শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সতীদাহপ্রথা নিবারণের অগ্রদূত ডক্টর উইলিয়াম কেরি

জোবায়ের আলী জুয়েল গবেষক
  ১৯ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০

মানবতার পূজারি মানবপ্রেমী কেরি এই সমাজের সতীদাহ নামক বর্বর, অমানবিক প্রথায় কেবল ব্যথিতই ছিলেন না। তিনি এই সতীদাহ নরহত্যা চাক্ষুস দেখে হয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি পীড়িত ও মর্মাহত। এই জান্তব হত্যালীলাকে তিনি কোনোমতেই সহ্য করতে পারেননি। আর তাই তার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল 'বেওয়া-মাত জ্বালাও-বিধবাদের পুড়িও না'। ঞযড়ঁ ংযধষষ হড়ঃ নঁৎহ :যব রিফড়ংি. আন্দোলন। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দের গোড়ার দিকে উইলিয়াম কেরি মদনবাটী থেকে বাইবেল মুদ্রণসংক্রান্ত কাজে কলকাতায় আসেন। কলকাতায় কাজ সেরে তিনি যখন নৌকাযোগে মদনবাটী প্রত্যাগমন করেন, সেই সময় এ দেশের হিন্দুদের প্রচলিত প্রথানুযায়ী ও অমানবিক সতীদাহের এক দৃশ্য নিজের চোখে অবলোকন করেন।

এই অমানবিক দৃশ্য তাকে মর্মাহত করেছিল- এ সতীদাহের বিশদ বিবরণ দিয়ে তিনি অ্যান্ড্রু ফুলারকে এক দীর্ঘ চিঠি লেখেন- 'আমি যখন কলকাতা থেকে ফিরছিলাম, তখন আমি সহমরণের একটি দৃশ্য আমার জীবনে প্রথম দেখি। সহমরণ অর্থাৎ স্বামীর চিতায় জ্বলন্ত আগুনে স্ত্রীর আত্মাহুতিদান। হুগলির নওয়াভরাই গ্রামে এলে দেখতে পেলাম গঙ্গার ধারে নদীতীরে অনেক লোক জড়ো হয়েছে। কী জন্য তারা সমবেত হয়েছে তাদের জিজ্ঞাসা করায় তারা জানালো একটা মৃতের শবদাহ করার জন্য এসেছে। আমি তাদের কাছে জানতে চাই, মৃতব্যক্তির স্ত্রীকেও তার সঙ্গে দাহ করা হবে কিনা? তারা হঁ্যা সূচক উত্তর দেয়। কাঠের টুকরা দিয়ে মৃতের জন্য চিতাটি সাজানো হয়েছে এবং মহিলাটি তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। চিতাটি প্রায় আড়াই ফুট উঁচু লম্বায় প্রায় ৪ ফুট এবং চওড়া ২ ফুট হবে। চিতার ওপর মৃতব্যক্তিটি শোয়ানো ছিল। মহিলাটির কাছে তাদের এক নিকটাত্মীয় দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের কাছেই একটি ছোট ধামায় ছিল খই, বাতাসা। আমি জিজ্ঞাসা করি, মহিলা কি নিজের ইচ্ছায় চিতায় পুড়ে মরতে চাচ্ছে, না তাকে জোর করে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে? জোর করার কোনো প্রশ্নই আসে না, এটা মহিলাটির সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত। যখন আমি নানা যুক্তি দিয়ে তাদের বোঝাতে চেষ্টা করি, কাজটি অত্যন্ত অন্যায় ও পাপ। এভাবে কোনো মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা সঙ্গত নয়। আমার যখন কোনো যুক্তিই তারা শুনতে চায় না, তখন আমি চিৎকার করে উঠি, এ একেবারে জঘন্য হত্যাকান্ড। লোকজন আমাকে বলে, এ কাজ অত্যন্ত পুণ্যের এবং মহিলাটি যে পতিব্রতা এবং সতী তারই প্রমাণ এই সহমরণ। আমার যদি এ দৃশ্য দেখতে খারাপ লাগে তা হলে আমি যেন দূরে সরে যাই। আমি তাদের বলি, আমি যাব না এবং ওইখানে থাকার স্থির সিদ্ধান্ত নিই। এরকম নিষ্ঠুরভাবে পুড়িয়ে হত্যা করার দৃশ্য দেখে ঈশ্বরের বিচারালয়ে এই নির্মম হত্যাকান্ডের চাক্ষুস সাক্ষী হওযার জন্য। আমি মহিলাটিকে অনেক অনুরোধ করি, তুমি এভাবে নিজের জীবন নষ্ট করো না। ভয় পাওয়ার কিছু নেই, তুমি পুড়ে মরতে না চাইলে তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। মহিলাটি আমার কথায় বিন্দুমাত্র কান না দিয়ে ধীরস্থিরভাবে চিতার উপরে উঠে দুই হাত তুলে নাচতে শুরু করল। তাকে দেখে নির্বিকার বলে মনে হলো। মহিলাটি তিনবার করে মোট ছয়বার চিতাটি প্রদক্ষিণ করে। ধামা থেকে সে বাতাসা আত্মীয়-স্বজনরা ছড়াতে থাকে। উপস্থিত লোকেরা সেই খই-বাতাসা কুড়িয়ে ভক্তি ভরে খেতে থাকে। ঘোরা শেষ হলে মহিলাটি চিতার উপর উঠে দুই হাত তুলে নাচতে শুরু করে। তারপর সে মৃতদেহটির পাশে শুয়ে একহাত মৃতদেহটির গলার তলায় এবং অন্য হাত গলার উপরে দিয়ে দুই বাহুতে মৃতের গলা জড়িয়ে ধরে। শুকনো নারিকেলের পাতা এবং অন্যান্য দাহ্য বস্তু তার দেহের ওপর চাপানো হয়। তার ওপরে ঘি ঢেলে দেয়া হয়। দুটো বাঁশ মহিলার দেহের দুই পাশে আড়াআড়ি করে চেপে বাঁধার পর, চিতায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। চিতার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। এত রাজ্যের ঢোল, নাকাড়া ও জোরে জোরে শিবের জয় হরি ও হরি বলে চিৎকার করতে থাকে যাতে ওই বীভৎস শব্দে মহিলার গোঙানির শব্দ শোনা না যায়। দুই পাশে দুজন করে লোক বাঁশ দুটো চেপে ধরে রাখে, যাতে আগুনে পুড়ে যাওয়ার যন্ত্রণায় মহিলাটি চিতা থেকে লাফিয়ে না পড়তে পারে। আমি এর চেয়ে বেশি আর সহ্য করতে পারি নাই। চিৎকার করে ওই হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে চলে এসেছি এবং এই ঘৃণ্য দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছি। সহমরণের তথা সতীদাহের এই দৃশ্যের প্রত্যক্ষ করেছি।' সহমরণের তথা সতীদাহের এই দৃশ্যের প্রত্যক্ষ দর্শন মহাত্মা কেরীর মনোজগতে এক বিরাট আলোড়নের সৃষ্টি করে। এই পাশবিক প্রথা দূর করার জন্য কেরী এক বিরামহীন আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি তার সহযোগীদের নিয়ে এই নিষ্ঠুর প্রথার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। সে সময় ঋৎরবহফ ড়ভ ওহফরধ'র প্রথম সংখ্যাতেই সতীদাহপ্রথা সম্পর্কে কেরীর একটি তথ্যবহুল লেখা প্রকাশিত হয়। তাতে জানা যায়, ১৮১৯ থেকে ১৮২৯ খ্রি. পর্যন্ত দশ বছরে শুধু বাংলায় ৬ হাজার মহিলাকে স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে মারা হয়। ১০ আগস্ট ১৮১৯ খ্রি. 'সমাচার দর্পণে' প্রকাশিত হয়, একটি বিধবা আগুনে পুড়ে মরা থেকে বাঁচার জন্য নিদারুন চেষ্টা চালিয়েও রক্ষা পায়নি। ১৭ অক্টোবর ১৮২০ খ্রি. 'সমাচার দর্পণে' বর্ণিত হয়, এক ধনাঢ্য পরিবারের ১১ বছর বয়সের বালিকা বিধবাকে ১৫ বছর বলে চালিয়ে তাকে স্বামীর চিতায় পুড়ে মরতে বাধ্য করা হয়। উইলিয়াম কেরী নিজের মধ্যে নিশ্চিত হয়েছিলেন মানবিকতার সহজ-সরল সূত্রে সতীদাহ কখনোই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না এবং এই নিষ্ঠুর প্রথাটি সামাজিক কুসংস্কার মাত্র। এ দেশের শাস্ত্রজ্ঞ অনেক পন্ডিত ব্যক্তির সঙ্গে মতবিনিময়ও শাস্ত্রাদির অনুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণে কেউ তাকে এই প্রথার সঙ্গে কণামাত্র শাস্ত্রীয় সমর্থন আছে তাও জানাতে পারেনি। সমকালীন হিন্দু শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত সমাজের শিরোমনি মৃতু্যঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার কেরিকে এই অশাস্ত্রীয় কুপ্রথা নিবারণকল্পে শাস্ত্রের যাবতীয় টিকা ভাষ্য মতামত দিয়ে সমর্থন করেন। মৃতু্যঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার প্রকাশ্যে এই সতীদাহ প্রথার প্রথম বিরোধিত করেন। 'মৃত স্বামীর সহিত চিতার আগুনে পুড়িয়ে মরা নহে, পরলোকগত স্বামীর জীবন্ত স্মৃতি জ্বলন্তরূপে অন্তরে অঙ্কিত রাখিয়া আমরণ ব্রহ্মচর্য, সর্বপ্রকার সংযম, ত্যাগ এবং পরসেবা করাই হিন্দু সতীর আদল'। সতীদাহপ্রথা নিবারণের জন্য কেবল এ দেশেই নয়, কেরি ইংল্যান্ডেও জনমত গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। ১৮২৪ খ্রি. লর্ড উইলিয়াম বেস্টিংক এ দেশে গর্ভনর জেনারেল হয়ে আসেন। ১৮২৮ খ্রি. শ্রীরামপুরে উইলিয়াম কেরীর নেতৃত্বে মিশনারিরা সতীদাহ সম্পর্কে একটি ছোটসভা আহ্বান করেন। রাজা রামমোহন রায়, দ্বারকনাথ ঠাকুর, অন্নদাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বজ্রমোহনসহ- এ দেশীয় সমাজ হিতৈষী ব্যক্তিরা আমন্ত্রিত হয়ে এ সভায় যোগদান করেন। কেরির এসব সমাজ হিতৈষীর সহযোগিতায় ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর সতীদাহ বা সহমরণ প্রথা আইন বিরুদ্ধ ও দন্ডনীয় বলে লর্ড বেন্টিংকে ঘোষণা করেন। উইলিয়াম কেরির এতদিনের আন্দোলন ও প্রত্যাশা এই আইন পাসের মধ্যে সার্থকতা লাভ করে। নতুন আইন পাস করার পরপরই ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ৫ ডিসেম্বর প্রতু্যষে আইনটি বাংলায় অনুবাদ করার জন্য কেরীর কাছে প্রেরণ করা হয়। কেরি মুহূর্তকাল বিলম্ব না করে এই আদেশ অনুবাদে প্রবৃত্ত হন। কেরি তার পন্ডিত মৃতু্যঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারকে ডেকে সারাদিন নিরবচ্ছিন্নভাবে এই আইনটি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অনুবাদ করেন। যাতে এর প্রতিটি শব্দ, বাক্যে যথাযথভাবে বর্ণিত হয়। সন্ধ্যায় এই অনুবাদ শেষ করেন। তার পরের দিন শ্রীরামপুর ছাপাখানায় অনূদিত সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ আইন মুদ্রিত হয়ে এ দেশের জনসাধারণের মধ্যে বিতাড়িত হয়। ০৭-১২-১৮২৯ খ্রি. সোমবার 'বেঙ্গল হরকরা' পত্রিকায় প্রকাশিত হলো সতীদাহ নিষিদ্ধ করে সরকারি ঘোষণা আজ থেকে বলবৎ হবে। অনুভূতি সম্পন্ন প্রতিটি মানুষ বিষয়টিতে উৎফুলস্ন হবে বলাই বাহুল্য। সম্পাদকীয়তে প্রকাশিত হলো- 'আমাদের আজকের গেজেটে এমন একটি দলিল প্রকাশিত হয়েছে, যা দেখে প্রত্যেকটি মানবীয় হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। আজ থেকে সতীদাহ বীভৎস প্রথা নিষিদ্ধ হয়েছে। এই অমানুষিক প্রথা যার কথা চিন্তা করলে শরীরে লোম পর্যন্ত শিউরে উঠত। সতীদাহ প্রথাকে আজ থেকে যে সাহায্য করবে অথবা বন্ধ করার চেষ্টা না করে নিষ্ক্রিয়ভাবে অনুষ্ঠান দর্শক হিসেবে উপস্থিত থাকবে তাকে বিচারালয়ে অপরাধীর বেশে কৃৎকর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। মহাত্মা উইলিয়াম কেরি এ দেশে সতীদাহ বা সহমরণ নামক এই নিষ্ঠুর অমানবিক প্রথা তথা নারী হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ জানিয়ে আন্দোলন করেছিলেন একটি দীর্ঘসময় নিরলসভাবে। উইলিয়াম কেরিই সতীদাহ বা সহমরণ প্রথা নিষিদ্ধ আইনের বাংলা অনুবাদ করে। ভারতের রাজস্থানে সতীদাহ প্রথায় নিহত নারীদের হাতের ছাপে তৈরি টেরাকাটা দিয়ে একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে (দৈনিক সংবাদ- ফেব্রম্নয়ারি ২০১৯ খ্রি.)। কেরি এ দেশের সামাজিক সমস্যার মর্মমূলে আঘাত হেনেছিলেন সচেতন করে তুলেছিলেন ও দেশের জনসমাজকে। সে পথ ধরে পরে রাজারাম মোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ মনীষীরা এগিয়ে আসতে পেরেছিলেন এই সমাজকে সংস্কার করতে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<84895 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1