বড় অদ্ভুত একটি দেশ তা হলো বাংলাদেশ, যা অসম্ভব তাও এখানে সম্ভব হয়। বাঙালি জাতির হাজারের বছরের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত মহান স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার ইতিহাস রচনা নিয়ে চলছে নানা ষড়যন্ত্র। তার শুরু ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর থেকে আজ পর্যন্ত তথ্য বিভ্রাট হয়েই চলছে। ১৯৭১ থেকে ২০১৯ এই চার যুগেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার বা পাকিস্তানের দোসদের সংখ্যা সঠিকভাবে নির্ণীত হয়নি। এখনো মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে প্রকাশিত তালিকা নিয়ে রয়েছে নানা ধরনের রম্য বিতর্ক। শোনা যায় মুক্তিযুদ্ধ না করেই নাকি অনেকেই আজ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। যা এ দেশের সূর্যসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের ১৯৭১ সালের রণাঙ্গণের মহান অবদানকে ম্স্নান করে দেয়। সম্প্রতি সরকার রাজাকারের যে তালিকা প্রকাশ করতে চলেছেন তা প্রকাশ হওয়ার আগেও অনুমেয় হচ্ছে এটাও হবে একটি বিতর্কিত বিষয়। গত ৩ ডিসেম্বর-২০১৯ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাক রাজাকারের সংখ্যা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে এই প্রতিবেনটি দেখে মনে হলো, রাজাকারের যে তালিকাটা আগামী বিজয় দিবসের আগে প্রকাশিত হবে তাতে অনেক তথ্য গোপন করা হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, রাজাকারের তালিকা প্রণয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা হয়েছে ১১ হাজার রাজাকারের নাম তা থেকে প্রথমিকভাবে চূড়ান্ত হয়েছে ৮ হাজার রাজাকারে নাম সংবলিত তালিকা। বিষয়টি বিস্মিত হওয়ার মতো ঘটনা। সারা দেশে মাত্র ৮ হাজার বা ১১ হাজার রাজাকার ছিল। তাই যদি হয় তাহলে কী করে ১৯৭১ সালে নয় মাসে পাক-হায়েনার দল ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা এবং দুই লাখ মায়ের সম্ভ্রম হানি ঘটালো। পাক-হায়েনারা এত অল্প সময়ে এতগুলো মানুষকে চেনার কথা নয়। পাক-হায়েনার দল যদি ওই সময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষকে চিনতে না পারত তাহলে তারা এ ধরনের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ঘটাতে পারত না। তা ছাড়া ১৯৭২ সালে গঠিত যুদ্ধাপরাধী বিচার ট্রাইবু্যনালের জন্য গঠিত বিচারালয়ে আসামি হিসাবে সারা দেশে রাজাকারের সংখ্যা ছিল ৫৫ হাজার। স্বাধীনতা অর্জনের পর চারযুগ পরে, কীভাবে সারা দেশ থেকে ৪৪ হাজার বা ৪৭ হাজার রাজাকারের নাম উধাও হয়ে গেল। আগামী বিজয় দিবসে রাজাকারের যে তালিকাটা প্রকাশ করা হবে তার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের বিষয়টি দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা দিতে হবে। দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত সংবাদটির ভিত্তিতে জানা যায়, জেলা প্রশাসকরা রাজাকারের তালিকা সংগ্রহের কাজটি করেছেন। জেলা প্রশাসকদের প্রেরিত প্রতিবেদন অনুযায়ী নাকি আগামীর প্রকাশিতব্য তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। জেলা প্রশাসকরা যে রাজাকারের তালিকা প্রস্তুত করার জন্য তথ্য সংগ্রহ করছেন এই বিষয়টি জেলার সাধারণ মানুষের কতটা জানা ছিল। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর দেখা যায়, রাজাকার এবং তাদের সন্তানরা প্রশাসনসহ রাজনৈতিক ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনে পদাসীন। তাদের ক্ষমতার পরিধি ব্যাপক। রাজাকারের সন্তানদের সরকারি এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলে দেখা যায়। অনেক রাজনৈতিক দলে তারা গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে আছে। সুতরাং তাদের পিতার নাম তালিকাভুক্তি কি এতই সহজে হবে। দেশের অনেক জায়গায় রাজনৈতিক পরিবর্তন এমন হয়েছে যে, রাজাকারদের ভয়েই মুক্তিযোদ্ধা বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি তটস্থ থাকে। দৈনিক ইত্তেফাকের প্রকাশিত সংবাদের মাধ্যমে জানা যায়, জেলা প্রশাসকদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যশোরের শার্শা, গাইবান্ধা, শেরপুর, মাগুরা, খাগড়াছড়ি জেলায় কোনো রাজাকার নেই। আমরা জানি শেরপুর জেলার একটি গ্রাম বিধবা গ্রাম হিসেবে পরিচিত। এই গ্রামটিতে পাক-হায়েনার দল ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় সব পুরুষকে হত্যা করেছিল যার জন্য এই গ্রামের নারীরা বিধবা হয়ে যায় ফলে গ্রামটি বিধবা গ্রাম হিসেবে পরিচিত হয়ে যায় ওই অঞ্চলে। এখানে প্রশ্ন- এর উদ্রেক হওয়াটা স্বাভাবিক, পাক-হায়েনারা এই গ্রামটি চিনেছিল কাদের মাধ্যমে? কোন যুক্তিতে আসে যে, শেরপুর জেলায় একজনও রাজাকার নেই। যুদ্ধাপরাধী দন্ডপ্রাপ্ত কামরুজ্জামানের বাড়ি শেরপুরে, সেখানে কি তার একটিও সহযোগী ছিল না। যশোরের শার্শা উপজেলা এবং গাইবান্ধা, মাগুরা, খাগড়াছড়ি জেলায় ৭১-এ পাক-হায়েনার দল কি কোনো বাড়িতে অগ্নিসংযোগ লুটতরাজ করেনি। যদি করে থাকে তাহলে কাদের মাধ্যমে তারা ওই বাড়িঘরগুলো চিনেছিল। রাজা ত্রিদিব রায় ছিল স্বাধীনতাবিরোধী তার কোনো সহযোগী কি খাগড়াছড়ি জেলায় নেই। রাজশাহী জেলার রাজাকারের সংখ্যাটিও যথার্থ নয়। কারণ এই জেলাটি স্বাধীন হয় সারা দেশ বিজয় অর্জনের দুদিন পর। অর্থাৎ ১৮ ডিসেম্বর রাজশাহী পাক-হায়েনা মুক্ত হয়। রাজশাহীতে রাজাকারের সংখ্যা যদি অধিক নাই হতো, তাহলে যেখানে সারা দেশ ১৬ তারিখ স্বাধীন হয়েছে সেখানে কেন দুদিন পর রাজশাহী পাক-হায়েনার দখলদারিত্ব থেকে মুক্তি পায়? রাজশাহীতে ছিল রাজাকারের সংখ্যা অন্য যে কোনো জেলার চেয়ে বেশি তার কারণে এই জেলাটি বিজয়ের দুদিন পর পাকসেনামুক্ত হয়, তা ছাড়া রাজাকারের সংখ্যা বেশি হওয়ার প্রমাণ মেলে এখানকার জামায়াতের উত্থান দেখে। জামায়াত ও জেএমবির ঘাঁটি এ জেলায়। ময়মনসিংহ জেলার ভালুকা উপজেলায় রাজাকারের সংখ্যা বলা হয়েছে মাত্র ১৯ জন। অথচ ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনের সংসদ সদস্য ছিল মুসলিম লীগের এবং ৮৬-এর সংসদ সদস্যও মুসলিম লীগের। সুতরাং ভালুকার সঠিক তথ্য যাচাই-বাছাই ছাড়াই রাজাকারের সংখ্যা বলা হয়েছে। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন, ২০১৬ সালের দৈনিক প্রথম আলোর প্রকাশিত একটি সংবাদে দেখা যায়, ১৯৮৪ সালে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৮ জন, ১৯৮৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের তার সংখ্যা ছিল ৬৯৮৩৩ জন, ১৯৯৪ সালের এর সংখ্যা হয় ৮৬০০০, ২০০১-এ দুটি সংখ্যা পাওয়া যায় তা হলো- ১ লাখ ৮৬ হাজার ১৯০ জন আরেকটি ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪৫২ জনের, ২০০৬ সালে ১ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৯ জনের, বর্তমানে যে সংখ্যাটি উলেস্নখ করেছে তা হলো ২ লাখ ১৫ হাজার। মুক্তিযোদ্ধার এই সংখ্যাগত পার্থক্যের কারণ হিসেবে রয়েছে নানা অভিযোগ। যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছিল তারা নিজেদের মতো করে এই তালিকা প্রণয়ন করেন। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাটিও রাজনৈতিক দোষে দুষ্ট। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে একটি উদাহরণ হিসেবে দেয়া যায় তা হলো-
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের বেশ কয়েক বছর পর ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়নের ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ গেরিলাবাহিনীকে রাষ্ট্রীয় গেজেটভুক্ত করে। সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন তারিখ ৭ শ্রাবণ/১৪২০ বাংলা ২২ জুলাই/২০১৩ ইংরেজি নং ৪৮.০০.০০০০.০০৪.৩৭.১৪৯ ২০১৩-৪৩৯ জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন ২০০২(২০০২ সালের ৮ নং আইন)-এর ৭(ঝ) ধারা অনুযায়ী ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়ন বিশেষ গেরিলাবাহিনী এবং এই বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের ২৩৬৭ জন মুক্তিযোদ্ধার তালিকা সরকার রূলস অব বিজনেস ১৯৯৬-এর সিডিউল-১ (এলোকেশান অফ বিজনেস)-এর তালিকা ৪১-এর ৬নং ক্রমিকের ক্ষমতা বলে তালিকাভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করে। ২২ জুলাই/২০১৩ ইংরেজি নং ৪৮.০০.০০০০.০০৪.৩৭.১৪৯ ২০১৩-৪৩৯ নং গেজেটে প্রকাশিত তালিকাটি কি নির্ভুলভাবে প্রণীত হয়েছিল তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দেয়, মুক্তিযুদ্ধের ৪২ বছর পর প্রকাশিত এই তালিকাটি কি সেই সময়ের ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত গেরিলাবাহিনীর তালিকা অনুসরণ করে তৈরি করা হয়েছে নাকি ৪২ বছর পর এই সময়ে যারা মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা বাহিনীর সদস্য হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল তাদের নাম সংগ্রহ করে তালিকা তৈরি করা হয়েছে তা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রকাশের ৪২ বছরের মধ্যে ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্বের ঘটেছে নানা ধরনের পরিবর্তন, সোভিয়েট পতনের পর মতদ্বৈততার কারণে পার্টি দুটিতে দেখা দিয়েছিল ভাঙন। এই ভাঙনে একাধিক পার্টির জন্ম হয়েছে আবার কেউ কেউ অন্য দলে যোগ দিয়েছেন। নানা সময়ে ঘটেছে ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব। তাই প্রকাশিত গেজেটটির যথার্থতা নিয়েও বিভিন্ন ধরনের মারাত্মক প্রশ্ন রয়েছে। ২২ জুলাই/২০১৩ ইংরেজি নং ৪৮.০০.০০০০.০০৪.৩৭.১৪৯ ২০১৩-৪৩৯ নং গেজেটে রাজশাহীর সেই সময়ের ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মরহুম মোরশেদ কোরায়শী স্বপন এবং শফিকুর রহমান বাদশার নাম নেই। ২০১৬ সালে প্রয়াত রাকসুর সাবেক ভিপি ৭১-এর ছাত্র ইউনিয়ন নেতা অ্যাডভোকেট আব্দুর রাজ্জাক, তিনি ছিলেন ন্যাপ কমিউনিস্ট পার্টি ছাত্র ইউনিয়নের ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ গেরিলাবাহিনীর ভারতে স্থাপিত প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের প্রশিক্ষক। তিনি বলেছিলেন, স্বপন ও বাদশা উভয়েই প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। তা ছাড়া ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার বাটাজোর গ্রামের আজীবন কমিউনিস্ট কমরেড মোজ্জামেল হকের নামটিও এই তালিকায় নেই। তিনি গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ১১ সাবসেক্টর থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক জাগ্রত বাংলার সাংবাদিক হিসাবে দায়িত্বও পালন করতেন।
মুক্তিযোদ্ধারা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, তারা নির্ভীক, নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন দেশমাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে সুতরাং তাদের স্থান সর্বোচ্চ জায়গায়। এই শ্রেষ্ঠ বাঙালি সন্তানদের কাতারে যদি অমুক্তিযোদ্ধারা তালিকাভুক্ত হয় তাহলে ৩০ লাখ শহীদ জাতিকে অভিসম্পাত করবে।
সরকারের উচিত যেমন- সঠিকভাবে কুখ্যাত রাজাকারদের তালিকা প্রণয়নের ঠিক তেমনি বাংলার শ্রেষ্ঠ সূর্যসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল তালিকা প্রস্তুত করার। যদি বাংলার সূর্যসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল তালিকা প্রকাশ না করা হয় তাহলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বিতর্ক করেই যাবে, যা হবে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মর্যাদাহানিকর একটি বিষয়। সরকারের উচিত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সঠিক তালিকা প্রস্তুত করা।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন: কলাম লেখক