শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সামাজিক অবক্ষয়ের নেপথ্যে পর্নোগ্রাফি

মো. আশিকুর রহমান শিক্ষার্থী, ব্যবস্থাপনা বিভাগ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া
  ১৯ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

আধুনিকতার সঙ্গে পালস্না দিয়ে বর্তমান পৃথিবী সব দিক থেকে অগ্রসর হচ্ছে। তথ্য ও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় পুরো পৃথিবীটাই আজ হাতের নাগালে চলে এসেছে। শহুরে জীবন থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত এটির প্রভাব লক্ষণীয়। ইন্টারনেটের কল্যাণে পুরো পৃথিবীটা গেস্নাবাল ভিলেজ (বৈশ্বিক গ্রামে) পরিণত হয়েছে। কিন্ত এই ইন্টারনেটের অপব্যবহার করে সমাজ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে। মূল্যবোধ, নৈতিকতা কিংবা ধর্মীয় অনুভূতি সব যেন শূন্যের কোঠায় চলে এসেছে। নৈতিক অবক্ষয়ের ফলে অনেকে মানুষরূপী পশুতে পরিণত হচ্ছে। তরুণ-তরুণীরা আজ সুস্থ মতিষ্ককে অসুস্থ করে বিবেক প্রতিবন্ধীতে রূপান্তরিত হচ্ছে। যেখানে তাদের পুরো পৃথিবীর নানা রহস্য নিয়ে চিন্তা করার কথা, অজানা জিনিসকে জানার নেশায় মাতোয়ারা হওয়ার কথা, সেখানে অধিকাংশই পড়ে থাকে সুন্দর পৃথিবীকে কলুষিত করার জন্য। স্রষ্ঠা তো মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন যেন তারা সুস্থ মস্তিষ্ক দিয়ে আত্মোন্নয়ন করে দেশ ও জাতির কল্যাণে লিপ্ত থাকে। সঠিক এবং মন্দ পথের বিবেচনা করে আলোকিত মানুষ হয়। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে ঠিক তার উল্টোটা। আজ পশ্চিমা সংস্কৃতির সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে তাদের তৈরি ফাঁদেই আটকা পড়ছি আমরা। উঠতি বয়সি তরুণ-তরুণীর মেধাবিকাশের প্রধান প্রতিবন্ধক পর্নোগ্রাফি হচ্ছে তারই একটি পরিকল্পিত কুকৌশল। এটি এমন এক মহামারি, যেটির মাধ্যমে শুধু তরুণ-তরুণীরা নয়- সর্বস্তরের মানুষ অন্ধকার জগতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। যার জন্য ভেঙে যাচ্ছে অনেক সুচেতা সংসার, দেখা দিচ্ছে বিচ্ছেদ। পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে বিষাক্ত মাকড়সার মতো জাল বিছিয়ে রাখা হচ্ছে। মাকড়সা যেভাবে পোকাকে তিলে তিলে মেরে ফেলে, পর্নোগ্রাফিও ঠিক সেভাবেই একটু একটু করে ধ্বংস করে ফেলে আমাদের স্বাস্থ্য, পরিবার, নৈতিকতা, চাকরি, এমনকি গোটা সমাজব্যবস্থাকে। অথচ আজকের তরুণরা সুযোগ পেলেই পর্নোগ্রাফি দেখায় মেতে ওঠে। একের পর এক ক্লিকে ধ্বংস করছে সুন্দর জীবনটাকে, পরিশুদ্ধ আত্মাটাকে। ইন্টারনেটের কার্যপদ্ধতিও সেভাবে সেট করে রাখা হয়েছে। প্রত্যেকটি মানুষেরই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ রয়েছে, যেটির সুযোগ নেয় ইন্টারনেট। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা ইন্টারনেটে প্রয়োজনীয় তথ্য বা অবসর কাটানোর জন্য প্রবেশ করি আমরা। প্রথমে সার্চ সম্পর্কিত তথ্য বা উপাত্ত দিতে দিতে কিছুটা অশ্লীল লেখা, ছবি কিংবা ভিডিও প্রদর্শন করে। অবচেতন মনে কিংবা কৌতূহলের বশে মানুষ ওইটার ওপর ক্লিক করে। তারপর একের পর এক তুলনামূলক নৈতিকতা বহির্ভূত ভিডিও, লেখা আসতেই থাকে। একপর্যায়ে সে পর্নোগ্রাফির মতো নিষিদ্ধ বস্তুও পেয়ে যায়। অনেকে আবার অন্য ব্যক্তি যেমন- বন্ধু, ভাই বা বোনদের মাধ্যমে জানতে পেরে প্রবল আগ্রহ নিয়ে প্রবেশ করে এই অন্ধকার জগতে। ক্রমাগত সে খারাপের দিকে ধাবিত হয়। এক সময় সে গণধর্ষণ, শিশুধর্ষণ, ওরাল সেক্স, ওরাল সেক্স দেখতেও কুণ্ঠিতবোধ করে না। প্রথমে অনুশোচনায় ভুগলেও ধীরে ধীরে এটির সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যায়। সুযোগ পেলেই নির্জন জায়গা কিংবা সমাজ থেকে বিছিন্ন হয়ে অন্য এক অন্ধকার জগতের নেশায় জড়িয়ে পড়ে। অক্টোপাসের মতো শক্তিশালী শুঁড় দিয়ে জড়িয়ে ধরে এটি। বাস্তবটা অনেক অনাকর্ষণীয় ও মোহহীন মনে হতে শুরু হয়। রাস্তায় পথে-ঘাটে সবখানেই বিপরীত লিঙ্গের মানুষ দেখলে অবচেতন মনেই মেলাতে থাকে তার স্বপ্নের কোনো পর্নোস্টারের সঙ্গে। তখন মানুষকে শুধু পণ্য বা ভোগের বস্তু ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না। এভাবে নৈতিকহীন মানুষে পরিণত হয় সমাজের সবচেয়ে নিরীহ কোনো মানুষও যাকে সবাই আদর্শবান ব্যক্তি বলে জানত। অ্যান্ড্রয়েড ফোনের কল্যাণে পর্নো ভিডিও আজ পানির মতো সহজলভ্য। প্রতি সেকেন্ডে গড়ে ২৮,২৫৮ জন মানুষ পর্নো দেখছে। জাপানের তরুণ-তরুণীরা অত্যাধিক পর্নো-আসক্তির কারণে যৌনতার প্রতি আগ্রহ একবারেই হারিয়ে ফেলেছে। আমেরিকার তরুণরা বিয়েতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এর পিছনে অনেক কারণের মধ্যে পর্নো-আসক্তি অন্যতম বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্নো-ভিডিওগুলোর শতকরা ৮৮ শতাংশ দৃশ্যে শারীরিক আগ্রাসনের প্রদর্শনী রয়েছে এবং শতকরা ৪৯ শতাংশ দৃশ্যে রয়েছে মৌখিক আগ্রাসন। কিন্তু পর্নো অভিনেত্রীরা হাসিমুখে পরম আনন্দের সহিত নির্যাতন সহ্য করে নিচ্ছেন। অবচেতন মনে দর্শকের মেসেজগুলো স্বাভাবিকভাবেই নিচ্ছেন এবং বাস্তবে ওই পদ্ধতির প্রতিরূপ ঘটাতে গিয়ে সঙ্গিনীর ওপর অজান্তেই মৌখিক ও শারীরিক নির্যাতন করে চলেছেন। সঙ্গিনী বাধা দিলে ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজও করে বসে অনেকে। কি সাংঘাতিক বিকৃত আচারণ! পর্নো অভিনেত্রীদের মতো বাস্তবের নারীরা বেপরোয়া না হওয়ায় দাম্পত্য জীবনে শুরু হয় অশান্তি। কিন্তু কেউ কি ভাবে না বিশ-ত্রিশ মিনিটের একটি ভিডিও ধারণ করতে সপ্তাহ পর্যন্ত শুটিং হতে পারে। তাছাড়া যৌন শক্তিবর্ধক নানা ধরনের ড্রাগস তো আছেই। কিন্তু বাস্তব সম্পূর্ণ আলাদা। ফলে অনেকে হতাশা, অতৃপ্তি ও অশান্তি নিয়ে সুন্দর এই পৃথিবীটাকে করে তোলেন কয়েদখানা কিংবা জাহান্নামের টুকরো। অসবৎরপধহ ঝড়পরড়ষড়মরপধষ অংংড়পরধঃরড়হ এ উপস্থাপিত একটি গবেষণা অনুযায়ী বিবাহিতদের মধ্যে যারা পর্নো-আসক্ত, তাদের বিচ্ছেদের সম্ভাবনা স্বাভাবিকের তুলনায় দ্বিগুণ। শতকরা ৫৬টি বিবাহ-বিচ্ছেদের প্রধান কারণ সঙ্গী/ সঙ্গিনীর পর্নো-আসক্ত। মাদকাসক্ত ব্যক্তি যেমন স্বাভাবিক জীবনে আনন্দ পায় না, তেমনি পর্নো-আসক্ত ব্যক্তিও স্বাভাবিক যৌনতায় সন্তুষ্টি খুঁজে পায় না। এভাবে সমাজের অবক্ষয় বেড়েই চলছে! তাছাড়া পরকীয়ার জগতে ভাসিয়ে দিতে জল হিসেবে কাজ করছে ইন্ডিয়ান সিরিয়ালগুলো। প্রতিটি বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছে অপসংস্কৃতি। সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সবাই মিলে বসে যায় এই সময়ক্ষেপণ ও জাতিবিধ্বংসী বেহায়াপনায়। ফলে বাচ্চাদের মনের ও পড়াশোনার ওপর নীতিবাচক প্রভাব পড়ার পাশাপাশি অপসংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে আমাদের স্বকীয়তা হারাতে বসেছি। এ ছাড়া সেক্স অ্যাডুকেশন নিয়ে পুরো বিশ্বে চলছে এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র। যৌনশিক্ষার নামে বাচ্চাদের বিকৃত এবং নিষিদ্ধ যৌনতার দিকে আকৃষ্ট করা হচ্ছে। এমনকি কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চাদেরও রেহাই দেয়া হচ্ছে না। এজন্য অভিভাবকদের সর্বোচ্চ সচেতন হওয়ার পাশাপাশি সন্তানদের যথাসম্ভব সময় দিতে হবে। সন্তানকে যদি মানুষের মতো মানুষই না করা যায়, তাহলে এত টাকা-পয়সা, ক্যারিয়ার দিয়ে কী হবে? বাংলাদেশে গর্ভপাতের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। চোখ ধাঁধানো নিষিদ্ধ সুখ আর সাময়িক উত্তেজনায় আকৃষ্ট হওয়ার মাশুল দিতে হচ্ছে অসংখ্য নবজাতকের। তাদের অনেকের জায়গা হয় রাস্তার ডাস্টবিন কিংবা টয়লেটের কমোডে। কিন্তু এই মানবধ্বংসী সিদ্ধান্তের শেষ আশ্রয়স্থল লিটনের ফ্ল্যাট নয়, পথচলা শেষ হয় জাহান্নামে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশ এগিয়ে গেলেও বাড়ছে ধর্ষিতা নারীর লাশের মিছিল। সমাজে পতিতার চাহিদা ও মানবপাচার ক্রমাগত বেড়েই চলছে। মানবপাচারে শিকার হওয়া নিরাপরাধীদের জোর করে বিভিন্ন নিষিদ্ধ কাজ করতে বাধ্য করা হয়। অথচ এর জন্য আমাদের অনেকেই পরোক্ষভাবে দায়ী। কারণ পর্নো ডাউনলোড করে চাহিদা সৃষ্টি করা হচ্ছে বলেই এসব আসহায় নারীদের, শিশুদের মানব পাচরকারীদের কবলে পড়তে হয়। নরহত্যা-সংক্রান্ত এফবিআইয়ের নিজেদের রিপোর্টে বলছে, সিরিয়াল কিলারদের সাধারণ আগ্রহের বিষয় হচ্ছে পর্নোগ্রাফি। যারা পর্নোগ্রাফি দেখে তাদের সবাই ধর্ষণ বা যৌন-সহিংসতায় লিপ্ত না হলেও যারা এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের অধিকাংশই পর্নোগ্রাফি দেখে। যেমন- কেউ সিগারেট থেকে শুরু, শেষকালে হেরোইন, ফেনসিডিল। তেমনি পর্নোগ্রাফি থেকে শুরু, শেষ হয় হস্তমৈথুন, ধর্ষণ, খুন ও মানব পাচারে। এভাবে আমরা নিজেকে নিজেই তিলে তিলে ধ্বংস করার নেশায় মেতে উঠি। এ জন্য রাষ্ট্রকে পর্নোগ্রাফি সম্পর্কিত সব ধরনের ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে নতুবা প্রজন্ম কালের গহ্বরে হারিয়ে যাবে। এমন অনেকে আছে যারা রমজান মাসেও পর্নো দেখে। একজন মানুষ যতবেশি পর্নো দেখে, তার মতিষ্কের তত ক্ষতি হতে থাকে। বারবার পর্নোগ্রাফি দেখার ফলে চিন্তার কাঠামোতে নীতিবাচক পরিবর্তন আসে, দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়াসহ নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি হয়। কিন্তু এরপরও অনেকে এটির থেকে পরিত্রাণ পান না কারণ এটির মাধ্যমে মস্তিষ্কে ডোপামিন ও অক্সিটোসিন নামের দুটি কেমিক্যাল রিলিজ করে যা আনন্দ অনুভব করায়। তাই মানুষ ডোপামিনের লোভে বারবার সেটাতে ফিরে যেতে চায়। এ ছাড়া শয়তানের একটি কার্যকর কৌশল হচ্ছে, 'আজকেই শেষ'। অথচ আগামীকালও মনে হতে পারে আজকেই শেষবার। সুতরাং আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দরকার মনের জোর এবং দৃঢ় প্রত্যয়। এজন্য ব্যস্ত থাকার পাশাপাশি চোখের হেফাজতের ব্যাপারে যত্নবান হতে হবে। নিজেই নিজেকে শেষ করার কি মানে হয়? আলস্নাহ বলেছেন, 'যিনার কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় তা অশ্লীলতা ও বিপথগামী' (সূরা বনি ইসরাইল; ৩২)। অর্থাৎ তিনি এমন সবকিছু থেকে দূরে থাকতে বলেছেন, যা আপনাকে যিনার দিকে নিয়ে যেতে পারে। একটু চিন্তা করুন তো, পর্নোগ্রাফি দেখা অবস্থায় মারা গেলে কিয়ামতের ময়দানে আপনার জন্য ঠিক কি অপেক্ষা করছে? জীবন নিয়ে জুয়া খেলার কোনো মানে হয় না। অন্যের নীতিবাচক জীবনের প্রলোভনে না পড়ে নিজের মতো করে জীবনযাপন করলে এই পৃথিবীটা আরও মনোমুগ্ধকর হতো।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<84893 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1