) পরার পরামর্শ দেওয়া হয়। ঘরের জানালা বন্ধ রাখতে হয়, সাইকেলে চড়া নিষেধ করা হয়। আর শিশু ও বৃদ্ধদের খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হতে নিরুৎসাহিত করা হয়।

রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় বায়ুদূষণ রোধে নীতিমালা প্রণয়নের জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। ওই কমিটি বায়ুদূষণ রোধে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে এবং আরও কী কী উপায়ে বায়ুদূষণ রোধ করা যায় সে ব্যাপারেও সুপারিশের আদেশ দেয়া হয়েছে। জনস্বার্থে পরিবেশবাদী ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) এক সম্পূরক আবেদনের শুনানিতে গত মঙ্গলবার হাইকোর্টের বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। এ ছাড়া ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ এলাকায় অবৈধ ইটভাটা ১৫ দিনের মধ্যে বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার নির্দেশ দেয় আদালত। সেই সঙ্গে রাজধানীর রাস্তা ও ফুটপাতে ধুলোবালি, ময়লা ও বর্জ্য অপসারণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া যেসব এলাকায় উন্নয়ন ও সংস্কার কাজ চলছে এবং যেসব এলাকায় ধুলোবালি বেশি, সেসব এলাকায় ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দিনে দুবার পানি ছিটাতে দুই সিটির মেয়র ও নির্বাহীদের নির্দেশ দেয় আদালত।

বাতাসে অতিমাত্রায় ধুলার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শহরের গাছগাছালিও। গাছের পাতায় জমছে ধুলার আস্তরণ। এর ফলে গাছের খাদ্য ও অক্সিজেন তৈরির প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। শুধু তাই নয়, পাতার পত্ররন্ধ্র ও সূর্যের আলোর মাঝখানে ধূলিকণার আস্তর প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। ফলে কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করতেও বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে গাছ। সবুজ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য তৈরি করে। এই প্রক্রিয়ায় শুধু খাদ্য তৈরিই করে না, অক্সিজেনও রিলিজ করে। মানুষ, জীবজন্তু অক্সিজেনের মাধ্যমে বেঁচে থাকে, আর সেই অক্সিজেনের উৎসই হচ্ছে উদ্ভিদ। ধূলিকণার কারণে সালোকসংশ্লেষণ যেহেতু বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, সুতরাং তা আমাদের পরিবেশের ওপর ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করছে।

বাতাসে মিশ্রিত সালফার, সিসা, দস্তা ইত্যাদি ধাতুকণা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর; বিশেষত শিশুদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রাকৃতিক পরিবেশদূষণের ক্ষতিকর প্রভাবের ফলে বছরে যত মানুষের মৃতু্য ঘটে, তার দুই তৃতীয়াংশই বায়ুদূষণের ফলে। বায়ুদূষণের কারণে হৃদরোগ, শ্বাসকষ্টজনিত জটিল সমস্যা, ফুসফুসে সংক্রমণ ও ক্যান্সার হয়। বিশেষত শিশু ও গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব প্রকট হয়ে থাকে। বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাবের ফলে মৃতু্যর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ পঞ্চম। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ শুধু বায়ুদূষণের কারণেই মারা গেছে।

একথা ঠিক, শুধু আইন করে ও কোনো সরকারের একক উদ্যোগ নিয়ে পরিবেশ রক্ষা সম্ভব নয়। অন্যের ঘাড়ে দায়িত্ব চাপানোর আগে সর্বসাধারণের সচেতন হতে হবে। আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রয়াস বিরাট শক্তিরূপে অর্জিত হতে পারে। সার্বিক দূষণের জন্য মানব সৃষ্ট কারণগুলো অনেকটাই দায়ী বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। দূষণ রোধে বিভিন্ন সময়ে নেয়া পদক্ষেপ মেনে না চলায় প্রতিনিয়ত পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে।

পরিবেশ দূষণ সমস্যা নিয়ে আজ সমস্ত বিশ্বই চিন্তিত। সভ্যতার অস্তিত্বই আজ এক সংকটের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানেও পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধের শর্ত আরোপ করা হয়েছে। পরিবেশ দূষণ মানব সভ্যতার জন্য ভয়ংকর বিপদের পূর্বাভাস। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তোলার লক্ষ্যে যে কোনো মূল্যে পরিবেশ দূষণ রোধ করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

শুধু সরকারের আশায় বসে থাকলে চলবে না। যার যার বাড়ি, দোকান, কারখানা, অফিসের সামনের জায়গাটুকু পরিষ্কার রাখতে হবে। সর্বসাধারণেরও সচেতন হওয়া জরুরি।

রাস্তায় যেসব ময়লা আবর্জনা ফেলা হয়, সেগুলোই জীবাণু হয়ে আমাদের শরীরে ঢুকছে! যতদিন পর্যন্ত আমরা শৃঙ্খল না হবো, ততদিন আমাদের দেশ পরিচ্ছন্ন হবে না। কেউ কাউকে আলাদাভাবে সচেতন করা সম্ভব নয়। এ জন্য থাকতে হবে নীতিমালা ও সুশাসন। যা আমাদের দেশে নেই। নিজেদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশেই সম্ভব সমাজ, দেশ ও পরিবেশের উন্নয়ন ঘটানো।

মোহাম্মদ আবু নোমান: কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<78270 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1