শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা দেশবিরোধীদের চক্রান্ত

আগস্টের সব অঘটনের মূলে রয়েছে দেশবিরোধী চক্রান্ত এবং দেশের স্বাধীনতা সাবের্ভৗমত্বকে নস্যাতের হীন পরিকল্পনা। পাকিস্তানের ভাবাদশের্ বিশ্বাসীরা মূলত এ অপকমের্ লিপ্ত হয়েছে একটি স্বাধীন দেশের গৌরব ও অজর্নকে ¤øান করে দেয়ার জন্য। যারা স্বাধীন বাংলাদেশ চায়নি তারাই এসব অপকমের্র হোতা, পরিকল্পনাকারী ও পৃষ্ঠপোষক।
সালাম সালেহ উদদীন
  ২১ আগস্ট ২০১৮, ০০:০০

আজ বেদনাবহ ও ভয়ঙ্কর ২১ আগস্ট। ইতিহাসে জঘন্যতম কলঙ্কময় একটি দিন। ২০০৪ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের জনসভায় অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নিষ্ঠুর, অমানবিক ঘটনা হিসেবে দীঘর্কাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে ২১ আগস্টের এ হামলা। দেশের মানুষ ঘৃণাভরে স্মরণ করবে এ দিনটি। যেমন স্মরণ করে থাকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর। মূলত আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করে তার দলকে নেতৃত্বশূন্য করার লক্ষ্যে এই ববর্রতম নিষ্ঠুর হামলা চালানো হয়েছিল। এই নিমর্ম হামলার ঘটনায় শেখ হাসিনা ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেলেও আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ত্যাগী নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিরপরাধ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। হামলায় শত শত মানুষ মারাত্মকভাবে জখম হয়েছেন, চিরজীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করেছেন অনেকেই। হত্যাকাÐের মূল টাগের্ট ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা বতর্মান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল। এর এক বছর পর ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশের ৬৩টি জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালিয়ে যে নজির স্থাপন করেছে তাও বিস্ময়কর। তারা তাদের অস্তিত্ব ও শক্তি জানান দেয়ার জন্যই এ ঘটনা ঘটিয়েছে।

আগস্টের সব অঘটনের মূলে রয়েছে দেশবিরোধী চক্রান্ত এবং দেশের স্বাধীনতা সাবের্ভৗমত্বকে নস্যাতের হীন পরিকল্পনা। পাকিস্তানের ভাবাদশের্ বিশ্বাসীরা মূলত এ অপকমের্ লিপ্ত হয়েছে একটি স্বাধীন দেশের গৌরব ও অজর্নকে ¤øান করে দেয়ার জন্য। যারা স্বাধীন বাংলাদেশ চায়নি তারাই এসব অপকমের্র হোতা, পরিকল্পনাকারী ও পৃষ্ঠপোষক।

’৭৫-এর ১৫ আগস্ট মোশতাক-জিয়া চক্র কেবল ব্যক্তি মুজিবকেই হত্যা করেননি। তারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদশর্ তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তির ওপর চরম আঘাত হানেন। কেবল তাই নয়, একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে পেছনের দিকে নিয়ে যান এই চরম প্রতিক্রিয়াশীল চক্র। কনের্ল জামিল ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নিজের জীবন দিয়েও বঙ্গবন্ধুকে বঁাচাতে পারেননি। কিন্তু ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের নেতাকমীর্রা মানবঢাল তৈরি করে নিজেদের জীবনকে তুচ্ছ করে তাদের প্রাণপ্রিয় নেত্রীকে বঁাচিয়েছিলেন। ইতিহাসে এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রতি তাদের অপরিসীম ভালোবাসারই প্রমাণ দিয়েছেন তারা। তাদের এই আত্মত্যাগ জাতি চিরদিন স্মরণে রাখবে।

এ কথা সত্য যে, ২০০১ সালে ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক চিত্র দ্রæত পাল্টে যায়। শুরু হয় নজিরবিহীন ও অভাবিত রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তার বীভৎস রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্নকরণের ধারাবাহিক অভিযানে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পঁাচ বছরে সাবেক অথর্মন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া এমপি ও আহসান উল্লাহ মাস্টার এমপিসহ হাজার হাজার নেতাকমীর্ নিহত হন। ধমীর্য় সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গ্রামগুলোর ওপর মধ্যযুগীয় ববর্রতা নিয়ে হামলা চালানো হয়। শত শত নারী, তরুণী-শিশু হয় ধষর্ণ-গণধষের্ণর শিকার। মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ সব সীমা ছাড়িয়ে যায়। শেখ হাসিনা টানা প্রায় ১০ বছর ক্ষমতায় থেকে বাংলাদেশকে আবার অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ফিরিয়ে আনেন এবং দেশ থেকে জঙ্গিবাদ নিমূর্ল করেন। এ জন্য তাকে ধন্যবাদ।

প্রকৃত অথের্ ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলাকারীরা ১৫ আগস্টের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে চেয়েছিলেন এবং তারা সেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু তারা পুরোপুরিভাবে সফল হননি। সেদিন হত্যাকারীরা অবস্থান নিয়েছিলেন গণতন্ত্র, মানবাধিকার, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে, জঙ্গিবাদের পক্ষে। শেখ হাসিনা গণতন্ত্র, মানবাধিকার, অসাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন বলে তাকে বারবার হত্যাকারীদের আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। শেখ হাসিনার জীবন এখনো নিরাপত্তাহীন। কারণ এ দেশের স্বাধীনতাবিরোধী চক্র বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়। তাদের সেই অপচেষ্টা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এটাকে তারা মনে করছে অসমাপ্ত কাজ।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার দিন ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে যখনই বক্তব্য শেষ করা হয়েছিল তখনই ঘাতকের একের পর এক গ্রেনেড ছুটে আসছিল তার ট্রাকের দিকে। কিন্তু সেই হামলায় ব্যবহƒত আজের্স গ্রেনেডের উৎস, এর জোগানদাতা, পরিকল্পনাকারী এবং হামলার নেপথ্য কারিগরদের চিহ্নিত করা যায়নি এখনো। শেখ হাসিনাকে হত্যা করে কেউ বিশেষভাবে লাভবান হতে চেয়েছিল কিনা কিংবা হামলার পেছনে প্রভাবশালী কাদের হাত ছিল তার কিছুই তখন বের করা সম্ভব হয়নি। যদিও তৎকালীন সরকারের মদদেই এ হামলা হয়েছিল।

আশার কথা, অচিরেই এই মামলার রায় ঘোষিত হবে, আগামী মাসের কথা শোনা যাচ্ছে। মামলার তদন্তে উঠে এসেছে জঙ্গিদের পেছনে বিএনপি জোট সনকারের পৃষ্ঠপোষকতা।

গ্রেনেড হামলায় নিহতদের পরিবারের আহাজারি আজও থামেনি। স্বজন হারানোর ব্যথা ভুলতে পারেনি পরিবারগুলো। তারা অনেকেই অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছেন। শেখ হাসিনা বহুবার মৃত্যুর মুখোমুখি দঁাড়িয়েছেন। তিনি বারবারই বলেছেন ‘আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যা, মৃত্যুকে আমি ভয় করি না।’ গণতন্ত্রকে রক্ষা, জঙ্গিবাদকে নিমূর্ল ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনিমাের্ণ শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বিকল্প নেই ভেবেই হামলাকারীরা তার নেতৃত্ব ধ্বংস করার জন্য বারবার আঘাত করেছে। তাকেই তারা বারবার টাগের্ট করে আসছে। টাগের্ট করেছে তার দল আওয়ামী লীগকেও।

সিআইডির তদন্তে পাওয়া তথ্যানুযায়ী শেখ হাসিনাকে হত্যা ও আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে সেদিন ঘাতকরা উঠেপড়ে লেগেছিল। সৃষ্টিকতার্র অপার মহিমায় তাদের হীনচক্রান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। তার পরও আইভি রহমানসহ অনেক রাজনৈতিক কমীর্র জীবনপ্রদীপ নিভে গেছে অকালে। এখনো বহু মানুষ গ্রেনেডের স্পিøন্টার শরীরে নিয়ে বেঁচে আছেন। সে যাত্রায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী রক্ষা পেলেও চক্রান্তকারীরা এখনো সক্রিয়। এদের সমূলে উৎপাটন করতে হবে।

কেউ স্বীকার করুক বা না করুক, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা এখনো শেষ হয়নি। সে কারণে, যে করেই হোক জঙ্গিবাদ পুরোপুরি দমন করতে হবে। এটা বাংলাদেশের অব্যাহত মুক্তিযুদ্ধেরই অংশ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এখনো অসমাপ্ত। ’৭১-এ যুদ্ধের রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিপক্ষ ছিল ভিনদেশি হানাদার বাহিনী। তাদের পরাজিত করে আমরা ভেবেছিলাম মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলো। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টই প্রমাণিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি। সেই যুদ্ধ এখনো অব্যাহত রয়েছে। এবার প্রত্যক্ষ শত্রæ কোনো দখলদার বিদেশি শক্তি নয়। বিদেশি শক্তির ইন্ধনে এখন প্রধান প্রতিপক্ষ সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল আদশের্ বিশ্বাসী আমাদের স্বদেশী ‘পাকিস্তানিরা’। যারা উগ্রবাদে, জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী। এরা ঘরের শত্রæ বিভীষণ। এই শত্রæকে রুখে দিতে না পারলে মুক্তিযুদ্ধের আদশের্র সৈনিকদের রক্ষা নেই। কারণ সুযোগ পেলে তারা মরণছোবল মারবেই। তারা কেবল সুযোগের অপেক্ষায় ঘাপটি মেরে আছে। এ সুযোগ কোনোভাবেই তাদের দেয়া যাবে না। তাহলে মুক্তিযুদ্ধের আদশের্র চেতনার চিরপরাজয় ঘটবে এই স্বাধীন বাংলাদেশে।

মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল থাকুক এটা একটি শ্রেণি চায়, বাংলাদেশের ভাবমূতির্ ক্ষুণœ হোক, অথৈর্নতিকভাবে পূণর্ সমৃদ্ধির পথে যেতে না পারুক এটাও চায় ওই শ্রেণিটি। এর সফল বাস্তবায়ন ঘটাতে দেয়া যাবে না। তাহলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।

বস্তুত, ১৯৭১, ১৯৭৫ ও ২০০৪-এর আগস্ট গণহত্যা ও হত্যাপ্রচেষ্টার লক্ষ্য এক, শত্রæও এক। এ শত্রæকে পরাজিত করতে হবে। এ স্বদেশী পাকিস্তানিদের রাজনৈতিকভাবে নিমূর্ল করতে না পারলে এবং বাংলাদেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ ও সদাজাগ্রত রাখতে না পারলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অসমাপ্তই থেকে যাবে। মুক্তি পাবে না গণতন্ত্র, বন্ধ হবে না মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। আমরা দেশবিরোধীদের চক্রান্ত এবং ১৫ ও ২১ আগস্টের পুনরাবৃত্তি প্রচেষ্টা আর প্রত্যক্ষ করতে চাই না। সে জন্য প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির ঐক্য ও জাগরণ। এটা যত দিন পযর্ন্ত না ঘটবে তত দিন ঝুঁকি থেকেই যাবে। আর এ ঝুঁকি বহন করতে হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগকে, দেশের জনগণকে।

সালাম সালেহ উদদীন: কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<8722 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1