বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ষাটের অগ্নিঝরা দিন ও কারাগারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে

রণেশ মৈত্র
  ১৮ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

ষাটের দশক। কঠিন সামরিক শাসনের জাঁতাকলে পূর্ববাংলা নিষ্পিষ্ট। স্বৈরাচারী সামরিক শাসক, তৎকালে 'লৌহমানব' বলে পরিচিত পাকিস্তানি জেনারেল ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের অত্যাচারে জর্জরিত সমগ্র পাকিস্তান- বিশেষ করে পূর্ববাংলা। আর তার প্রতিবাদে, সামরিক শাসনের আশু অবসানের দাবিতে ছাত্র ও যুবসমাজ, গণতন্ত্রকামী সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা দেশের রাজপথগুলোকে দৃপ্ত পদভারে প্রকম্পিত করে চলেছেন। সামরিক শাসনের কঠোরতা থোড়াই পরোয়া করে ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে তুলে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করে তুলছেন। সরকার তার প্রতিশোধ নিচ্ছে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে বিনাবিচারে আটক করে কারারুদ্ধ করার মাধ্যমে। ওই কর্মসূচি যেমন পাকিস্তান সরকার তেমনিই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালী গ্রম্নপ) ব্যতীত অপর সব দলকেও আতঙ্কিত করে তোলে। তারা সরাসরি শেখ মুজিবকে পুনর্বার 'পাকিস্তান ও ইসলামের দুশমন' আখ্যায়িত করে। শেখ মুজিব চলে আসেন পূর্ববাংলায়, ঢাকা নগরীতে।

দিন কয়েকের মধ্যে তিনি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ প্রথম সারির কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা গ্রেপ্তার হলেন। শেখ মুজিব (তখনও তিনি 'বঙ্গবন্ধু' খেতাবে ভূষিত হননি) ব্যতীত অপর নেতৃবৃন্দকে প্রদেশের অপরাপর কেন্দ্রীয় কারাগারে বদলি করে দেওয়া হয়। মুজিব ভাই থেকে যান একা এক বিশাল ওয়ার্ডে। আমি ওই দফায় গ্রেপ্তার হই ঠিক যেদিন পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয় তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই, দুপুরবেলায়। খেতে বসেছিলাম দেড় বছর কারারুদ্ধ থাকার পর। আগের দিন মুক্তি পেয়ে বাসায় আসি। পরদিনই আবার সরকারি আতিথ্য নিতে হলো, স্ত্রী-সন্তানদের রেখে।

এবার গ্রেপ্তার জন্মদোষে। অর্থাৎ হিন্দুঘরে জন্ম নিয়েছিলাম তাই। পাকিস্তান সরকার যুদ্ধ লাগার সঙ্গে সঙ্গে জরুরি অবস্থা দিয়ে 'শত্রম্ন সম্পত্তি আইন' জারি করে। পাশাপাশি নেতৃস্থানীয় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানদের গ্রেপ্তার শুরু করে। অবশ্য ৮/৯ মাস পর অপর হিন্দুনেতাদের মুক্তি দেওয়া হলো। আর আমরা যারা ন্যাপ-সিপিবি করতাম তাদের রেখে দেওয়া হলো। খুশি হয়েছিলাম, বাঁচা গেল, কারণ রাজনৈতিক পরিচয়টা পুনরুদ্ধার হলো। কিন্তু মুক্তি কবে পাওয়া যাবে তা অনুমান করা যাচ্ছিল না। এমন সময় আমার স্ত্রী পূরবী মৈত্র এলেন আমাদের ইন্টারভিউ নিতে। উৎসাহিত করলেন আমাকে 'ল' পরীক্ষা দিতে। রাজি হলাম, বলস্নাম নতুন পাস করা আইনজীবীদের কাছ থেকে সিলেবাস জেনে নিয়ে কিছু বইপত্র পাঠাতে। তিনি পাবনায় ফিরে সাধ্যমতো বই সংগ্রহ করে পাঠালেন। আমাকে অনেক আগেই আরও কয়েকজন বন্দিসহ পাবনা জেলা কারাগার থেকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বদলি করে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে গিয়েই পূরবী ইন্টারভিউ নেন।

যাহোক, পরীক্ষা দিতে হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হবে, তিনি নিয়মিত কোন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তা জানিয়ে ওই মন্ত্রণালয়ে দরখাস্ত করতে হয়। ওই অনুমতি পাওয়ার পর উচ্চতম কারাকর্তৃপক্ষের (ইনসপেক্টর জেনারেল অব প্রিজনস) কাছে দরখাস্ত করে পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপন ও পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে আবেদন জানাতে হয়। এসব ফর্মালিটি শেষ হতে হতে কয়েক মাস লেগে গেল। সেই ফাঁকে পড়াশুনাও চলল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তা জানানো হলো কর্তৃপক্ষকে। পরে আমাকে জানানো হলো, সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের কারাগারগুলোর মধ্যে কেবলমাত্র ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পরীক্ষার কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। সুতরাং সেখানে আমাকে বদলি করা হলো। তখনতো যমুনা সেতু নির্মিত হয়নি। তাই ট্রেনে সিরাজগঞ্জ-জগন্নাথগঞ্জ ফেরিতে যমুনা পার হতে হতো। সরাসরি ট্রেনে রাজশাহী থেকে ঢাকার ইন্টার-ক্লাস টিকেটের যাত্রী। সঙ্গী তিন বন্দুকধারী পুলিশ যার মধ্যে একজন সম্ভবত

১৯৬২ সালে বা তার কিছু পরে যখন এনডিএফ গঠিত হয় তখন মুজিব ভাই শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পাবনা আসেন জনসভা করতে। সেই জনসভার শুরুতে উপস্থিত বিশাল জনতাকে সামাল দিতে মাইক আমার হাতে দেওয়া হয়। আমরা মুহুর্মুহু স্স্নোগান তুলি 'মওলানা ভাসানীর মুক্তি' 'এক ইউনিট', সিয়াটো-সিন্টে চুক্তি বাতিল' প্রভৃতি দাবিতে। নেতৃবৃন্দ ছিলেন সার্কিট হাউসে, আর জনসভা ওই ভবনের সামনে পাবনা স্টেডিয়ামে। নেতারা মঞ্চে এলে তাদের স্বাগত জানাই; আমরা দিচ্ছি জিন্দাবাদ প্রভৃতি স্স্নোগান; কণ্ঠে আরও ছিল মওলানা ভাসানীর মুক্তি, সম্রাজ্যবাদ ও এক ইউনিট বিরোধিতা। স্স্নোগানগুলো শুনে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মনে মনে ক্ষুব্ধ হচ্ছিলেন। সে ক্ষোভের প্রকাশ ঘটালেন সভা শেষ হলে সার্কিট হাউসে ফিরে গিয়ে। সেখানে তিনি মুজিব ভাইকে ডেকে বললেন, ওই স্স্নোগানগুলো কেন এত দেওয়া হলো? মুজিব ভাই বাইরে এসে বারান্দায় আমার কাছে কৌশল করে বিষয়টি জানতে চাচ্ছিলেন। বললাম, স্স্নোগানগুলোর প্রতিটি পাবনা এনডিএফ কমিটিতে সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত। আপনি প্রয়োজনে ক্যাপ্টেন মনসুর সাহেবকে জিজ্ঞেস করুন। তিনি তাই করলেন। মনসুর সাহেব স্বীকার করলেন। তা শহীদ সাহেবকে জানালে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করতে বললেন, 'ডযধঃ রং :যবরৎ সবসনবৎং?' আমি তখন উনার রুমের কাছাকাছি। তাই নিজেই জবাব দিলাম, 'হড়ঃ ষবংং :যধহ অধিসর খবধমঁব' ...তিনি এ জবাব শুনে ফুঁসতে থাকলেন।

যাহোক, অতঃপর পাবনা থেকে পরদিন তাদের সঙ্গেই আমি উত্তরবঙ্গ যাব 'সংবাদ'-এর পক্ষ থেকে তাদের টু্যর কভার করার জন্য। সারাপথ ট্রেনে। নানা জায়গায় এডিএফ নেতৃবৃন্দের এ সফর উত্তরবঙ্গের মানুষ ও বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীদের মনে সামরিক শাসনবিরোধী জোয়ারে সঞ্চার করেছিল। আর সংবাদে আমার রিপোর্টটি দেখে মুজিব ভাই তো বেজায় খুশি। তিনি যাত্রাপথে সাংবাদিকদের খোঁজখবর নিতে তাদের কামরায় ছুটে আসতেন, কোনো সমস্যা আছে কিনা জানতে চাইতেন। হাতে করে আনতেন সংবাদ ও ইত্তেফাক। ইত্তেফাকের বিশেষ সংবাদদাতার সামনেই বলতেন, 'সংবাদের রিপোর্টটিই হচ্ছে বেস্ট'।

যাহোক, এবার জেলখানার প্রসঙ্গে চলে আসি। প্রায় আধা ঘণ্টা হাঁটতে হাঁটতে শেষে আমার লকআউটের সময় এসে যাওয়ায় দুজন মিলে হাঁটা বন্ধ করতে হলো। মুজিব ভাই চলে গেলেন তার দেওয়ানি ওয়ার্ডে (বলা হতো দেওয়ানি ফটক)। গিয়ে তিনি দুখানি খবরের কাগজ পাঠিয়ে দিলেন। ওই পড়তে পড়তে আহারাদি শেষ করে সেদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে উঠে হাতমুখ ধুয়ে এক পেয়ালা চা মুখে দিতেই দরজার ওপাশে মুজিব ভাই এসে হাজির। বেরিয়ে পড়লাম হাঁটতে। মুজিব ভাই দেশের কোনো খবর জানা আছে কিনা, ঢাকায় আমার পক্ষে লোকজন কী বলল জানতে চাইলেন। আমি জানালাম, ক্রমশই মানুষ আইয়ুব সরকারের বিরোধী হয়ে উঠছে এবং ছয় দফার সমর্থনে এসে শামিল হচ্ছে। শিগগিরই একটা বড় রকমের বিস্ফোরণ ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে হলো, যদি আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ যৌথভাবে আহ্বান জানায়। তিনি বললেন, যৌথভাবে আহ্বান করা সম্ভব হবে কিনা জানি না, তবে আওয়ামী লীগ তাতে আহ্বান জানায়, সে চিন্তায় আছি। যে ভয়ঙ্কর অত্যাচারী শাসক সে, তাই সংগঠিত হতে সময় লাগতে পারে। তবে উভয়ের মধ্যে কথা থাকল দলীয় উৎস থেকে কোনো গোপন খবর এলে তা আমরা পরস্পর রক্ষা করব। বিরোধ দেখা দেয় মুজিব-ভাইয়ের ৬ দফা কর্মসূচির প্রশ্নের। চীনাপন্থিরা আইয়ুবের সুরে ওই কর্মসূচিকে মার্কিনি ষড়যন্ত্র এবং পাকিস্তানের সংহতিবিরোধী বলে প্রচার করে। আর রুশকপন্থিরা একে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের অনুসারী বলে তার প্রতি সমর্থন জানায়। কিন্তু ১৯৬৬ সালে আনুষ্ঠানিক বিভক্তি না হওয়ায় রুশপন্থি ন্যাপ নেতারা ব্যক্তিগতভাবে সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে ৬ দফা কর্মসূচিতে সমর্থন জানান। এ কথা মুজিব ভাইকে খোলামেলা বলে আমি নিজেও সেই মতের অর্থাৎ রুশপন্থি মতবাদের অনুসারী বলে উলেস্নখ করল তিনি বিস্মিত ও আনন্দিত হন। যাই হোক, এভাবে দিন চলতে থাকল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। ঘোষণা করা হলো ৭ জুন আওয়ামী লীগ বন্দিমুক্তি ও অপরাপর দাবিতে হরতাল আহ্বান করেছে। খবরটি সংবাদপত্র মারফত আমরা জানতে পেলাম। দিবসটি ৬ দফা দিবস হিসেবেও কোনো কোনো সংবাদপত্রে উলিস্নখিত হয়।

ইতোমধ্যে মে মাস থেকেই আমার 'ল' পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ৭ জুন তারিখের একটি পরীক্ষা হবে বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পূর্বাহ্নেই জানিয়ে রেখেছেন। দিনটি যতই নিকটে আসতে লাগল আওয়ামী লীগের ওপর সরকারি নির্যাতন-নিপীড়নও বাড়তে থাকল। ওইদিন হরতাল, মিছিল ও জনসভার কর্মসূচি ছিল। সপ্তাহখানেক আগে থেকেই সন্ধ্যায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দেওয়ালের বাইরে থেকে সহস্র কণ্ঠে যখন স্স্নোগান ধ্বনিত হতো 'জয় বাংলা' 'জাগো বাঙালি জাগো'- কারাপ্রকোষ্ঠে লকআপে বসেও আমরা উজ্জীবিত হতাম। এভাবে ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাসমূহের নিয়ন্ত্রক বরাবর দরখাস্ত করলাম যেহেতু জনগণ ৭ জুন হরতাল বা কর্মবিরতি ডেকেছে, তাই তার সমর্থনে আমি ওইদিনকার পরীক্ষা দিতে বিরত থাকব। জমাদ্দারের হাতে দরখাস্ত দিয়ে অফিসে পাঠালাম। কিন্তু জমাদার অফিসে যাওয়ার পথে মুজিব ভাইয়ের ওয়ার্ডে গিয়ে সালাম জানাতেই তিনি দরখাস্তটি পড়ে জমাদার সাহেবকে বলে পাঠালেন আমি যেন দরখাস্তটি প্রত্যাহার করে নিই, কারণ পরীক্ষার সঙ্গে সারাজীবনের ক্যারিয়ারের প্রশ্ন জড়িত। আন্দোলনের জন্য তো সারাটি জীবনই রয়েছে। আমি বিনয়ের সঙ্গে তার কথা মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বললাম, জনগণ আন্দোলনে থাকবে আর আমি নিজের ক্যারিয়ারের জন্য আরামে বসে পরীক্ষা দেব- তা হবে না। দরকার হলে পরের বছর পরীক্ষা দেব- এই বলে জমাদার সাহেবকে দ্রম্নত দরখাস্তটি অফিসে নিয়ে জমা দিতে বললাম। ছুটে এলেন জেলার ডেপুটি জেলার। তাদেরও একই অনুরোধ। আমি তা মানতে অপারগতা জানিয়ে দ্রম্নত দরখাস্তটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে বললাম। তারা অফিসে ফেরত গিয়েই দরখাস্তটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছানোর জন্য পাঠিয়ে দিলেন।

বিকেলে হাঁটার সময় মুজিব ভাই প্রসঙ্গটি তুলে বললেন, কাজটি কিন্তু ভালো হলো না। আমার ভিন্নমত পুনরায় তাকে জানালাম। উনি বললেন, ছাত্রলীগের কোনো নেতা তো পরীক্ষা দেওয়া থেকে বিরত থাকবে না। সেখানে অন্তত নিজ দলের অনুমতি নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। বললাম, তারাও তো সম্ভবত আপনার অনুরূপ পরামর্শই দিতেন। পরে বঙ্গবন্ধু বললেন, 'আসলে আমার তো ৬ দফা না, এক দফা। স্বাধীন বাংলা।

উত্তরে বললাম, 'পারবেন না। কারণ আপনার ক্যাবল তো আমেরিকামুখী। তারা কোনো দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম কদাপি সমর্থন করেনি, করবেও না। হেসে তিনি বললেন, 'হঁ্যা, আমেরিকাই বটে- তবে ভায়া ইন্ডিয়া।' বললাম, 'ইন্ডিয়ার কিছু লবি আছে, তাই তাদে মাধ্যমে রুশ শরণাপন্ন হোন।' উত্তরে তিনি বললেন, 'দেখা যাক।' অতঃপর ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধ হলো। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগার থেকে তা প্রত্যক্ষ করলেন। ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি বিজয়ীর বেশে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর সম্ভবত ফেব্রম্নয়ারি মাসের কোনো এক দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি পাবনা সফরে এলেন। পাবনাবাসীর পক্ষ থেকে তাকে হেলিকপ্টারে থেকে নামার পর প্রায় হাজারখানেক অভ্যর্থনাকারীর অন্যতম হিসেবে পাবনা স্টেডিয়ামে আমিও লাইনে দাঁড়িয়ে, তবে একটু পেছনের দিকে তৃতীয় সারিতে।

বঙ্গবন্ধু রুশপ্রদত্ত হেলিকপ্টার থেকে নেমে পুলিশের আনুষ্ঠানিকতা শেষে অভ্যর্থনাকারীদের প্রথম সারি থেকে করমর্দন করতে লাগলেন। হঠাৎ আমার ওপর চোখ পড়তেই লাইন ও কর্ডন ভেঙে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন। দীর্ঘ আলিঙ্গন শেষে বললেন', কী, বলেছিলাম না, দেশ স্বাধীন করে ছাড়ব? উত্তরে আমিও বললাম, 'আপনার মার্কিনি কেবলার সহযোগিতায় বিজয় অর্জিত হয়নি, হয়েছে আমার বলা সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতায়'। হেসে বললেন, 'কথাটি পাঁচ বছর আগে ঢাকা জেলে হয়েছিল। আজও মনে আছে দেখছি।' বললাম, 'ভুলেই গিয়েছিলাম, আপনিই এতদিন পরে তা মনে করিয়ে দিলেন।'

এবার আবার ফিরে যাই সেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। একদিনের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে। তবে দিন-তারিখ মনে নেই। বিকেল ৪টার দিকে একটা স্স্নিপ হাতে হেড ওয়ার্ডার এলেন, আমার হাতে দিলেন দেওয়ার জন্য। দেখি তাতে লেখা আছে- 'ফর ইন্টারভিউ মি, রণেশ মৈত্র, সিকিউরিটি প্রিজনার।' জিজ্ঞেস করলাম, 'কার সঙ্গে ইন্টারভিউ?' হেড ওয়ার্ডার বলেন, তা কিছু বলেনি।' কাপড়চোপড় পরে ডিটেনশন অর্ডারটা হাতে নিয়ে চললাম রাজবন্দিদের ইন্টারভিউ রুমে। ঢুকতেই দেখি, মুজিব ভাই বসা। সামনে বসে আছেন এক মহিলা তার কিশোরীকন্যাকে নিয়ে। তবে দুজনের কাউকে চিনি না। আর এক কোনায় বসে আছেন আমার বাল্যবন্ধু ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম। তিনিই এসেছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। তার দিকে পা বাড়াতেই মুজিব ভাই একটু দাঁড়াতে বলে ভাবির দিকে ইশারা করে বললেন, 'আপনার ভাবি।' আমি তাকে সশ্রদ্ধ সালাম জানালাম। আর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, 'আমাদের মেয়ে হাসিনা।' বলেই মেয়েকে বললেন, 'ইনি তোমার চাচা, রণেশ মৈত্র। পাবনার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা। বয়সে জুনিয়র হলেও আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহকর্মী। সালাম করো।' হাসিনা এগিয়ে আসতে নিলে বললাম, 'তুমি অনেক বড় নেতার মেয়ে, নিজেও ভবিষ্যতে বড় হবে আশা করি। সেইভাবে নিজেকে গড়ে তোল।'

অতঃপর ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সামনে গিয়ে বসলাম। তিনি আমার আটকাদেশ বেআইনি দাবি করে হাইকোর্টে রিট করতে চান। সম্মতি চাইলে তা দিলাম। মুজিব ভাই আমীর-উল-ইসলামকে বললেন, 'শোন আমীরুল, টাকা যা লাগে আমি দেব, তুমি রিটটা ভালো করে করবে। দরকার মনে করলে বড় কোনো সিনিয়র আইনজীবীকেও সঙ্গে নিও। উনার দ্রম্নত মুক্তি পাওয়া খুবই প্রয়োজন।'

\হহেসে আমীর-উল বললেন, 'টাকা লাগবে না, রণেশ আমার বাল্যবন্ধু, একসঙ্গে অতীতে জেল খেটেছি। ওর কেস অবশ্যই ভালোভাবে করব।' বলেই একটি ওকালতনামাতে সই নিলেন। ডেপুটি জেলার আইনমোতাবেক প্রতিস্বাক্ষর করে আমীর-উলকে দিলেন। আসলেও তিনি একটি পয়সাও না নিয়ে খেটেখুঁটে রিটটি করে কয়েক মাসের মধ্যেই উচ্চ আদালতের নির্দেশে আমাকে মুক্ত করেন। ওইদিন ইন্টারভিউ, এরপর রাতে দেখি বিশাল এক ভূরিভোজের ব্যবস্থা। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার উপলক্ষে ভাবি নিজ হাতে রান্না করে এনেছিলেন বিস্তর আইটেম। ছিল সবই অত্যন্ত সুস্বাদু। মনে আছে ইলিশ মাছের পাতুরির কথা যেন আজও জিভে লেগে আছে। ভাবি যে এত ভালো রান্না করতে জানতেন তা আদৌ জানতাম না। আমি লিচু থেকে শুরু করে মৌসুমি নানা ফল দেখেছিলাম- যা আমার ভাগ্যেও প্রচুর পরিমাণে জুটে গেল।

রণেশ মৈত্র: সাংবাদিক, কলাম লেখক ও রাজনীতিক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<84758 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1