শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

সিন্ডিকেট-দুর্ভাবনার নিরসন চাই

নতুনধারা
  ১২ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

'মুরগি নিয়ে গেছে নিয়ে যাক, কিন্তু শেয়াল যে বাড়ি চিনে গেছে- বেড়ার ফাঁক দেখে গেছে, সেটাই দুর্ভাবনার মূল কারণ'- এমন একটি গ্রাম্য প্রবাদ বাক্যের সঙ্গে আমরা কম অথবা বেশি সবাই পরিচিত। পেঁয়াজের মতো একটি কৃষিপণ্য কম খেলে বা বেশি খেলে কিংবা একেবারেই না খেলে মানুষের মারা যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। এমন দ্রব্য আরও আছে- যেমন আদা, রসুন, কাঁচা মরিচ, শুকনো মরিচ, চিনি, কেরোসিন। কিন্তু খুবই অল্পদিনের ব্যবধানে কেবল অস্বাভাবিক নয়- যা ভাবনারও অতীত, এক একটি দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে কী দুঃসহ দুঃখ-দুর্দশা, দুর্ভোগ-বিড়ম্বনা ও সীমাহীন দুর্ভাবনা পোহাতে হয় সাধারণ মানুষকে তা সহজে বর্ণনা করার নয়। ওপনিবেশিক ইংরেজ ও পাকিস্তান আমল, এমনকি স্বাধীনতা লাভের পরেও আমরা দেখেছি। দু-আনা সের দরের লবণ কীভাবে প্রতি সের ষোল টাকা, দু-টাকা সেরের শুকনো মরিচ দেড়শ টাকা, বিশ টাকার কাঁচা মরিচ ২০০ টাকা; আমার কাছে মনে হয় এই তো, সেদিনের কথা। কিন্তু সাম্প্রতিক পেঁয়াজের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি বোধ করি সবার মনেই স্থায়ী দাগ হিসেবে থেকে যাবে। চোখের পলকে, দেখতে না দেখতে ত্রিশ টাকার পেঁয়াজ লাফাতে লাফাতে একেবারে ২৫০ টাকা! ওপনিবেশিক শাসন নয়, যুদ্ধ-পরবর্তী অস্থির কোনো দেশও নয়। আমাদের স্বাধীনতার বয়স এখন পুরোপুরি আটচলিস্নশ। তাহলে আমরা এ কোন বাংলাদেশের রূপ দেখছি আজ? এ কোন বাঙালি জাতির বৈশিষ্ট্য-চরিত্র আমরা প্রত্যক্ষ করছি? রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন- 'সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী/ রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি।' কবির এ খেদমিশ্রিত অভিমানের বৃত্তাবরণ থেকে আমরা কবে এবং কীভাবে আর বের হবো, বের হতে পারব? স্বার্থান্বেষীদের দ্বারা তৈরি সিন্ডিকেট যে সময় সময় কী ভয়াবহ দুর্দশা-দুর্ভোগ-বিড়ম্বনা-দুর্ভাগ্য ও বেদনার কারণ হতে পারে তা ইতিহাসের কৌতূহলী পাঠকমাত্রই কম আর বেশি অবহিত। তথাকথিত ওই সিন্ডিকেট কখনো কখনো গোটা দেশ তথা সমগ্র জাতির জন্যই বিরাট অভিশাপ হয়ে দেখা দেয়। মনে হয় ওদের কব্জায়ই সবকিছু। কেবল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর দাম নির্ধারণ নয়, এর ওঠানামা- এমনকি মানুষের জীবন-মরণও যেন ওদেরই হাতে!

তখন কেবল উপমহাদেশে নয়, দুনিয়ার দেশে দেশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫) দামাম বেজে চলেছে। চারদিকেই গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ। বিশ্বব্যাপী সাধারণ মানুষের বলতে গেলে ত্রাহী অবস্থা।

১৯৪৩ সালে অবিভক্ত বাংলায় একটি কৃত্রিম দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়েছিল। এতে আনুমানিক পঞ্চাশ লাখ লোক (মোট জনসংখ্যা ছয় কোটি ত্রিশ লাখ) না খেয়ে মারা যায়। তখন কিন্তু দেশে খাদ্যের অভাব ছিল না। ধান-চালের ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর লক্ষ্যে হাজার হাজার মন ধান-চাল গঙ্গায় ফেলে দেয়। তখন একজন ভারতীয় কবি লিখেছিলেন :

'অল থিংস আর এক্সপেনসিভ নাও বিকজ অব ওয়ার অ্যান্ড স্ট্রাইফ, দ্য অনলি থিং দ্যাট ইজ রিয়েলি চিপ টুডে ইজ হিউম্যান লাইফ।'যুদ্ধের পর তদন্ত কমিশন বসল। কমিশন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে দুর্ভিক্ষের সময়টিতে ব্যবসায়ীদের স্বার্থান্বেষী সিন্ডিকেট অন্তত পাঁচশ' কোটি টাকা অতিরিক্ত মুনাফা লুটে নিয়েছে। প্রতিটি মৃতু্যর বিপরীতে এক হাজার টাকা করে মুনাফা লোটা গেছে।

এবার পেঁয়াজ নিয়ে দেশে হুলস্থূল কান্ড ঘটেছে, যা এখনো চলমান। এতে লাভবান হয়েছে মূলত সিন্ডিকেটের আওতাভুক্ত লোভাতুর-মানাফাখোর স্বার্থান্বেষীরা। প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা হয়েছেন নানাভাবে হয়রানির শিকার। আর সাধারণ মানুষের তো দুর্ভোগ-ভোগান্তি আছেই। এরই মধ্যে লবণ নিয়েও শুরু হয়ে গিয়েছিল ভিন্ন এক নাটক। সরকার অবশ্য এবার লবণের মূল্যবৃদ্ধির গুজবটি শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত হওয়ার আগেই একেবারে অঙ্কুরে শেষ করে দিতে সফল হয়েছে। কিন্তু দুর্বৃত্ত-মতলববাজরা কি বসে আছে নাকি বসে থাকবে? পেঁয়াজের পর লবণ, লবণের পর আর কোনটাকে ধরা যায়- এসব নিয়েই তো ওদের কায়কারবার। কঠোর হতে হবে। পণ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি এবং গুজব সৃষ্টি ও ছড়ানোর সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর হতে হবে। তা না হলে দুর্ভোগ-বিড়ম্বনা আর ভোগান্তি আমাদের পিছু ছাড়বে না। যে কোনো উপায়েই হোক এই জনগণস্বার্থবিরোধী, জনভোগান্তি সৃষ্টিকারী 'সিন্ডিকেট-বেড়াজাল'-এর বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

বিমল সরকার

অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

বাজিতপুর

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<79519 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1