বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বেগম রোকেয়া ও নারী জাগরণ

শিক্ষার মাধ্যমে নারীর সচেতনতা আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি করে নারীর সামাজিক অবস্থান দৃঢ় করা সম্ভব- এটা তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন। সেই সঙ্গে শিক্ষার মাধ্যমে নারীর ব্যক্তিত্ব বিকাশের বিষয়টিকেও তিনি প্রাধান্য দিতেন। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন- নারীরা সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবে, রাষ্ট্রের কর্ণধার নারী হবে, বিচারকের আসনে নারী বসবে। বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন শতভাগ পূরণ হওয়ার পথে।
তারাপদ আচার্র্য্য
  ০৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

নারী জাগরণের অগ্রদূত পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া। তিনি বাঙালি নারীর আলোর পথের দিশারি। তার পথ ধরেই বাঙালি নারী অনেক দূর এগিয়েছে। তার জন্ম ও মৃতু্য একই মাসের একই তারিখে। জন্ম ৯ ডিসেম্বর, ১৮৮০; মৃতু্য ৯ ডিসেম্বর, ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ। তাই এবছর ৯ ডিসেম্বর তার ১৩৯তম জন্মবার্ষিকী ও ৮৯তম মৃতু্যবার্ষিকী। আমরা যদি পেছনে ফিরে তাকাই তা হলে দেখতে পাবো, উনিশ শতক বাঙালি নারী জাগরণের যুগ। সামাজিক অত্যাচার, বিধিনিষেধ, প্রথা, পশ্চাৎপদতা; যা নারীর শৃঙ্খল হিসেবে বিবেচিত হতো, সেই শৃঙ্খল থেকে নারীকে মুক্ত করার জন্য তিনি আমৃতু্য ত্যাগ ও সংগ্রাম করে গিয়েছেন। নারীর নতুন জীবনবোধ সৃষ্টি ও স্বাধীন সত্তা বিকাশের ক্ষেত্রে তিনি অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন।

সমাজের নানা ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার সাহস ও শক্তি জুগিয়েছেন তিনি। উনিশ শতকে এসে খ্রিস্টান মিশনারিদের উদ্যোগে যে নারীশিক্ষার সূচনা হয়েছিল, তারই অংশ হিসেবে অন্তঃপুরে নারীশিক্ষার গোড়াপত্তন হতে আমরা দেখি। নারীশিক্ষা সম্পর্কে রোকেয়া ভেবেছেন সারাজীবন। শিক্ষার মধ্যদিয়ে নারীর সীমাবদ্ধ জীবনের শৃঙ্খল ভাঙা সম্ভব বলেও তিনি ভেবেছেন। তার ভাবনার সফল প্রতিফলন আমরা আজ সর্বত্র দেখতে পাচ্ছি।

শিক্ষার মাধ্যমে নারীর সচেতনতা আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি করে নারীর সামাজিক অবস্থান দৃঢ় করা সম্ভব- এটা তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন। সেই সঙ্গে শিক্ষার মাধ্যমে নারীর ব্যক্তিত্ব বিকাশের বিষয়টিকেও তিনি প্রাধান্য দিতেন। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন- নারীরা সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবে, রাষ্ট্রের কর্ণধার নারী হবে, বিচারকের আসনে নারী বসবে। বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন শতভাগ পূরণ হওয়ার পথে।

নারীরা এখন সবখানেই নিজের জায়গা করে নিচ্ছেন নিজ নিজ যোগ্যতা, মেধা, বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে। আমাদের দেশের নারীদের সরব অবস্থান এখন কেবল পরিবারেই সীমাবদ্ধ নেই, সমাজের বিভিন্ন স্তরে যেমন- প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, আনসার ভিডিপি, বিজিবি, বিমান পরিচালনা, ট্রেন পরিচালনা, চিকিৎসা, প্রযুক্তি, শিক্ষকতা, নার্সিং, রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাজনীতি- সর্বত্রই এখন নারীর বিচরণ ও অংশগ্রহণ। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের দীর্ঘতম নারী শাসক। বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদে নারী রয়েছে, সচিবও রয়েছে বেশ কজন। নারী উদ্যোক্তা ও শিল্পপতিদের সংখ্যাও বাংলাদেশে কম নয়। বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে নারী রয়েছেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নারী বিচারপতি নিয়োগ প্রদানের মধ্যে নারী ক্ষমতায়নের নতুন মাইলফলক যুক্ত হয়েছে। হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি পদে রয়েছে বেশ কজন নারী, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন ও তথ্য কমিশনে নারী সদস্য কাজ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নারী। এ ছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতকরা ৬০ ভাগ নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর অর্ধেকই নারী। এ নারী ঘর সামলায়, সন্তানের জন্ম দেয় এবং তাদের লালন-পালন করে, বাইরে কাজ করে পুরুষের পাশাপাশি। গ্রামীণ নারীর শ্রমঘণ্টা পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি। ঘরের রান্নাও তো শ্রমের কাজ। তাদের যদি জীবনঘনিষ্ঠ কিছু শিক্ষাসহ নিরাপত্তার আশ্বাস না দেয়া যায়, তাহলে ঘরে-বাইরে শান্তি নষ্ট হবেই। তা আমরা চাই না। নারী হলো প্রকৃতি। নারী জননী-জায়া-ভগিনী। তাদের অন্যায় নির্যাতন করে কেউ যেন কোনোমতে ছাড় না পায়। রোকেয়া মূলত মুসলিম সমাজের কুসংস্কার ও জড়তা দূর করার জন্য নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। কেননা রোকেয়া যে সমাজে ও রীতির যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তা অস্বাভাবিক ও অমানবিক। বেগম রোকেয়া বাঙালি নারীর মুক্তির পথ দেখিয়ে দিলেন। স্বামীর হাত ধরেই বেগম রোকেয়া পেয়েছিলেন স্বাধীনতার স্বাদ, নিজের প্রতিভাকে বিকশিত করার সুযোগ। ১৮৯৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সেই ভাগলপুরের উর্দুভাষী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বেগম রোকেয়া বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ছিলেন আধুনিকমনস্ক, বেগম রোকেয়াকে তিনিই লেখালেখি করতে উৎসাহিত করেন। বেগম রোকেয়া ছিলেন একজন দূরদর্শী সমাজসংস্কারক। তার সমাজসেবা শুধু বিদ্যালয় তৈরি করা পর্যন্ত থেমে থাকেনি। ১৯১৬ সালে তিনি বাঙালি মুসলিম নারীদের সংগঠন 'আঞ্জুমান খাওয়াতিনে ইসলাম' প্রতিষ্ঠা করেন। লেখক হিসেবে গল্প-কবিতা-উপন্যাসের মধ্যদিয়ে তিনি আত্মপ্রকাশ করেছেন, সংগঠক হিসেবে রোকেয়া স্কুল প্রতিষ্ঠা, নারীর কল্যাণে সংগঠন প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে এসেছিলেন। বাঙালি, বাঙালি-মুসলমান, নারীশিক্ষা, নারী জাগরণ তার কর্মকান্ডের মূল ভূমি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। উনিশ ও বিশ শতকের প্রথমে যে সব নারী লেখক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে রোকেয়া ছিলেন গভীরভাবে সমাজসচেতন ও যুক্তিবাদী, অন্যদিকে সমাজ পরিবর্তনে একনিষ্ঠ সংগঠক হিসেবে ছিলেন উজ্জ্বল পথিকৃত। সমাজ-সাহিত্য-নারী বিষয়ে এগিয়ে থাকা একজন মানুষ হিসেবে তার উত্তর প্রজন্মের নারীরা তার কাছ থেকে পেয়ে আসছেন অনুপ্রেরণা।

এ কথা সত্য, রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষা ও যোগ্যতায় নারী সে ক্ষমতার অধিকারী হলেও- সামগ্রিকভাবে এবং সামাজিক অবস্থানগত দিক থেকে নারী মর্যাদা পায়নি। কেবল ক্ষুধা নিবৃত্তির উপায়স্বরূপ ঘরের বাইরে কর্মক্ষেত্রে নারীকে কাজ দেয়া হচ্ছে, কিন্তু পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ উলেস্নখযোগ্যভাবে বাড়েনি। এখনো কন্যার বিবাহ, জমি ক্রয়, ব্যবসায় মূলধন নিয়োগ এসব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নারীর মতামত মূল্যায়ন করা হয় না।

\হবেগম রোকেয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে এ দেশের নারী যে বহু বিচিত্র জীবন কর্মে নিয়োজিত হন, তার মধ্যে সাহিত্য জগতের কথাটি মনে রাখা প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, নূরুন্নেসা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনী ও সারা তাইফুরের নাম উলেস্নখ করা প্রয়োজন। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত সাহিত্য সংস্কৃতি, সমাজকে তারাই সমুন্নত রেখে গেছেন ও পথ দেখিয়ে দিয়েছেন উত্তর প্রজন্মকে। তারা একাধারে শিক্ষাব্রতী ও সমাজসেবী। এ থেকে তারা প্রতিষ্ঠা করেছেন কর্মযোগ ও জীবন চেতনা। পত্রিকা প্রকাশনা, সাহিত্য ক্ষেত্রে নতুন ধ্যান-ধারণার বিপুল আবির্ভাব সঙ্গে নিয়ে ষাটের দশকের আবির্ভাব। এ সময়ে রাজনীতি ক্ষেত্রেও নারীর অংশগ্রহণ সূচিত হয়। দুটি বিশ্বযুদ্ধের ফলে এ দেশের চিন্তা-চেতনায় প্রগতিশীলতার চর্চা গতি পায়।

তবে আমাদের সমাজে নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি কেবলই ভোগবাদী। তারা নারীকে সবসময় ভোগের বস্তু হিসেবেই গণ্য করে থাকে। অথচ নারী-পুরুষ উভয়েই পরিবার ও সমাজের জন্য অনিবার্য। পরিবার টিকিয়ে রাখার জন্য যেমন নারী-পুরুষের সম্মিলিত উদ্যোগ, পরিকল্পনা, ত্যাগ ও সংযমের প্রয়োজন। একইভাবে সামাজিক স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্য রক্ষার স্বার্থে নতুন সমাজ বিনির্মাণের জন্য উভয়েরই ভূমিকা ও অবদান সমভাবে প্রয়োজন। সে জন্য একজনকে উপেক্ষা করে বা বাদ দিয়ে কেবল পুরুষ কিংবা কেবল নারীর পক্ষে বেশিদূর এগোনো সম্ভব নয়। তাই আমরা চাই নারী-পুরুষের সৌহার্দ্যপূর্ণ সমঝোতামূলক সম্পর্ক, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সম্পর্ক। এটা চেয়েছিলেন বেগম রোকেয়াও।

কোনো মানুষ শিক্ষিত নয়, কিন্তু মানবিক ও বিবেক-বিবেচনা বোধ তার মধ্যে রয়েছে, যুক্তি মানে ও বোঝে। মানুষের দুঃখ-শোকে কাতর হন যিনি, সহমর্মিতা যার মধ্যে জাগ্রত হয় তিনি তো নির্যাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন না। বিবেকবোধ ও মানবিক সব নারী-পুরুষের মধ্যে জাগ্রত হলে নির্যাতনকেন্দ্রিক পারিবারিক ও সামাজিক চিত্র পাল্টে যাবে। নারী তো তার সামগ্রিকতা নিয়ে নিজেকে মেলে ধরতে চায়। কিন্তু পুরুষকে তো তা গ্রহণ করার মানসিকতা, সাহস ও উদারতা অর্জন করতে হবে, হতে হবে উন্নত সাংস্কৃতিক ও রুচির অধিকারী। সামাজিক সচেতনা বৃদ্ধিসহ পুরুষের মানসিকতার পরিবর্তন এবং নারী অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করলে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে, নারীর পূর্ণ জাগরণ ঘটবে, ঘটবে স্বাধীনসত্তার বিকাশ। বেগম রোকেয়া এমনই স্বপ্ন দেখতেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তার স্বপ্ন সফল হোক।

তারাপদ আচার্র্য্য: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক। নারীমুক্তি ও বেগম রোকেয়া গ্রন্থের লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<79008 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1