বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রবীণদের চোখে বিশ্ব দেখুন

মোশারফ হোসেন প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ সরকারি ইস্পাহানী কলেজ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা
  ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ০০:০০

প্রবীনরা আমাদের শেকড়। শেকড় যেমন গাছকে শক্তভাবে ধরে রাখে, তেমনি প্রবীণরা তাদের অতীত জীবনের অর্জিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা দিয়ে আমাদের জীবনের শত বন্ধুর পথকে মসৃণ করে। আমাদের জীবনে নানাভাবে সাহস ও প্রেরণা দিয়ে উজ্জীবিত রাখে। পারিবারিক সামাজিক রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রবীণদের অবদান অসীম। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে আধুনিকতাকে ছুঁতে গিয়ে অন্ধাণুকরণের মাধ্যমে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে নিজস্ব সংস্কৃতি অর্থাৎ আবহমান বাংলার ঐতিহ্য, স্বকীয়তা ভুলে বহুমখী কর্র্মব্যস্ততায় প্রিয়জনের প্রতি দায়বদ্ধতা উপেক্ষা করে ভুলজালের সম্পর্কে আবদ্ধ হচ্ছি। পরিবারকেন্দ্রিক চিন্তার বাইরে গিয়ে পারিবারিক বন্ধনকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করছি। তাতে বয়স বৈষম্যের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শ্রদ্ধাপ্রাপ্য অত্যন্ত আপন প্রবীণ মানুষটি। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রবীণদের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। যা মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ, এর মধ্যে ১ কোটি প্রবীণরাই দরিদ্র। প্রবীণ নারী-পুরুষ, গ্রামের প্রবীণ ও শহরের প্রবীণ নানা শ্রেণিতে বিভক্ত। জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা অনুযায়ী আমাদের দেশে ৬০ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সি ব্যক্তি প্রবীণ। এ ছাড়া বয়সের ভিত্তিতে কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। যেমন- ৬০-৭০ বছর, ৭০-৮০ বছর, ৮০- আরও বেশি বয়স। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে ৬০-৮০ বছর পর্যন্ত জ্যেষ্ঠ নাগরিক (সিনিয়র সিটিজেন), ৮০-এর উপরে (সুপার সিটিজেন) হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। ২০৫০ সালের ২০০ কোটি যুবক বার্ধক্যে উপনীত হবে। এ ক্ষেত্রে গড় আয়ু যত বাড়বে প্রবীণদের সংখ্যা তত বাড়বে। ক্ষমতায়ন অর্থাৎ অর্থবিত্তের ভিত্তিতে শ্রেণিকরণ করা যায়। এভাবে উচ্চ মধ্যবিত্ত, মধ্য মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত প্রবীণ শ্রেণি। এদের মধ্যে নিম্ন মধ্যবিত্ত প্রবীণ শ্রেণিটি নানাভাবে বঞ্চিত।

প্রাকৃতিক চরম বাস্তবতার নাম বার্ধক্য। শৈশব-কৈশোর ও যৌবনের শেষ অধ্যায়ই বার্ধক্য। এই নিয়মের বেড়াজাল থেকে রেহাই পায়নি ধনী-গরিব, রাজা-বাদশা, উজির-নাজির, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই। জীবন সায়াহ্নে কর্মক্ষম, পরনির্ভরতা, একাকিত্ব, অসহায়ত্ব, দুর্বিষহ, হতাশা, অপ্রাপ্তি, দুশ্চিন্তা, রোগ-শোক, জরা-জীর্ণতা ইত্যাদি এসে বাসা বাঁধে প্রবীণদের মনে। বার্ধক্যের স্বাভাবিক নিয়তি হচ্ছে- শারীরিক পরিবর্তন, সেবাহীন-অবজ্ঞা, যত্নহীন- বেদনা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যতা ইত্যাদি নিত্যদিনের সঙ্গী। এদের জীবন নামের রেলগাড়িটি চলতে থাকে শেষ অবধি মৃতু্যনামক স্টেশনে পৌঁছানোর পূর্বপর্যন্ত। ষাটোর্ধ্ব প্রবীণদের মধ্যে ৪৫ শতাংশ কোনো না কোনো শারীরিক সমস্যায় ভোগেন। আর ১০ শতাংশ ভোগেন কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায়। এ সম্পর্কে সচেতনতা না থাকার দরুণ প্রবীণদের প্রতি আমাদের ভুল-বোঝাবুঝি হয়। খারাপ ব্যবহার করে থাকি। চুল পাকা, চুল পড়া, দন্ত ক্ষয়, দন্ত পড়ে যাওয়া, চোখে কম দেখা, কানে কম শোনা, গায়ের চামড়া কুঁচকে যাওয়া, চর্মরোগ, অপুষ্টিতে ভোগা, মুখে অরুচি, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ঘুম কম হওয়া, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, হাত-পা-শরীর- কাঁপা, ঘন ঘন প্রশ্রাব শারীরিক নানা জটিল সমস্যা দেখা দেয়। প্রবীণদের হাজারো সমস্যা, জ্বালা-যন্ত্রণা, দীনতা-হীনতা, না পাওয়ার বেদনা নিয়ে মৃতু্যর সঙ্গে লড়ে প্রহর গুনতে থাকে এক সময় মৃতু্য হয় সব সমস্যা সমাধানকারী। আজকের সহায় সম্বলহীন, পরনির্ভরশীল প্রবীণ। দয়া-দাক্ষিণ্যের মধ্যে চলতে হয় হরভোজ। কারও কারও থাকার জায়গা হয় বিশাল ঘরের পাশের বারান্দায়। কখনো অন্ধকার, অস্বাস্থ্যকর, জরা-জীর্ণ ছোট্ট একটি কুঠুরিতে, কখনো গোয়াল ঘরে। জীবনযাত্রার মান অনেক ক্ষেত্রে হাজতবাসীদের চেয়েও নিম্নমানের অবস্থায়, হায় আফসোস! অধিকাংশ প্রবীণদের সমস্যার ধরন অনেক ক্ষেত্রে একই হলেও আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে ভিন্ন হয়ে থাকে। তারা মহুমাত্রিক সমস্যায় নিমজ্জিত। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় সবক্ষেত্রে নানা বৈষম্যের শিকার। প্রবীণরা মননে, মগজে, আচার-আচরণে চিন্তা-চেতনায়, ভাবপ্রকাশে, অনেকটাই শিশু হয়ে যায়। তাই এদের বলা হয় দ্বিতীয় শিশু। জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানোর সহজাত প্রবৃত্তি দানা বাঁধে। স্মৃতিকাতর হয়ে স্মৃতি হাতড়াতে থাকে। শৈশবের সোনালি সকাল, কৈশোরের দুরন্তপানা, যৌবনের মদমত্ততা-উন্মাদনার অমলিন স্মৃতিকাতর-করে দেয়। চোখ ছল ছল করে ওঠে সামান্য অবহেলায়। দুমড়ে-মুচড়ে যায় হৃদয়। শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে পরিবর্তন এসেছে সমাজ কাঠামোতে। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন শিথিল হচ্ছে নানাভাবে মূল্যবোধের অবক্ষয়, দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য, আন্তঃপ্রজন্মের মধ্যে মানবিতক গুণাবলির বিকাশের পথ রুদ্ধ হওয়ার মতো বিষয়গুলো জটিল রূপ নিচ্ছে। এক জরিপ থেকে জানা যায়, বর্তমানে যৌথ পরিবারের সংখ্যা প্রায় ১০ শতাংশ নেমে এসেছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রবীণ ও শিশু। জীবিকার খাতিরে স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই বাইরে থাকতে হচ্ছে। অসহায় প্রবীণ ও শিশুটির অসহায়ত্বের ঘনত্ব বাড়ছে। অণুপরিবার গড়ে ওঠার কারণে প্রবীণদের দেখার অতিরিক্ত কোনো লোক থাকছে না। এ ক্ষেত্রে আন্তঃপ্রজন্মের বন্ধন আলগা হচ্ছে। বঞ্চিত হচ্ছে নানা আদর-সোহাগমাখা ভালোবাসা এবং প্রবীণ শিশু এবং বর্তমান প্রজন্মের শিশু উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত মানসিকভাবে। দুই প্রজন্মের দুই শিশুর মন অত্যন্ত কোমল, বন্ধনের স্বাভাবিক ভারসম্যহীনতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, অভিমান, ক্ষোভ বাড়ছে। স্বাভাবিকভাবে প্রবীণরা শিশুদের সান্নিধ্যে থাকতে বেশি পছন্দ করে। তাদের পছন্দগুলো বিবর্ণ হতে চলেছে। উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী নারী কম সম্পত্তি পান। আর যা পান সেটা বাস্তবে নিজের হাতে পাওয়াটা অনেক দুস্কর হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে প্রবীণ পুরুষের ক্ষেত্রে নির্যাতনের হার যেখানে ৩৯.৬ শতাংশ, সেখানে প্রবীণ নারী নির্যাতনের হার ৫৪.৫ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে পিতা-মাতার ভরণ-পোষণের বিষয়টি। কিন্তু আইনে থাকলেই কি হবে। আদালতে গিয়ে সন্তানের বিরুদ্ধে মামলা করার নজির আমাদের সমাজ বাস্তবতায় খুব কম। যদিও পারিবারিক মূল্যবোধের সম্পূর্ণ বিপরীত এটা। তারা যদি পরিবার রাষ্ট্র থেকে নিগৃহীত হয় তাহলে তাদের এই দুর্দশাগ্রস্ততা থেকে পরিত্রাণের উপায় কি হবে? তা আমাদের ভেবে দেখা দরকার। তবু কিছু ব্যক্তি সংস্থা এগিয়ে আসছে তাদের পুনর্বাসনের জন্য। সেটাও অপ্রতুল। যেমন: গাজীপুরের হোতা পাড়ার বয়স্ক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে পরিষ্কারভাবে প্রবীণদের বিষয়ে বলা আছে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। নইলে অসহায় শ্রেণির লোক যাবে কোথায়? স্মরণ না করলেই নয়। তারা পরিবারে আদর-সোহাগ থেকে বঞ্চিত তবুও তাদের একটু ঠাঁই হচ্ছে এসব কর্মকান্ডে। এতে আমি আনন্দিত। বৃদ্ধাশ্রম কখনো বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। অদূর ভবিষ্যতেও পাবে কিনা জানি না। কিছু মানুষ আধুনিকতার নাকপাশে পশ্চিমা সমাজের সামাজিক মূল্যবোধের উদ্বুদ্ধ হয়ে গড়ে তুলেছেন বৃদ্ধাশ্রম। সরকারি হিসাব মতে- দেশে প্রায় সরকারি ৬টিসহ প্রায় ১৫টির বেশি বৃদ্ধাশ্রম আছে। এখানে অবস্থানকারীদের ৭০ শতাংশই নারী। নারী জাগরণের এই লগনে প্রবীণ নারীদের এই দৃশ্য কোনোভাবেই কাম্য নয়। এত কিছুর পরও মন্দের ভালো হিসেবে পারিবারিক অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে এবং রেহাই দিতে বৃদ্ধাশ্রম বেছে নিয়েছে। এখানে একটা জিনিস লক্ষণীয়, অনেক প্রবীণ একসঙ্গে থাকার দরুন মনের কষ্টগুলো একে অন্যের মধ্যে ভাগাভাগি করতে পারে, যেটি অতি আপনজনের সঙ্গে পারেনি। বাঙালির হাজার বছরের কৃষ্টি-প্রথা একান্নবর্তী পরিবার যেখানে সুখ-সমৃদ্ধি, মানবিক-নৈতিকতা পরিবেশ খেলা করে। সেটি ফিরিয়ে আনতে পারিবারিক বন্ধন, মূল্যবোধ নৈতিকতা চর্চা খুব জরুরি। এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষার শিক্ষিত হওয়ায় পারিবারিক চর্চার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আন্তঃপ্রজন্ম সম্পর্ক তৈরির জন্য শিক্ষাব্যবস্থায়নীতি শাস্ত্র পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তকরণ, এ সংক্রান্ত কাজের পুরস্কার ঘোষণা, গবেষণার, উৎসাহ প্রদান। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কোনোভাবে এ ব্যাপারে প্রণোদনা বিভিন্ন প্রেস, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া, সভা-সেমিনারের মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। প্রতিটি জেলায় বিশেষায়িত হাসপাতাল গড়ে তুলতে হবে। এমনকি প্রবীণদের মনস্তাত্ত্বিক বিষয় বুঝতে পারে তার মতো প্রশিক্ষিত নার্স তৈরি করতে হবে। প্রবীণদের মনস্তত্ত্ব বুঝে তাদের উপযোগী বিনোদনকেন্দ্র স্থাপন, প্রবীণদের কর্মকান্ডের স্বীকৃতি, কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ, নিমন্ত্রণ জানানোর মধ্যদিয়ে তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। সুচিন্তিত মতামত দাতা, অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে গুরুত্ব দিতে হবে।

প্রবীণদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, পুনর্বাসন, বিভিন্ন যানবাহন যেমন- বাস, লঞ্চ, ট্রেন, বিমানের-সহজশর্তে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকিটের ব্যবস্থা করতে হবে। এদের জন্য হেল্পলাইন খুলতে হবে। প্রবীণবান্ধব খাবার হোটেল রেস্টুরেন্ট সরকারি-বেসরকারিভাবে গড়ে তুলতে হবে। দেশ ও জাতীর স্বার্থে ভবিষ্যৎ টেকসই উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় মানবিক বিকাশের পথ-পরিক্রমায় ধারাবাহিকতা রক্ষার নিমিত্তে প্রবীণদের অর্জিত জ্ঞান-অভিজ্ঞতা-দক্ষতা-যোগ্যতা-নৈপুণ্যতা, ত্যাগ-অবদানের স্বীকৃতস্বরূপ সামাজিক অধিকার ন্যায়বোধ, মর্যাদা প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে মানবতার জয়ের ধ্বনি প্রকাশ হোক এভাবে। 'শত বিপদে মোরা নই দিশাহীন পাশে আছে অভিজ্ঞ প্রবীণ'।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<79880 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1