শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

উচ্চশিক্ষার মানের দিকে নজর দেওয়া জরুরি

বিমল সরকার অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক
  ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০০:০০

আগে যেমনই থাক বা না থাক- শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমানে কী নেই আমাদের। স্বীকার না করে উপায় নেই যে উচ্চশিক্ষায় আমাদের দেশে এ এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। সরকারি-বেসরকারি দেড়শর বেশি বিশ্ববিদ্যালয়। একইভাবে একশর বেশি মেডিকেল কলেজ। এ ছাড়া ছয়শর বেশি সরকারি কলেজ। ডিগ্রিস্তরে পাঠদানোপযোগী কলেজ দুই হাজারের বেশি। আর সরকারি-বেসরকারি আটশ কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স পড়ানোর ব্যবস্থা-বন্দোবস্ত। এসব বিবেচনায় শিক্ষা ক্ষেত্রে বিপস্নব বলা যেতে পারে। ইংরেজরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রায় দুশ বছর (১৭৫৭-১৯৪৭) আমাদের ওপর শাসনকর্তৃত্ব চালিয়েছে। আমাদের দেশে ইংরেজি তথা আধুনিক শিক্ষার গোড়াপত্তন হয় ইংরেজদের হাতেই। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় দেশে (পূর্ববঙ্গ) কলেজ ছিল ৫৫টি। তার মানে বর্তমান ৬৪টি জেলার কোনো কোনোটিতে ডিগ্রিস্তরের একটিও কলেজ গড়ে ওঠেনি তখন পর্যন্ত। ৫৫টি কলেজের মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম এমন ৮টি ছিল সরকারি কলেজ। অর্থাৎ বেশির ভাগ জেলা সদরেও (বৃহত্তর) কোনো সরকারি কলেজ ছিল না। ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ, বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ, ঢাকার জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণ হয় ষাটের দশকের মাঝামাঝি- যথাক্রমে ১৯৬৪, ১৯৬৫ ও ১৯৬৮ সালে। ঠিক এভাবেই পাকিস্তান আমলে ২৪ বছরে (১৯৪৭-১৯৭১) ক্রমে সরকারি হয় আরও মোট ২৪টি কলেজ। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর (১৯৭২ সালে) সারা দেশে মোট কলেজ ২৩৬টি। কলেজগুলোর মধ্যে ৩২টি সরকারি আর ২০৪টি বেসরকারি। ৩২টি সরকারি কলেজের মধ্যে ২৬টি ডিগ্রি (স্নাতক) ও ৬টি ইন্টারমিডিয়েট (উচ্চ-মাধ্যমিক) স্তরের। ২০৪টি বেসরকারি কলেজের মধ্যে ১১০টি ডিগ্রি ও ৯৪টি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ। ডিগ্রি কলেজগুলো ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইন্টারমিডিয়েট কলেজগুলো ঢাকা, রাজশাহী, যশোর ও কুমিলস্না শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ছিল। আমাদের মহান জাতীয় সংসদে ১৯৭২ সালের ২২ আগস্ট শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসূফ আলী প্রদত্ত বক্তৃতার বর্ণনা থেকে এসব তথ্য জানা যায়। বৃহত্তর ময়মনসিংহ (ময়মনসিংহ সদর, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, জামালপুর ও শেরপুর), এমনকি টাঙ্গাইলসহ এ অঞ্চলে আনন্দমোহন কলেজ ছাড়া উচ্চশিক্ষা দান-গ্রহণের আর কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান ছিল না। পরবর্তী ৬ বছরে (১৯৭২-১৯৭৭) গড়ে উঠতে উঠতে দেশে স্কুল-কলেজের সংখ্যা দ্বিগুণ বা দ্বিগুণকে ছাড়িয়ে গেলেও সরকারি কলেজের সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ৫টি। ১৯৭৭ সালে সারা দেশে মোট সাড়ে ৫০০ কলেজের বিপরীতে সরকারি কলেজ ছিল ৩৭টি (সূত্র: দৈনিক সংবাদ-৩০ মার্চ ১৯৭৭)। ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত টাঙ্গাইলের করোটিয়া সা'দত কলেজটি সরকারিকরণ হয় ১৯৭৯ সালে (এটি বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল অর্থাৎ ৬ জেলার মধ্যে দ্বিতীয় সরকারি কলেজ)। ১৯৮০ সালে এক ঘোষণার মাধ্যমে দেশের সব সাবেক মহকুমা সদরের অপেক্ষাকৃত পুরনো একটি করে কলেজকে সরকারি করা হয়। আর আশি ও নব্বইয়ের দশকে ক্রমান্বয়ে জেলা সদরের মহিলা কলেজগুলোকে এবং উপজেলাপর্যায়ে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কলেজ সরকারিকরণ হয়। এভাবে বাড়তে থাকে সরকারি কলেজের সংখ্যা। ২০০৬ সাল নাগাদ দেশে মোট কলেজের সংখ্যা দঁড়ায় ৩০৮৭ (ডিগ্রি ও ইন্টারমিডিয়েট)। এগুলোর মধ্যে সরকারি ২৮২টি, বাকিগুলো বেসরকারি ও প্রাইভেট (সূত্র: ২০০৬ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে শিক্ষাপ্রতিমন্ত্রী এহসানুল হক মিলন প্রদত্ত বক্তৃতা)। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে দেশে মোট কলেজ রয়েছে আনুমানিক সাড়ে চার হাজার। এগুলোর মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন পাস, অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স পাঠদান করা হয় এমন ডিগ্রি কলেজ রয়েছে আনুমানিক ২২০০। ডিগ্রি ও ইন্টারমিডিয়েট স্তরের এই সাড়ে চার হাজার কলেজের মধ্যে সরকারি কলেজ ৬০০-এর বেশি, বাকিগুলো বেসরকারি ও প্রাইভেট। ইংরেজ আমলে আমাদের বাংলাদেশ অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় একটিই ছিল (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত : ১৯২১)। ১৯৪৭ সালে এখানকার সবেধন নীলমণি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েই পাকিস্তানের যাত্রা শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৩২ বছর এবং ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির ৭ বছরের মাথায় ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠা পায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর একে একে আরও চারটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস্তান আমলে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ (১৯৬১), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬২), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬৬) ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭০)। ১৯৭২ সালে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এ ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু হয়। স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম বিশ বছরে (১৯৭১-১৯৯১) প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৮১), খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৮৭) ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯১)। আমাদের দেশে মোটামুটি এই হলো উচ্চশিক্ষা দান-গ্রহণ ও চর্চা-গবেষণা করার জন্য সুস্থ ধারার বন্দোবস্ত। পরে অনেককিছুই হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। দেশে এখন সম্প্রতি ঘোষিত ৬টিসহ মোট ৫২টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।

লক্ষ্য করার বিষয়- এ ৫২টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ইংরেজ আমলের ১৯০ বছরে (১৭৫৭-১৯৪৭) মাত্র ১টি (আমাদের বাংলাদেশ অঞ্চলে)ও পাকিস্তান আমলে ২৪ বছরে ৫টি অর্থাৎ ঔপনিবেশিক শাসনামলে ২১৩ বছরে (১৭৫৭-১৯৭১) দেশে মোট ৬টি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে। স্বাধীনতার পর থেকে বিগত ৪৮ বছরের প্রথম ২০ বছরে (১৯৭১-১৯৯১) একে একে হয় আরও তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়। আর বাকি ২৮ বছরে (১৯৯২-২০২০) প্রতিষ্ঠা করা হয় ৪১টি বিশ্ববিদ্যালয়। অতিসম্প্রতি (২৭ জানুয়ারি ২০২০) মন্ত্রিসভার বৈঠকে বগুড়া ও লক্ষ্ণীপুর জেলায় আরও দুটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তার মানে দেশে এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাটি ৫২-এ উন্নীত হলো।

এবার মেডিকেল কলেজের (চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান) কথা। গত ৪৭ বছরে (১৯৪৬-১৯৯২) এখানে ধাপে ধাপে মোট ১০টি মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয়। যার শুরু ১৯৪৬ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম ১০ বছর পর্যন্ত ঢাকা-ই একমাত্র মেডিকেল কলেজ। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (১৯৫৭), রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (১৯৫৮), ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (১৯৬২), সিলেট (বর্তমান ওসমানী) মেডিকেল কলেজ (১৯৬২), স্যার সলিমুলস্নাহ মেডিকেল কলেজ (১৯৬৩), স্নাতকোত্তর চিকিৎসা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) (১৯৬৬), বরিশাল (বর্তমান শেরেবাংলা) মেডিকেল কলেজ (১৯৬৮), রংপুর মেডিকেল কলেজ (১৯৭০) ও কুমিলস্না মেডিকেল কলেজ (১৯৭৯)। অর্থাৎ ইংরেজ আমলে একটি, পাকিস্তানের ২৪ বছরে ৮টি এবং আমাদের স্বাধীনতার পর প্রথম ২০ বছরে (১৯৭২-১৯৯২) ১টি মোট এ ১০টি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী ২৮ বছরে (১৯৯২-২০২০) প্রতিষ্ঠিত আরও ২৬টি মিলে দেশে এখন সরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা ৩৭। রয়েছে তিনটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। আর বেসরকারি ৭৬টি মিলে মেডিকেল কলেজ বা চিকিৎসাশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মোট সংখ্যাটি ১০৬। দেশের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান স্থাপন বা বৃদ্ধিকে, সরকারি-বেসরকারি যাই হোক একদম চমক বলা যায়। নিঃসন্দেহে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এ এক বিপস্নব। কিন্তু এসবের ব্যবস্থাপনা ও গতি-প্রকৃতি এবং শিক্ষার মানের বিষয়টি অনেক আগে থেকেই সাংঘাতিকরূপে প্রশ্নের সম্মুখীন। এভাবে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা না বাড়িয়ে বা অপরিকল্পিতভাবে সরকারি না করে মানের দিকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে দৃষ্টি না দিলে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যটাই ব্যাহত হয়ে যেতে বাধ্য। এক একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মানে তো এক একটি বাতিঘর। ওই বাতিঘর সঠিকভাবে আলো ছড়াচ্ছে কিনা প্রকৃত অর্থে সেটাই দেখা ও উপলব্ধির ব্যাপার।

\হ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
Error!: SQLSTATE[42000]: Syntax error or access violation: 1064 You have an error in your SQL syntax; check the manual that corresponds to your MariaDB server version for the right syntax to use near 'and id<89597 and publish = 1 order by id desc limit 3' at line 1