শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জন্মশতবর্ষ: মুজিব মানেই বাংলাদেশ

ডা. এস এ মালেক
  ২৫ জানুয়ারি ২০২০, ০০:০০
কুলাঙ্গারের বুলেট আর ষড়যন্ত্র থেকে আমরা জাতির পিতাকে রক্ষা করতে পারিনি কিন্তু দ্বিতীয়বার এ ভুল করা চলবে না। যে কোনো ত্যাগের বিনিময়ে আমরা জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যাকে আগলে রাখব এই হোক আমাদের আজকের অঙ্গীকার। কেন না তার মাধ্যমেই জীবিত আছেন, 'বঙ্গবন্ধু'; জীবিত রয়েছে 'বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ'।

বিশ্বব্যাপী বঙ্গবন্ধুর পরিচিতি হচ্ছে একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে। দেশবরেণ্য, বিশ্ববরেণ্য রাজনীতিবিদ। মানবপ্রেমী, অনন্য সাধারণ একজন রাজনীতিবিদ যিনি তার জীবদ্দশায় নির্যাতিত-নিপীড়িত, নিষ্পেষিত বাঙালি নামক একটি জনগোষ্ঠীকে চিরদিনের জন্য মুক্ত-স্বাধীন করে গেছেন। ..

মুজিব মানে বাংলাদেশ। মুজিবের জীবনসংগ্রাম-ই বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম, বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম। স্বার্থকভাবেই ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বলেছিলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' প্রথমে বলেছিলেন মুক্তির কথা তারপর স্বাধীনতা। মুক্তির প্রয়োজনেই স্বাধীনতা। স্বাধীন তিনি আমাদের করে গেছেন কিন্তু সব প্রকার শোষণ থেকে মুক্ত করার সুযোগ তিনি পাননি। ওই কর্মসূচি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শুধু বাংলাদেশের শোষিত-বঞ্চিত মানুষের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেননি। প্যালেস্টাইন, ভিয়েতনামসহ যেখানেই মুক্তির জন্য সংগ্রাম চলেছে সেখানেই বঙ্গবন্ধু অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন। মানবতাবাদী এই মহান নেতার হৃদয় ছিল আকাশের মতো উদার। মানবতা বিপন্ন দেখলেই তার কণ্ঠস্বর সোচ্চার হতো।

ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টিতে বাঙালির অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালিদের কখনো পাকিস্তানের পূর্ণ নাগরিকের মর্যাদা দেয়নি। স্বার্থান্ধতা তাদের এতই নিষ্ঠুর ও নির্মম করেছিল যে বাংলাদেশের সব সম্পদের বিনিময়ে তারা পাকিস্তান গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করতে থাকে। আর ওই বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে বাঙালির কণ্ঠ সবচেয়ে সোচ্চার ছিল, যিনি হৃদয় দিয়ে বাঙালির এই গভীর সংকট মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন এবং বাঙালিত্ব যাতে পাকিস্তানত্বে বিলীন হয়ে না যায়, সেই লক্ষ্যে সচেতনভাবে জাতীয় চেতনার ওপর ভিত্তি করে জাতিসত্তার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন এবং সর্বোপরি সেই জাতিসত্তাকে একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনিই শেখ মুজিব। আপামর বাঙালির মুজিব ভাই, বঙ্গবন্ধু, জাতির জনক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, ইতিহাসের মহানায়ক, বাংলদেশের স্বাধীনতার রাখাল রাজা।

তার রাজনীতির মূল প্রাণশক্তি ছিল ভালোবাসা। বাংলা, বাঙালি আর বাংলার মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা। আর ওই গভীরতম ভালোবাসা থেকে উৎসারিত অপরিসীম মমত্ববোধ, সহনশীলতা ও দেশপ্রেম। ছোটবেলা থেকেই তিনি মানুষের প্রতি দরদি ছিলেন। সহপাঠী, আশপাশের গরিবজনরা তার জনদরদি ক্রিয়াকর্মে উপকৃত হয়েছেন। ছাত্রজীবনেই রাজনীতির হাতেখড়ি, তাও আবার প্রতিবাদমুখী। যৌবনে যখন জীবনকে উপভোগের সময় তখন থেকেই ত্যাগ-তিতিক্ষা, জেল-জুলুম-নির্যাতন-নিপীড়ন। ক্ষণস্থায়ী জীবনের প্রায় সাড়ে ১৩ বছর কাটিয়েছেন কারাগারে। ছেলেমেয়ে, স্ত্রী-পরিজন-সংসার, নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এসব একদিকে, অন্যদিকে দেশ, দেশের মানুষ, দেশের ভবিষ্যৎ। সব রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক অন্যায়-অবিচার আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমৃতু্য হিমালয়ের মতো দাঁড়িয়েছিলেন। মাতৃভূমির প্রতি, মাতৃভাষার প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধাবোধ, দেশের জনগণের প্রতি, বিশেষ করে শোষিত-বঞ্চিত মানুষের প্রতি এত গভীর মর্মস্পর্শী অনুভূতি বিশ্বের খুব কম নেতাদের মধ্যেই দেখা যায়।

ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও যে বাঙালি নির্ভীকচিত্তে বাঙালির জয়গান গেয়েছেন, স্বাধীনতার স্বপ্ন, মুক্তির সংগ্রাম আর বিপস্নবের মন্ত্রে দীক্ষিত ছিলেন তিনি। তিনি জানতেন বাঙালিকে স্বাধীন করতে হলে কি ধরনের মূল্য দিতে হবে। জীবনপণ সংগ্রাম করতে হবে। কেউ তাকে দাবায়ে রাখতে পারেনি। খোকা, 'মুজিব' থেকে সংগ্রামের মাধ্যমেই 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার একমাত্র কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুরই। কিন্তু যে মানুষের জন্য স্বাধীনতা, তারা যদি না খেয়ে থাকে, আবাসন না পায়, স্বাস্থ্য-শিক্ষার সুযোগ না পায়, অর্থহীন সেই স্বাধীনতা অর্থপূর্ণ করার জন্যই তিনি দ্বিতীয় বিপস্নবের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। হৃদয়ের গভীরে সঞ্চিত ভালোবাসা তাই মুখের ভাষা ও রাজনৈতিক কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়ে পারে কি!

স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর, বাঙালির জীবনে প্রকৃত স্বাধীনতার সুফল আনতে তিনি দ্বিতীয় বিপস্নবের ঘোষণা করেন। নিজ দলের অনেকেই এ সময়ে প্রকাশ্যে তার বিরোধিতা না করলেও অকুণ্ঠ সমর্থন জানাননি। তিনি জানতেন মহাবিপদের সম্মুখীন তাকে হয়তো হতে হবে। সবকিছু অগ্রাহ্য করে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তিনি জাতীয় সংসদে সমাজ বিপস্নবের কর্মসূচি পাস করেন। বিশ্বের ইতিহাসে আর কোনো রাজনীতিবিদ এমনটি করতে সক্ষম হয়েছেন কিনা সন্দেহ। স্বাধীনতাকে সাধারণ মানুষের জীবনে অর্থপূর্ণ করার এই প্রবল আকাঙ্ক্ষা তার দলের অনেক নেতাই অনুধাবন করতে সক্ষম হননি। তাই বাকশাল প্রশ্নে তারা নীরব থেকেছেন। ইশারা-ইঙ্গিতে বলতে চেয়েছেন বঙ্গবন্ধু কাজটা সঠিক করেননি। করলে তো তাকে ওইভাবে জীবন দিতে হতো না। যাদের সাম্রাজ্যবাদের হিংস্র থাবা সম্পর্কে ধারণা নেই, উলঙ্গ পুঁজিবাদের ওপর যাদের আস্থা, তারাই এরূপ ভাবেন। ভুল তিনি করেননি। তার পক্ষে যেটা করা সম্ভব ছিল, অন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয়, সম্ভব ছিল না। প্রতি বিপস্নবের ঘটনা না ঘটলে তিনি যে সঠিক ছিলেন তা প্রমাণিত হতো। বাংলার মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের মাধ্যমেই তা প্রমাণিত হতো। বাংলার মানুষের স্বার্থবিরোধী কোনো চক্রান্তে বঙ্গবন্ধু যুক্ত থাকতে পারেন এরকম চিন্তা কেবল স্বাধীনতার শত্রম্নরাই করতে পারে।

যে মহান ত্যাগের বিনিময়ে তার ডাকে সাড়া দিয়ে ৩০ লাখ মানুষ শহিদ হয়েছেন, এ দেশ স্বাধীন করেছেন, তিনি চেয়েছিলেন তাদের মুক্তি। এখানে কোনো আপস নয়, সমঝোতা নয়, আত্মসমর্পণ নয়। সাম্রাজ্যবাদের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করে তিনি তার কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সে কারণে তাকে সপরিবারে জীবন দিতে হয়েছে। কিন্তু তার প্রতি বাঙালির শ্রদ্ধা-ভালোবাসার কি বিলুপ্তি ঘটেছে? কক্ষনো না। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলায় স্বাধীনতার পক্ষে আজও যদি কেউ বক্তব্য রাখেন, তাকে উচ্চারণ করতে হবে একটি নাম 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান'। যিনি বাংলাদেশের জনগণের ত্রাতা, মুক্তিদাতা। মৃত মুজিব জীবিত মুজিবের চেয়ে অনেক বেশি উচ্চকণ্ঠ, শক্তিশালী। তাকে বাদ দিয়ে স্বাধীন বাংলায় রাজনীতি করা যায় না। ইতিহাস থেকে কোনোদিনই মুছে ফেলা যাবে না তাকে। নিজেকে স্বার্থকভাবেই তিনি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। সময়ের ঘটনাপ্রবাহ তাকে চিরঞ্জীব করেছে। কারো অনুকম্পা, দয়া-দাখিন্যে বাংলার ইতিহাসে তার নাম প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তিনি নিজেই নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।

একসময় ছিলেন মুজিব ভাই- বাপের ভাই, ছেলের ভাই, নাতি-নাতনির ভাই, আপামর বাঙালির ভাই। মুজিব নামের মানুষ হয়তো বাংলার মাটিতে আরও ছিল কিন্তু 'শেখ মুজিব' বলতে একজনকেই বোঝাতো। পাকিস্তানিরা 'শেখ সাহেব' বলতে পূর্ব বাংলার শেখ মুজিবকেই বোঝাতেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত হলেন। তারপর থেকে যা করেছেন বাংলা ও বাঙালির বন্ধু হিসেবে করেছেন, বঙ্গবন্ধু হিসেবে করেছেন। উল্কার মতো ছুটে বেড়িয়েছেন দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। মোনায়েম খান বলেছিলেন তাকে (বঙ্গবন্ধুকে) সূর্যের আলো দেখতে দেওয়া হবে না। সূর্যের মুখ হয়তো কিছুদিনের জন্য তিনি দেখেননি। তবে দেশের জন্য এনে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার রক্তিম লাল সূর্যকে। বাংলা, বাঙালি, জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা এই তো 'মুজিব'। এই মুজিবের কি কখনো মৃতু্য ঘটে? আজ বাংলার লাখো কোটি লাল গোলাপ পাপড়ি বিছিয়ে রেখেছে মুজিবের পথে, তার সম্মানে। অলির গুঞ্জরণে একটি নামের প্রতিধ্বনি 'শেখ মুজিব'। প্রতু্যষে পাখির কল-কাকলিতে ভেসে আসে মুজিবের কণ্ঠস্বর।

বাংলার নিরন্ন রিক্ত মানুষ আজ তৃপ্ত। শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুখে আজ প্রাপ্তির হাসি। দুর্ভিক্ষ নামক ব্যাধি আজ বাংলার বুক থেকে বিতাড়িত। বাংলার মানুষকে যাতে কষ্ট করতে না হয় সে ব্যবস্থা তিনি করে গেছেন। তিনি চলে গেছেন মৃতু্যর ওপারে, রেখে গেছেন এক অমূল্য সম্পদ। তার অতি আদরের কন্যারত্ন, দেশরত্ন 'শেখ হাসিনা'। যে গুণে তিনি নিজে গুণান্বিত ছিলেন, সবকিছু দিয়ে গেছেন তার সুযোগ্য কন্যার মধ্যে। তাই তো অবিকল পিতার মতোই লালন-পালন করে যাচ্ছেন তার প্রিয় দেশবাসীকে। দুজনের লক্ষ্য একই। শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের মুক্তি। দেশ ও জনগণের উত্তম সেবা, তাদের জীবনমান উন্নয়ন এবং বহির্বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ৩৯টি আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। এটা বাঙালি হিসেবে আমাদের জন্য সম্মানের, অতি গৌরবের।

একদা গ্রামের ছোট্ট কুটিরে, গভীর অমাবস্যার আঁধারে যে ঘরে টিপটিপ করে জ্বলত কুপিবাতি, সেখানে আজ বিদু্যতের ঘনঘটা। আলোকিত আজ গ্রামবাংলা। উন্নয়ন, উৎপাদন, দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য-শিক্ষার নিশ্চয়তা, উপভোগ্য সংস্কৃতি, বিশ্বসভায় বাংলাদেশের স্বগৌরব সুপ্রতিষ্ঠা এই তো 'শেখ হাসিনা'। যারা বিরোধিতা করছে, বিরোধিতা তারা করবেই। কেননা বিরোধিতাই তাদের রাজনীতি। আজ সাময়িকভাবে তিনি দেশে অনুপস্থিত থাকলেই জাতি তার শূন্যতা অনুভব করে, ঠিক যেমনটি অনুভব করে বঙ্গবন্ধুর অভাব। তাই স্বভাবতই তার অবর্তমানে জাতি অসীম শূন্যতায় নিমজ্জিত হবে একথা অতি সহজেই অনুমেয়।

কুলাঙ্গারের বুলেট আর ষড়যন্ত্র থেকে আমরা জাতির পিতাকে রক্ষা করতে পারিনি কিন্তু দ্বিতীয়বার এ ভুল করা চলবে না। যে কোনো ত্যাগের বিনিময়ে আমরা জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যাকে আগলে রাখব এই হোক আমাদের আজকের অঙ্গীকার। কেন না তার মাধ্যমেই জীবিত আছেন, 'বঙ্গবন্ধু'; জীবিত রয়েছে 'বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ'।

ডা. এস এ মালেক: রাজনীতিক ও কলাম লেখক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<85755 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1