শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশের মানবিক দিক

বাংলাদেশের রবিউল ইসলাম রাজ, শওকত ও তার সঙ্গীরা যে দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন, এ দেশের মানুষ পুলিশের কাছ থেকে তাই আশা করে। মানুষের অসুবিধে বা বিপদের সময় যদি পুলিশ তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে সবার অসুবিধা দূর করেন বা সমস্যা নিরসনে সহায়তা করেন, তাহলেই মানুষ পুলিশকে পাবে মানব সেবক হিসেবে। মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সার্বিক দিকে সহায়তা করাই পুলিশের দায়িত্ব। এ দেশে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনেকেই পুরস্কার পান, কনস্টেবল শওকত ও তার ছজন সঙ্গী কি সেই পুরস্কারের যোগ্য নন?
আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ
  ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

দীর্ঘদিন পর সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটা প্রবন্ধের কথা মনে পড়ে গেল। তার প্রবন্ধের একটা লাইন এই ধরনের ছিল : হিন্দু হইলেই ভালো হয় না, আবার মুসলমান হইলেও খারাপ হয় না। মুসলমানদের মধ্যেও অনেক ভালো লোক আছে, আবার হিন্দুদের মধ্যেও অনেক ভালো লোক আছে। এই উদ্ধৃত অংশের ভাষার মধ্যে পার্থক্য থাকতে পারে দীর্ঘদিন আগে পড়া প্রবন্ধের। তবে, মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ের মধ্যে বিন্দুমাত্র পার্থক্য নেই।

বঙ্কিমচন্দ্র যে কথা এক শতকেরও আগে বলেছিলেন তা আকস্মিকভাবে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল দৈনিক 'যায়যায়দিন' পত্রিকায় তেইশে নভেম্বর ও পয়লা ডিসেম্বর পুলিশ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশের পর। সাধারণভাবে বাংলাদেশের পুলিশ মানববন্ধু নয় বলে প্রচারিত। পুলিশ সাধারণ মানুষের অভিযোগে কান দেন না, বরং প্রভাবশালী তাদের কথা অনুযায়ী কাজ করেন (বিদ্যমান কারণে)। সাধারণ মানুষকে হ্যারাস করেন, সুযোগ পেলেই অনবরত পকেটের ভেতরে হাত ঢোকান। এই শ্রেণির অসংখ্য অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ করে থাকেন। একটা ঘটনার উলেস্নখ করলেই এই দিকটি স্পষ্ট হবে। আমার পরিচিত কয়েকজনের খালি জমি পড়ে ছিল ঢাকার একটি অঞ্চলে। একদিন কয়েকজন সেই জমি অবৈধভাবে দখল করে চার-পাঁচজন নর-নারীকে সেখানে বসিয়ে দেয়। থানায় অনেক চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয়নি। তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন কাজী জাফর আহমদ। প্রতিকারের জন্য তার একজন বন্ধুকে তার কাছে ঘটনার উলেস্নখ করলে তিনি তাৎক্ষণিক থানার ওসিকে ডেকে দখলকারীদের উচ্ছেদের নির্দেশ দেন এবং পরদিন সকালেই জমি দখলকারীরা জমি ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।

ঝিনুকের মধ্যে যেমন মুক্তা থাকে, বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধের মতো কিছু মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষও থাকেন পুলিশ বাহিনীতে। গত নভেম্বরের একুশ তারিখে ট্রাক-বাস হরতাল থাকায় কিছু তরুণ শিক্ষার্থী বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। রাস্তায় রিকশার সংখ্যাও ছিল স্বল্পতর, সে জন্য রাস্তায় রিকশাও দেখা যাচ্ছিল না।

সেদিন ছিল প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা (পিএসসি)। পরীক্ষা হয় সকাল সাড়ে ১০টা থেকে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নিয়ে অনেক আগে থেকেই রাস্তা বেরিয়ে পড়েছিলেন, ঠিক সময়ে কিন্তু রাস্তায় কোনো যানবাহন নেই, দুশ্চিন্তায় তাদের মধ্যে প্রচন্ড অস্থিরতা, কিভাবে সন্তানদের পরীক্ষা অনুষ্ঠানের আগে শিক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছিয়ে দেবেন। ক্রমেই যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদ, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ভিড় বাড়তে থাকে। একই দিন একই সময়ে নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজেও ছিল দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা। সবার মধ্যে উৎকণ্ঠা, কিভাবে স্কুল-কলেজে ঠিক সময়ে পৌঁছানো যাবে।

এ সময়ে ডেমরা ট্রাফিক জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. রবিউল ইসলাম রাজু রাস্তায় ট্রাফিক কার্যক্রম মনিটর করতে এসেছিলেন সরকারি গাড়িতে। তিনি নিজের গাড়িতে স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের শুধু পাঠাননি, তার পাশাপাশি আশপাশের পিকআপ ভ্যান ভাড়া করে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের তুলে দিয়ে সাহায্য করেন। তোলারাম কলেজের ছাত্র কলেজে দেরি করে যাওয়ায় কলেজ কর্তৃপক্ষ সেদিন তার পরীক্ষা না নিলেও রবিউল ইসলাম অন্যদিন তার পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দেন।

সহকারী পুলিশ কমিশনার রবিউল ইসলামের কাজ কী শুধু পুলিশের দায়িত্ব বলে শেষ করে দেওয়া থাকে? তিনি তো এক স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধিকারী, যার মধ্যে আছে মানবিক আদর্শবোধ, কর্তব্য, দায়িত্ব ও বিপদগ্রস্ত মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা, যে ভালোবাসা তিনি পোষণ করেন নিজের পরিবারের জন্য। এই শ্রেণির মানবিক অনুভূতি তিনি অর্জন করেছেন আদর্শবোধ থেকে, যে আদর্শবোধ শুধু দায়িত্ব দেখায় না, দেখায় অনুভূতিক লাবণ্য, নিজের ও অন্যের প্রতি ভালোবাসা। এই মানবিক অনুভূতি ও আদর্শবাদই একজনকে অন্যায়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। শিক্ষা দেয় সব মানুষই সমান, সবারই সমান অধিকার আছে। আমরা চাইব এ দেশে অসংখ্য রবিউল ইসলাম জন্মগ্রহণ করুন হাতে মানবিক আদর্শের পতাকা নিয়ে। রবিউল ইসলামের মধ্যে যে মানবিকতা আছে চট্টগ্রাম পুলিশের সাতজন কর্মকর্তার নিভৃত মানব সেবার ঘটনা শোনার পর মানুষের মাথা নিচু হয়ে আসবে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।

বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরের রাস্তার এককোণে বা ফুটপাতে অনেক সময় দুয়েকজন নারীকে নোংরা পোশাকে দীর্ঘদিন গোসলবিহীন মাথায় উসকো-খুশকো চুল নিয়ে মুখ নিচু করে অসহায়ভাবে বসে থাকতে হয়। এর মধ্যে অনেকে হয়তো অসুস্থ, গায়ে ঘা ও পোকা থাকায় দুর্গন্ধ বেরুলে পথচারীরা নাকে রুমাল দিয়ে পাশকাটিয়ে যান। বিনা চিকিৎসায় এরা করুণার পাত্রী হয়ে বসে থাকে। জায়গা হয় না হাসপাতালেও। এই শ্রেণির রুগিনীর প্রতি দৃষ্টি পড়ে একজন সাধারণ পুলিশ কনস্টেবলের, পরে তার সঙ্গে যোগ দেন আরো ছয়জন পুলিশ। সাতজন পুলিশ নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে নয় বছর এই শ্রেণির হতভাগ্য মানুষের সেবা করে তাদের বাঁচাতে এগিয়ে আসেন। জ্যোতিশাস্স্ত্রে সাত সংখ্যা শুভ সংখ্যা হিসেবে পরিচিত। নিজেদের অজ্ঞাতেই বোধহয় সাতজন পুলিশ একটা শুভ সেবার ফল গঠন করেন।

এই সাতজন পুলিশ ছিলেন চট্টগ্রামের দামপাড়া পুলিশ হাসপাতালের কনস্টেবল। প্রথমে কনস্টেবল শওকতের উদ্যোগেই ২০১১ সালে তার সঙ্গে যোগ দেন আরও দুজন সহযোগী। অল্প বেতনভোগী এই সাতজন নিজেদের মাইনের একটা অংশ ব্যয় করতেন রোগীদের সেবায় সবার অগোচরে, শুধু অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কোনো প্রত্যাশা বা প্রাপ্তির জন্য নয়, মানুষের কল্যাণের জন্য। কনস্টেবল শওকত নার্সিং ও প্যারামেডিক ডিপেস্নামা অধিকারী ছিলেন বলে বিশেষ শ্রেণির রোগীদের সেবায় আরোগ্য করার সুযোগ লাভ করেছিলেন। শওকতের দল রোগীদের নতুন জীবন দান করার প্রচেষ্টায় এগিয়ে এলেও গুরুতর অসুস্থ সব রোগীকে বাঁচাতে পারেননি- এটাই তাদের সবচেয়ে বড় দুঃখ। তার দল যে কাজ করতেন তা সহজ ছিল না। কারণ, শরীরের ক্ষতস্থানে পোকা ধরে যাওয়ায় অত্যন্ত দুর্গন্ধ বেরুতো, চলৎশক্তিহীন রোগীদের মলমূত্র পরিষ্কার ও পরনের কাপড় পরিবর্তন করে দিত।

শওকত নিজের মোবাইল নম্বর কয়েকজন লোককে দিয়ে এই ধরনের রোগীর সন্ধান পেলেই তাকে জানানোর জন্য অনুরোধ করার পর রোগীর সংখ্যা অতিরিক্ত বৃদ্ধির জন্য একা তার পক্ষে সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। এ সময় তিনি তার দুজন সহকর্মীকে ঘটনাগুলো বলার পর তারাও তার পাশে এসে দাঁড়ান। এভাবে ক্রমশ সদস্য সংখ্যা অতিরিক্ত বৃদ্ধির পর সাতজনের একটা টিম গড়ে ওঠে। কিন্তু রোগীর সংখ্যা ক্রমশ এত বৃদ্ধি পায় যে, সাতজনের পক্ষে আর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। তখন তারা চট্টগ্রামের পুলিশের মাসিক কল্যাণ সভায় নিজেদের সেবাব্রতের কথা উত্থাপন করে সবার সহযোগিতার প্রার্থনা করেন। শওকতের সব কথা শুনে সবাই বিস্মিত ও অভিভূত হয়ে পড়েন। চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার 'মানবিক পুলিশ ইউনিট' গঠন করার কথা জানিয়ে তিনি শওকতকে তহবিল সংগ্রহের অনুরোধ জানিয়ে নিজে এক লাখ টাকা অনুদান দেন। কনস্টেবল শওকত ও তার সাতজনের মানবহিতৈষী দলের কাহিনী এখানেই নতুনভাবে শুরু হয়ে ভবিষ্যতের দিকে বাতিঘর নিয়ে এগিয়ে যাবেন। যাদের দিকে কেউ ফিরে তাকান না সেই সব মানুষের সেবা করে তাদের জীবনে নতুন আলোক শিখা জ্বালাতো।

কনস্টেবল শওকত ও তার দলের বর্তমান কাহিনী শেষ হয়েছে হয়তো, কিন্তু যে প্রসঙ্গে এই গল্পের সূত্রপাত তা এখনো বলার বাকি আছে। আমরা যখন নবম শ্রেণির ছাত্র সেই সময় নবম-দশম শ্রেণির ইংরেজি টেক্সট বই বিদেশ থেকে ছাপা হয়ে আসত অর্থাৎ বিদেশি পাঠ্যবই ব্যবহৃত হতো। সেখানে কবি লি হান্টের 'আবু বিন আদম' শীর্ষক একটা কবিতা ছিল। কবিতাটা আমাদের কিশোর মনে এমন প্রভাব বিস্তার করেছিল- যা আজো ভোলা সম্ভব হয়নি। আরব দেশে আবু বিন আদম নামে একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন। তার কোনো পরিবার-পরিজন ছিল না। তার অদ্ভুত একটা শখ ছিল। তিনি প্রতিদিন সকালে টাকা-পয়সা ও কাপড় চোপড় নিয়ে এক একটা দরিদ্র পলস্নীতে যেতেন। সেখানে মানুষের সঙ্গে গল্প করে টাকা-পয়সা ও সঙ্গে আনা জিনিসপত্র বিলিয়ে দিয়ে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরতেন। সকাল, দুপুর ও রাত এই তিন বেলাই তিনি তাদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করতেন। তার মৃতু্যর পর একবার কয়েকজন ফেরেস্তা তার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, আবু বিন আদম, তোমাকে নিয়ে আমরা ভারী বিপদে পড়েছি। জীবনে তুমি ও কোনো ধর্মকর্ম করনি, তোমাকে বেহেস্তে না দোজগের কোন খাতায় নাম লিখব তা বুঝতে পারছিনে। আবু বিন আদম স্বাভাবিকভাবে বললেন, তোমরা কোন খাতায় আমার নাম লেখো সে ব্যাপারে আমি বিন্দুমাত্র চিন্তা করছিনে। ঠিক আছে এ ব্যাপারে যিনি সবার ওপরে তার মত জেনে আগামীকাল সকালে আবার আসব তোমার কাছে। এই বলে ফেরেস্তারা সেখান থেকে চলে গেলেন। পরদিন সকালে ফেরেস্তারা আবার আবু বিন আদমের কাছে এলেন। তাদের হাতে যারা বেহেস্তে যাবে সেই খাতা। তারা খাতার প্রথম পাতা খুলে আবু বিন আদমের দিকে তাকিয়ে বললেন, যারা বেহেস্তে যাবেন তাদের নাম তোমাকে পড়ে শোনাচ্ছি। এক নম্বর, আবু বিন আদম। আবু বিন আদম বিস্মিত হয়ে বললেন, সে কী! আমার নাম এক নম্বরে কিভাবে হলো? ফেরেস্তারা হেসে বললেন, এ ব্যাপারে স্রষ্টাকে আমরা জিজ্ঞাস করেছিলাম। তিনি উত্তর দিয়েছেন যে, আবু বিন আদম ধর্মকর্ম করেনি তা ঠিক, কিন্তু আমার সৃষ্ট অসহায় মানুষদের ভালোবেসে অনেক আগেই আমার কাছে পৌঁছে গেছে। এই কবিতার আর কোনো টিকা-টিপ্পনীর প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।

বাংলাদেশের রবিউল ইসলাম রাজ, শওকত ও তার সঙ্গীরা যে দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন, এ দেশের মানুষ পুলিশের কাছ থেকে তাই আশা করে। মানুষের অসুবিধে বা বিপদের সময় যদি পুলিশ তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে সবার অসুবিধা দূর করেন, বা সমস্যা নিরসনে সহায়তা করেন তাহলেই মানুষ পুলিশকে পাবে মানব সেবক হিসেবে। মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সার্বিক দিকে সহায়তা করাই পুলিশের দায়িত্ব। এ দেশে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনেকেই পুরস্কার পান, কনস্টেবল শওকত ও তার ছজন সঙ্গী কি সেই পুরস্কারের যোগ্য নন?

ড. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ: কথাসাহিত্যিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<79712 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1